১৯৯১ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের হাত ধরে ভারতে শুরু হয়েছিল নব্য উদারবাদী অর্থনীতির জয়যাত্রা— উদারীকরণ, বিশ্বায়ন। তার বহু গুণকীর্তনের ছটায় যে কথাটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে, তা হল, মনমোহিনী উদার আর্থিক নীতি গ্রহণ করার পরে গত তিন দশকে ভারতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য অনেকখানি বেড়েছে। বৃহৎ পুঁজি যা চেয়েছিল, কংগ্রেস তার কিছুই দিতে পিছপা হয়নি। ব্যাঙ্ক-বিমা-টেলিকম-এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রে বিপুল বিলগ্নিকরণ ও কর্মী ছাঁটাই, অনুপ্রবেশ ও সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে নাগরিকত্ব আইনে বদল আনা, কাশ্মীর প্রসঙ্গে নীতিপঙ্গুত্ব এবং কার্যত সেখানকার হিন্দু-মুসলমান সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসঘাতকতা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ক্ষুধার মতো মৌলিক বিষয়ে যথোপযুক্ত নজর না দিয়ে সামরিক খাতে কোটি কোটি ডলার খরচ, নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি, কৃষক-শ্রমিক বিরোধী বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, আধার কার্ডের নামে নাগরিকদের ব্যক্তি পরিসরে রাষ্ট্রের নজরদারি— এর সব কিছুই কংগ্রেস আমলেও হত, তবে বিশেষ ঢাকঢোল না পিটিয়ে।
বঙ্গ-বামপন্থীরা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে লড়বেন বলে জোট বেঁধেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। প্রশ্ন হল, কংগ্রেস, তৃণমূল বা অন্য কোনও দক্ষিণপন্থী শক্তির হাত ধরে কি নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব? এক কথায় এর উত্তর হল: না। এই জোটের সিদ্ধান্তটি প্রকৃত অর্থে ‘ঐতিহাসিক ভুল’। দেশব্যাপী চলমান কৃষি আন্দোলন, শ্রমবিধির বিরুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলির লড়াই, নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন পুঁজিবাদের শিকড়ে আঘাত করেছে। অথচ, বামপন্থীরা সেই আন্দোলনকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ। উল্টে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পকে ‘খয়রাতি’ আখ্যা দিয়ে আরও বেশি করে জনবিচ্ছিন্ন হলেন তাঁরা। আসলে শ্রমজীবী মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে সাধারণ মানুষের নাড়ির গতি বোঝার ক্ষমতা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতাদের আর নেই।
নব্বইয়ের দশক থেকেই তাঁরা বৃহৎ বেসরকারি পুঁজিনির্ভর শিল্পায়নের মডেলের অন্ধ অনুসারী। এ বারের নির্বাচনী প্রচার দেখেও মনে হয়েছে ‘কারখানা ওয়াহি বনায়েঙ্গে’ নীতি থেকে তাঁরা সরে আসেননি। মেহনতি মানুষের বদলে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পার্টি হয়ে ওঠার এই সাধনা বাংলার সিপিএমের শ্রেণিচরিত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন বা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি নিয়ে যত কথা ভোটের ময়দানে বামপন্থীরা খরচ করেছেন, তার সিকিভাগও কৃষি আইন, শ্রমবিধি নিয়ে তাঁরা উচ্চারণ করেননি। লকডাউনে শ্রমজীবী ক্যান্টিন করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবে সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে মানুষকে সংগঠিত করার কাজটা তাঁদেরই করার কথা ছিল। সেই দায়িত্ব পালনে তাঁরা শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ। ‘দরকারে পাশে থাকা’-র সঙ্গে ‘সরকারে আসা’-র সম্পর্ক যে নেই, এটা বোঝার বোধশক্তিটুকুও তাঁরা হারিয়েছেন। এনআরসি-বিরোধিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে না নামার ফলে সংখ্যালঘুদের আস্থাও যে হারিয়েছেন তাঁরা, এ কথাও এ বারের নির্বাচনের ফলে স্পষ্ট।
এক শ্রেণির সিপিএম নেতা তৃণমূলকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার অত্যুৎসাহে তাঁদের কর্মীদের বিপথে চালিত করেছেন। দক্ষিণপন্থার এই চূড়ান্ত উত্থান যে বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে— এই বৃহত্তর রাজনৈতিক সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুমাত্র স্থানীয় প্রশ্নের উপর ফোকাস করা ছিল রাজনৈতিক আত্মঘাতের সমান। ফলে বিভ্রান্ত হয়েছেন সাধারণ ভোটার। বিজেপির বিরুদ্ধে যে আদৌ তাঁরা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, এই বিশ্বাসটাই গড়ে ওঠেনি জনমানসে। নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে দেখা গেল যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। আর বামপন্থীরা কার্যত মুছে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় রাজনীতির মানচিত্র থেকে।
অথচ এই উগ্র ফ্যাসিবাদী আবহেও যে বামপন্থীরা জনতার দরবারে প্রাসঙ্গিক থাকতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ কেরল। শবরীমালাকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের আসনচ্যুত করার মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছিল, সঙ্গী মোদীভক্ত মিডিয়া আর নয়া উদারবাদী প্রকল্পের সাঙাত কংগ্রেস। কিন্তু এত কিছুর পরেও সেখানে উপর্যুপরি দ্বিতীয় বার ঐতিহাসিক জয় বামপন্থীদের। তামিলনাড়ুও চার জন বামপন্থী বিধায়ক পেল এ বারের নির্বাচনে; তুমুল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যেও অসম পেল এক জনকে। আর তেভাগা আন্দোলনের বাংলায় বামপন্থীরা আজ আইনসভায় শূন্য।
কিন্তু তার পরেও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে যায়। নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, কমিউনিস্টদের আসল জায়গা রাস্তায়— কারখানার গেটে, কৃষক আন্দোলনের জমায়েতে, আর্ত মানুষের পাশে। সেখানে লড়তে ভুলে গেলে চলবে না।