এটাই কি ‘নির্বোধের যুগ’
Climate Change

সব দেশই এখনও ভেবে চলেছে নিজের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের কথা

গ্লাসগোতে বিস্তর বাক্‌বিতণ্ডা হবেই। কিন্তু দিনের শেষে পরিবেশের প্রাপ্তির ঝুলিতে কী থাকবে? কতটা বাস্তবায়িত হবে ‘নেট জ়িরো’র লক্ষ্যমাত্রা?

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২১ ০৪:৫৩
Share:

সাহসিনী: ‘ফ্রাইডেজ় ফর ফিউচার’ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ইটালির মিলান শহরে বক্তৃতা করছেন গ্রেটা থুনবার্গ, ১ অক্টোবর। রয়টার্স ।

বেশ হইচই ফেলেছিল ২০০৯-এর ব্রিটিশ তথ্যচিত্র দি এজ অব স্টুপিড। ছবিটি যেন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের আলেখ্য— ২০৫৫ সালে জলবায়ুর পরিবর্তন বিপর্যয় এনেছে বিশ্ব জুড়ে; বন্যায় ভেসে গিয়েছে লন্ডন, সিডনি জ্বলছে, মরুভূমি গ্রাস করে নিয়েছে লাস ভেগাস-কে; বর্ষণ-স্নাত আমাজ়নের নিবিড় অরণ্য পুড়ে খাক, আল্পস পর্বত থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে তুষারের স্নিগ্ধ স্পর্শ; পরমাণু যুদ্ধ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ভারতকে।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতেই এক সংরক্ষণবিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মানুষের বহু যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান এবং শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণের। প্রায় বরফ-শূন্য সুমেরু ভূখণ্ডের উপান্তে বিশাল সংরক্ষণাগারে একক মানুষটি দেখে আধ শতক আগেকার দুনিয়ার ছবি— ২০০৮-এর এক আর্কাইভাল ফুটেজ। বিস্মিত হয় সে। প্রশ্ন করে, সুযোগ থাকতে কেন মানবজাতি জলবায়ুর পরিবর্তন আটকায়নি? তথ্যচিত্রটি যেন ভবিষ্যতের কল্পিত পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অতীতের, অর্থাৎ আজকের নীতি এবং কাজকর্মের, পর্যালোচনা। দ্য টাইমস ছবিটিকে বলেছে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আত্মতুষ্টির উপর সব চাইতে বড় নাটকীয় আক্রমণ। ছবিটির শক্তির জায়গা হল তা সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দিনের অন্তিমকালের, সেই সঙ্গে অন্বেষণ করেছে বিকল্প পথের, তুলে ধরেছে অপরাধীদের নামও।

এই তথ্যচিত্রটির সময়কাল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সদ্যই ২০০৭-এর শান্তির নোবেল দেওয়া হয়েছে আইপিসিসি এবং আল গোরকে— মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদানের জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই জলবায়ু নিয়ে বিশ্বমানবের চেতনায় একটা বহু-প্রয়োজনীয় ‘হালকা ধাক্কা’ (আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের ভাষায়, নাজ) লেগেছে। যদিও ১৯৯৫-তে বার্লিন থেকে শুরু করে প্রতি বছর কোথাও না কোথাও নিয়ম করে বসেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ়’ (সিওপি)। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো-তে তৈরি হয় ঐতিহাসিক কিয়োটো প্রোটোকল। এই সম্মেলনগুলিতে প্রচুর গালভরা আলোচনা হলেও অবশ্য জলবায়ুর প্রায়-বিপর্যয় আটকানো যায়নি।

Advertisement

এর মধ্যে ২০১৫-র প্যারিসের সিওপি২১ সম্মেলনটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তর আলাপ-আলোচনায় তৈরি হয় ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি, সাক্ষর করে ১৯২টি ‘পার্টি’। সেখানে অনেক ভাল ভাল পরিকল্পনা। যেমন, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে শিল্পযুগ শুরুর আগের তাপমাত্রার চাইতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির সীমারেখার নীচে আটকে রাখা, দুইয়ের বদলে দেড় ডিগ্রি হলে আরও ভাল। সেই সঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ। এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদই অর্জন করতে হবে ‘নেট জ়িরো’র লক্ষ্যমাত্রা। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকা বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের পুরোটাই দূর করতে হবে কোনও ভাবে। প্যারিস চুক্তিটি বহুপাক্ষিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দিকচিহ্ন-নির্দেশক।

পরিকল্পনা করা সহজ, বাস্তবায়ন নয়। তার জন্য প্রয়োজন আধুনিকতম বিজ্ঞান-নির্ভর অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর। প্যারিস চুক্তির সার্থকতার লক্ষ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে বিভিন্ন দেশ কী পদক্ষেপ করবে, তার রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল ২০২০-এর মধ্যে। কিন্তু কোভিড অতিমারির জন্য ২০২০-তে সিওপি না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ২০২১-এর এই গ্লাসগো সম্মেলন।

প্যারিস থেকে গ্লাসগো-র দূরত্ব খুব বেশি নয়। তবু এই পথটুকু অতিক্রম করার ফাঁকে ছ’বছরের ব্যবধানে পরিবেশ নিয়ে মানুষের সচেতনতায় একটা চোখে পড়ার মতো বদল ঘটেছে। বদল ঘটেছে মিডিয়ার মাতামাতিতেও। এর পিছনে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবদান কম নয়। হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার মাস চারেক পরেই ট্রাম্প ঘোষণা করে দিলেন প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে আমেরিকা, কারণ তা আমেরিকার অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর। দুনিয়া জুড়ে মস্ত শোরগোল। পরিবেশ নিয়ে বিশ্বজনতার সচেতনতা যে খানিকটা হলেও বেড়েছে।

সচেতনতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ অবশ্য সুইডিশ অষ্টাদশী গ্রেটা থুনবার্গ— যিনি ভয় পেয়েছেন মর্তলোকে মহাকালের নতুন খাতার পাতা জুড়ে একটা শূন্য নামার। একই ভয় চিত্রিত হয়েছে দি এজ অব স্টুপিড তথ্যচিত্রেও। গ্রেটা তাঁর ভয়টাকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন পৃথিবী জুড়ে। নাড়া দিতে চেয়েছেন আজকের ‘স্টুপিড’দের। প্রতি সপ্তাহে এক দিন পরিবেশের জন্য স্কুল স্ট্রাইক করে গ্রেটা বসে পড়ছিলেন সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে। তাঁর একক-আন্দোলন ক্রমে লক্ষ লক্ষ সঙ্গী পেয়েছে এ গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রত্যাসন্ন প্রলয়-সন্ধ্যায় দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতাদের গ্রেটা নির্দ্বিধায় দোষ দিতে পারেন পরিবেশ রক্ষায় তাঁদের যুগ-লালিত নিষ্ক্রিয়তার জন্য। বস্তুত, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, মাত্রাতিরিক্ত বায়ু ও জলদূষণের মতো বিষয়গুলিকে স্কুলপাঠ্য রচনা আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের বাইরে সাধারণ মানুষের আলোচনায় নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব এই সুইডিশ তরুণীরই।

জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস সম্প্রতি বলেছেন, আমরা নাকি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত দেশ তাদের প্রতিশ্রুতিমতো পদক্ষেপ করলেও আজকের হারে এই শতকের শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বাস্তবে পরিবেশ নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা পিছিয়ে আছি বহু আলোকবর্ষ, এমনটাই বলেছেন গুতেরেস। গ্লাসগোর সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ পরিবেশ নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা এবং প্রতিশ্রুতির খতিয়ান জমা দেবে নিশ্চয়ই। সে সব নিয়ে দড়ি টানাটানি আর চাপান-উতোর চলবে আন্তর্জাতিক স্তরে। এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে এ সবের কতটা বাস্তবায়িত হল, তার উপরই নির্ভর করবে এ গ্রহের উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর।

‘নেট জ়িরো’র অর্থ কয়লা বা পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা নয়। প্রয়োজন রাশ টানা, বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজ। ‘দেড় ডিগ্রি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের ঊর্ধ্বসীমা যেটুকু রাখা উচিত, ২০৩০ নাগাদ বাস্তবের পরিমাণটা দাঁড়াবে তার দ্বিগুণের বেশি। পৃথিবী জুড়েই। গত এক দশক ধরেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড জোগায় চিন। সে দেশে ইতিমধ্যেই রয়েছে হাজারখানেক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র— আরও ৪৩টা নতুন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে তারা। অস্ট্রেলিয়া আবার সম্পদের জন্য কয়লার উৎপাদন এবং রফতানির উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। এবং পর্যায়ক্রমে কয়লা উৎপাদন কমাতে তারা স্পষ্টতই অনাগ্রহী। ২০১৭ সালে, অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন যখন সে দেশের ট্রেজারার, সে সময় পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উপর এক বিতর্কের সময় মরিসন সংসদে হাজির হলেন এক টুকরো কয়লা নিয়ে, বিজয়ীর ট্রফির মতো তুলে ধরলেন কয়লার টুকরোটা। মরিসনের এই কয়লা-প্রীতির পিছনে ভোট-রাজনীতি রয়েছে পুরোমাত্রায়, কয়লা-প্রধান অঞ্চলে রয়েছে সে দেশের বেশ কিছু হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের নির্বাচন-ক্ষেত্র। ও দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে জো বাইডেনের আমেরিকা কতটা আলাদা, তার হিসাব কষার সময় মনে রাখা দরকার যে, বাইডেনের আমেরিকা প্যারিস চুক্তিতে নতুন করে শামিল হলেও বাইডেন প্রশাসন কিন্তু সমর্থন করে চলেছে ট্রাম্পের আমলের ‘অয়েল স্যান্ডস পাইপলাইন প্রোজেক্ট’, যা কানাডার তেল পৌঁছে দেবে আমেরিকার মিনেসোটা আর উইসকনসিনে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব অর্থনীতি আর রাজনীতি তাই পরিবেশ নীতিকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠবেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন কতটা ভঙ্গুর এই সব চুক্তি। এটা কি ‘এজ অব স্টুপিড’— নির্বোধের যুগ— নয়?

গ্লাসগোতে বিস্তর বাক্‌বিতণ্ডা হবেই। কিন্তু দিনের শেষে পরিবেশের প্রাপ্তির ঝুলিতে কী থাকবে? কতটা বাস্তবায়িত হবে ‘নেট জ়িরো’র লক্ষ্যমাত্রা? পৃথিবী কি পারবে নবজাতকের বাসযোগ্য হতে? ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতেই থাকে, হতে থাকে সম্মেলনের পর সম্মেলন। দুনিয়ার কার্বন নিঃসরণ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। তাপমাত্রাও। ২০৫৫ হোক বা ২০৬৫, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ভবিষ্যতের ঈশান কোণে পুঞ্জীভূত হতেই থাকে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement