স্বৈরতন্ত্র তাঁকে কারারুদ্ধ করেছে, তাঁর কণ্ঠ রোধ করতে পারেনি
Gour Kishore Ghosh

‘নিষ্ক্রিয়তাও পাপ’

১৯৭২-এ নানা দ্বিধা-সংশয় থাকা সত্ত্বেও সিপিএমের চাইতে নব কংগ্রেসকেই গৌরকিশোর মন্দের ভাল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

Advertisement

সুগত বসু

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২২ ০৪:৩৬
Share:

অদম্য: কারামুক্তির পরে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গৌরকিশোর ঘোষ। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬

সৈয়দ মুজতবা আলি বিষয়ে এক বার বলেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ, “তাঁর দেশে বিদেশে পড়েই আমি লিখতে শিখি... এ কথায় অত্যুক্তি নেই।” আলি সাহেবের ডাক পেয়ে ১৯৪৮ সালে প্রতাপকুমার রায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে গৌরকিশোর হাজির হয়েছিলেন পার্ক সার্কাসে তাঁর ৫ নম্বর পার্ল রোডের ডেরায়। “আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে এইটুকু জানা গেল যে, ‘ফা-হিয়েন’ নামের কে এক উঠতি লেখক বাজে মাল চালিয়ে তাঁর মার্কেট খারাপ করে দিচ্ছে। তাকে একটু কড়কে দেবার জন্যই তিনিই তলব পাঠিয়েছেন।”

Advertisement

জুন ১৯২৩। গৌরকিশোরের জন্মলগ্ন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সম্ভাবনাময় মুহূর্ত। সে বছরই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ হিন্দু-মুসলমান সাম্যের ভিত্তিতে বেঙ্গল প্যাক্ট-এর মাধ্যমে ঐক্যসাধনের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। বাংলার আইনসভার নির্বাচনে স্বরাজ দল হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সমর্থন নিয়ে ভাল ফল করেছিল। সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় বাংলার কথা ও ইংরেজি পত্রিকা ফরওয়ার্ড। আবার ১৯২৩-এই লোকসমক্ষে এসেছিল ‘স্বরাজ সংবিধান’। এই সংবিধানে সর্বোচ্চ মাত্রার স্থানীয় স্বশাসনের কথা ঘোষণা করা হয়, যার উপর থাকবে উচ্চতর কেন্দ্রগুলির ‘ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ’। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব, পরামর্শদান ও সমন্বয়ের কাজে সীমিত থাকবে।

উনিশশো বিশের দশকের মধ্য ভাগে গ্রাম ও শহর বাংলার অপূর্ব বিবরণ আমরা পাই গৌরকিশোরের জল পড়ে পাতা নড়ে উপন্যাসে। কাহিনির শেষে বিবৃত হয়েছে একটি যুগের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবসান। ১৯২৫-এর জুন মাসে চুয়াডাঙা ইস্টিশনে দার্জিলিং মেল প্রবেশের দৃশ্য। “দেশবন্ধু মারা গেছেন! মেজকর্তা প্রথমে ধরতে পারলেন না কথাটা। কোন দেশবন্ধু? দেশবন্ধু আর ক’টা আছে বাংলায়? সি আর দাশ মারা গেছেন। মেজকর্তার বুকে কথাটা যেন বুলেট হয়ে এসে বিঁধল।... পরক্ষণেই মনে পড়ল, এই গাড়িতেই দেশবন্ধুর দেহ যাচ্ছে কলকাতায়। তিনিও যাচ্ছেন। তিনি যেন তাঁদের যুগের শবদেহকেই বহন করে নিয়ে চলেছেন।... জোরে বৃষ্টি নামল। মেজকর্তার সামনের জানলা দিয়ে ছাট আসছে জোরে। যাত্রীরা পটাপট কাচের শার্শি তুলে দিলেন। একটু পরে পিছন থেকেও ছাট আসতে লাগল। সেদিককার শার্শিও তুলে দেওয়া হল। জলের ঝাপটা লেগে কাচের শার্শি অস্বচ্ছ হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ মেজকর্তার মনে হল, গোটা কামরাটাই, হয়তো বা গোটা ট্রেনটাই, এক বৃহৎ শবাধারে পরিণত হয়েছে।”

Advertisement

ঔপন্যাসিক হিসেবে গৌরকিশোরের শ্রেষ্ঠ কীর্তি অবশ্যই তাঁর দেশ মাটি মানুষ এপিক-ত্রয়ীর দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রেম নেই। এই আখ্যানের ‘ছবির মধ্যে ছবি, ঘরের মধ্যে ঘর’ যখন ধারাবাহিক ভাবে উন্মোচিত হচ্ছে দেশ পত্রিকার পাতায়, তখন আমি কেমব্রিজে পিএইচ ডি ছাত্র হিসেবে কৃষক অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণায় রত। সেই সূত্রে আমি ১৯৭৯-৮০’তে ঘুরে বেড়াই দুই বাংলার বিভিন্ন মহাফেজখানায় গ্রামীণ ইতিহাসের উপাদানের সন্ধানে। আমার লেখায় প্রধান চরিত্র তিরিশের মন্দার দশকে ঋণে ভারাক্রান্ত বাঙালি মুসলমান চাষি। ঠিক সেই গবেষণার সময়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ি হিন্দু-মুসলমানের কৃত্রিম অপরিচয়ের জাল সরিয়ে দিয়ে গৌরকিশোরের ফিকশনাল ন্যারেটিভ (গল্পের আখ্যান) ও হিস্টোরিক্যাল ন্যারেটিভ (ঐতিহাসিক আখ্যান)-এর পার্টিশনের দেওয়াল ভেঙে-দেওয়া বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্তরঙ্গ চলমান কাহিনি।

কাজটা যে সহজ ছিল না তা বলা বাহুল্য। প্রেম নেই প্রকাশের প্রায় দুই দশক পরেও এক নামী বাঙালি ইতিহাসবিদ তাঁর প্রভিন্সিয়ালাইজ়িং ইউরোপ কেতাবে কেবলমাত্র বাঙালি উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্ত হিন্দু পুরুষসমাজ নিয়ে চর্চা ও বাঙালি মুসলমানকে উহ্য রাখার এক অজুহাত দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য: “হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালির মধ্যে যে ঐতিহাসিক ব্যবধান আছে, আমি খুব দুঃখের সঙ্গেই সেটা জানি, এই বইও তার ছাপ এড়াতে পারেনি। একশো বছরের বেশি সময় ধরে হিন্দু ইতিহাস-লেখকরা মুসলমানদের যে ভাবে দেখেছেন, এক ইতিহাসবিদ তাকে অভিহিত করেছিলেন ‘বিস্মৃত সংখ্যাগুরু’ নামে। এই ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে আমি অতিক্রম করতে পারিনি, কারণ স্বাধীন ভারতে বড় হওয়ার সময় যে শিক্ষা আমরা পেয়েছিলাম, মুসলমানকে ভুলে থাকার এই ব্যাপারটা তার মধ্যে গভীর ভাবে নিহিত ছিল।”

এ বিষয়ে দু’টি কথা বলার আছে। প্রথমত, এই বাংলায়, এই কলকাতা শহরেই, আমার বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা, দীপেশ চক্রবর্তীর বর্ণনা থেকে একেবারেই আলাদা। হিন্দু-মুসলমানের আত্মিক সম্পর্ক আমার সেই বড় হয়ে ওঠার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল। গৌরকিশোরের প্রেম নেই পড়তে পড়তে মনে হত স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে মুর্শিদাবাদের সালার গ্রাম ও রেল স্টেশনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপের কথা। অবশ্যই মোটামুটি সমসাময়িক কালেও ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতেই পারে। দ্বিতীয় কথাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য চর্চা বা ইতিহাস চর্চা, যে কোনও ক্ষেত্রেই, শিক্ষার কুসংস্কারের সীমানা অতিক্রম না করার সিদ্ধান্ত এক ধরনের অ্যাবডিকেশন অব রেসপন্সিবিলিটি বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। গৌরকিশোর সেই ভেদাভেদ মানেননি, বরং সেটি মুছে ফেলা তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।

প্রেম নেই উপন্যাসের জন্য ১৯৮২ সালে গৌরকিশোর বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ ও সীতারাম পাঠ করে রণজিৎ গুহ-র বক্তব্য: “তিনি শুধু ঔপন্যাসিকই নন, তিনি ঐতিহাসিকও বটে।” এ কথা যদি বঙ্কিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তা হলে গৌরকিশোরেরও এই স্বীকৃতি প্রাপ্য। বঙ্কিমের রাজসিংহ বইয়ের পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ইতিহাস ও মানবকে এক সূত্রে গাঁথার প্রচেষ্টা লক্ষ করেছিলেন। গৌরকিশোরের প্রেম নেই-তে ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে মানবজীবনের মহিমা ও ট্র্যাজেডি মিশ্রিত হয়েছে। শফিকুল ও বিলকিস, ফটিক ও ছবির মৃত সন্তান প্রসবের মুহূর্তে সার্জন ডাক্তার বললেন, “দ্য চাইল্ড ইজ় ডেড।” ১৯৩৭ সাল। “কংগ্রেস-প্রজা কোয়ালিশন মারা গিয়েছে। ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি। কিন্তু তার জন্য কাকে দোষী করব আমি? হক সাহেবকে? কংগ্রেসকে? কাকে?... কংগ্রেস-প্রজা কোয়ালিশন ছিল ফটিকের শেষ ভরসা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খোয়াব। খোয়াব!”

ইতিহাসবিদ গৌরকিশোরকে যদি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সাংবাদিকতায় তো তিনি দিকপাল। ‘রূপদর্শী’কে বলা যায় ‘মাস্টার অব পলিটিক্যাল স্যাটায়ার’। তাঁর লেখনীর আঁচড় থেকে নকশাল, সিপিএম, সিপিআই, কংগ্রেস, কেউ রেহাই পায়নি। ১৯৭২ সালে রূপদর্শী রচনা করলেন আরও পঁচিশ বছর পর নেতাজি সুভাষচন্দ্রের শতবর্ষ উৎসবের এক কাল্পনিক দৃশ্য। ‘নেতাজী পূজা ১৯৯৭’ সংবাদে পড়ি, “এ বছর নেতাজীর ভ্যারাইটি ও প্রতিমার সাইজ গত বছরের শতবার্ষিকী উৎসবকেও টেক্কা দিয়েছে। বাঙালির উদ্ভাবনী শক্তি সত্যিই অফুরন্ত... বাঁশের নেতাজী, কাঠের নেতাজী, প্লাস্টিকের নেতাজী, অটোমেটিক নেতাজী, চালের নেতাজী, খই-এর নেতাজী, মুড়ির নেতাজী, মুড়কির নেতাজী, ছানার নেতাজী, ক্ষীরের নেতাজী, সরের নেতাজী, কাগজের নেতাজী, পিচবোর্ডের নেতাজী, পদব্রজে নেতাজী, ঘোড়ার পিঠে নেতাজী, ট্যাঙ্কের মাথায় নেতাজী, সাবমেরিনে নেতাজী, প্লেনে নেতাজী, তাইহোকুর নেতাজী, নেতাজীর কোলে মুজিব, নেতাজীর কাঁধে জ্যোতিদা প্রভৃতি মূর্তিগুলো লক্ষ লক্ষ নরনারীর বিস্ময় উদ্রেক করেছে।” এক জন রক্তমাংসের মানুষকে, তা তিনি যত বড় মাপের মহাপুরুষই হোন, দেবমূর্তিতে রূপান্তর গৌরকিশোরের মতো মানবতাবাদীর কাছে ছিল নিছকই প্রহসন।

১৯৭২-এ নানা দ্বিধা-সংশয় থাকা সত্ত্বেও সিপিএমের চাইতে নব কংগ্রেসকেই গৌরকিশোর মন্দের ভাল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। অতঃপর ১৯৭৫। জরুরি অবস্থার দমন-পীড়ন নীতির সাহসী প্রতিবাদী রূপে সাংবাদিক গৌরকিশোরের ‘ফাইনেস্ট আওয়ার’। পিতার পত্রে তিনি লিখলেন, “আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার, আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমারও অস্তিত্বকে হত্যা করা।” স্বৈরাচারী সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করল কিন্তু তাঁর কণ্ঠরোধ করতে পারল না। প্রেসিডেন্সি জেলের দশ নম্বর সেল থেকে তাঁর দু’টি লেখা বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমটি প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাসিবাদ বিষয়ে পাঠ, কারণ তখন ইন্দিরা গান্ধী নিজেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। গৌরকিশোর স্পষ্ট জানালেন যে, ফ্যাসিবাদের একটি বিশেষত্বই হল ‘দলীয় নেতাই দেশ’— ‘এই অহমিকাকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয়দান’। দ্বিতীয় লেখাটি প্রিয় স্বদেশবাসী ভাই-বোনেদের উদ্দেশে ১৯৭৮-এর প্রজাতন্ত্র দিবসে চিঠি। তার একটি বাক্য আলাদা করে মনে করব আজ: “মনে রাখবেন, নিষ্ক্রিয়তাও পাপ, কেননা তাও সহযোগিতাই।”

সোহিনী ঘোষের সম্পাদিত দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা বইয়ে দেখছি যে গৌরকিশোর তাঁর জেলের কোনও খাতায় বা কাগজে লিখে রেখেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের ১৯২৪ সালের একটি বক্তৃতার থেকে উদ্ধৃতি— “টু বি টেকেন অ্যান্ড কেপ্ট ইন কাস্টডি ফর অ্যান ইনডেফিনিট পিরিয়ড অব টাইম, উইদাউট বিয়িং টোল্ড হোয়াট এভিডেন্স দেয়ার ইজ়, অ্যান্ড উইদাউট বিয়িং ব্রট টু জাস্টিস অ্যাকর্ডিং টু দ্য ল অব দ্য ল্যান্ড, ইজ় আ ডিনায়াল অব দ্য প্রাইমারি রাইট অব হিউম্যানিটি। দিস ইজ় ল-লেস ল।” আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল চতুর ইংরেজদের বেআইনি আইনের বিরুদ্ধে বিবেকের লড়াই। সেই ঔপনিবেশিক ট্র্যাডিশন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে সমানে চলেছে। যে আইন যত বেশি বেআইনি, তার ততই গালভরা নাম। যে আইনে গৌরকিশোরকে পাকড়াও করা হয়েছিল, সেটি ছিল ‘মেনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট’ (মিসা)। আজকাল আকছাড় ব্যবহৃত হচ্ছে ‘আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ (ইউএপিএ)। যে ‘ল’ এমনিতেই ‘আন-ল-ফুল’, তাকে সম্পূর্ণ ‘ল-লেস’ করতে আবার সংশোধনীও পাশ করা হয়!

জরুরি অবস্থার আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ হিসেবে আমায় এক অপ্রিয় সত্য কথা বলতেই হয়। যাঁরা ঔপনিবেশিক ‘ল-লেস ল’ সমূহ বজায় রেখে স্বাধীন নাগরিকদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিলেন, তাঁদের আমরা আমাদের প্রজাতন্ত্রের ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ হিসেবে দেবতার আসনে বসিয়েছি। আর যে সব মানুষ আজাদির লড়াইয়ে ও সংবিধান-সভার ভিতরে ও বাইরে প্রকৃত ডেমোক্র্যাসি, ফ্রিডম ও সেকুলারিজ়ম-এর জন্য প্রাণপাত করেছিলেন তাঁদের নাম আজ আমরা বিস্মৃত হয়েছি। যাঁরা আমাদের সুন্দর প্রিঅ্যাম্বল-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হরিবিষ্ণু কামথ, কে টি শাহ, শিবনলাল সাক্সেনা, পি এস দেশমুখ, আর কে সিধওয়া, মহাবীর ত্যাগী, ঠাকুরদাস ভার্গব, নাজিরুদ্দিন আহমেদ, হৃদয়নাথ কুন্জ়রু ও ব্রজেশ্বর প্রসাদ। জরুরি অবস্থার বিষয় ধারার আলোচনার সময় নেতাজির অনুগামী হরিবিষ্ণু কামথ ১৯৪৯ সালে বলেছিলেন— সব গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান খঁুটিয়ে পড়েও তিনি জরুরি অবস্থার মতো কোনও সাংবিধানিক বন্দোবস্ত খুঁজে পাননি, “আমার মতে এর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিল (জার্মানিতে) থার্ড রাইখ-এর ওয়াইমার সংবিধান, এবং হিটলার ওই সংবিধানের কিছু বিধানকে কাজে লাগিয়েই সেই (ওয়াইমার রিপাবলিককে) ধ্বংস করেছিলেন।” এর ছাব্বিশ বছর বাদে, ১৯৭৫ সালে, হরিবিষ্ণুর স্থান মিলেছিল জেলখানায়, গৌরকিশোরের মতোই।

১৯৫০-এর জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়ান ল রিভিউ-তে এক প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র বসু লিখেছিলেন: ভারতের সংবিধানের যে আঠারো নম্বর অংশে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারি করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে এক আশ্চর্য সামঞ্জস্য আছে ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের, যে আইনের মূল ভাবধারাটি অতি সামান্য অদলবদল-সহ প্রায় পুরোটাই রক্ষিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীন দেশের সংবিধানে।” ‘ইমার্জেন্সি প্রভিশন’গুলিকে এই আইনজ্ঞ স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘টাইম বোমা’র আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, আমাদের সংবিধানের ২৯ নম্বর ধারা “ডাজ় নট সিকিয়োর ডিউ প্রোসেস অব ল, ইট সিকিয়োর্স প্রসিডিয়রাল প্রসেস ওনলি।” ঔপনিবেশিক যুগের এই ‘স্টেট অব একসেপশন’ স্বাধীন ভারতে রেখে দেওয়ার ফলেই জরুরি অবস্থার সময় ‘ফান্ডামেন্টাল রাইটস টু লাইফ অ্যান্ড লিবার্টি’ কেড়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট ৪-১ সিদ্ধান্তে ‘হেবিয়াস কর্পাস’-এর মৌলিক অধিকারও সাসপেন্ড করেছিল। কেবল জাস্টিস এইচ আর খন্না সাহস, বিবেক ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। আজকের অঘোষিত জরুরি অবস্থায় যে হেবিয়াস কর্পাস-এর শুনানি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হওয়া উচিত তা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অবহেলিত হয়। স্বাধীনতার ‘অমৃত উৎসব’-এর মুহূর্তে হাজার হাজার নাগরিক বিনা বিচারে অথবা ‘ল-লেস ল’-এর নাগপাশে বন্দি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

২৫ জুন ১৯৭৫-এর মধ্যরাতে যে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ বিনা বাক্যব্যয়ে জরুরি অবস্থার ঘোষণাপত্র দস্তখত করেন, তিনি ১৯৭৭-এর ১১ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ মারা যান। সে দিন সন্ধ্যায় গৌরকিশোর তাঁর আনন্দবাজারের সহকর্মী শ্যামল চক্রবর্তীকে নিয়ে আমাদের ৯০ শরৎ বসু রোডের বসন্ধুরা গৃহে এসেছিলেন, আমার দাদু সংবিধান-বিশেষজ্ঞ চারুচন্দ্র চৌধুরীর দেশের সাংবিধানিক পরিস্থিতি বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউ নিতে। সে বছরই ৯ জুলাই গৌরকিশোর তাঁর স্ত্রীশীলাকে নিয়ে আবার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, এ বার একটি আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান পিইএন-এর পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গৌরকিশোরকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, মা-র উদ্যোগে তার আয়োজন আমাদের বাড়িতেই হয়েছিল। শুনেছি, সেখানে গাওয়া হয়েছিল ‘আগুনের পরশমণি’ গানটি।

(চলবে)

ঋণ: গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম-শতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি। শতবর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পঠিত বক্তৃতা।

গার্ডিনার প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement