গল্পটি শুরু হচ্ছে খিদিরপুর বড়ামহল্লা থেকে। বা বলা যায় বড়ামহল্লার দুর্গাপুজো থেকে। তবে পুজোটি যে বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ তা নয়, কলকাতার নামকরা পুজোর তালিকাতেও তার নাম নেই। বড়ামহল্লার এই পুজোটি, উদ্যোক্তা ফাইভ স্টার ক্লাব— ক’জন জানে? তবু এই পুজোটিরই এক বা অনেক গল্প আছে। যে গল্প শুধু বর্তমানে শুরু হয়ে, বর্তমানেই শেষ নয়। তার উত্তরাধিকার লুকিয়ে আছে অতীতের গর্ভে।
গল্পটির কথক শাহিদ আলি। এই পুজোর পুরোহিত। একেবারে নিঁখুত ভাবে, সমস্ত আচার-আচরণ মেনে পৌরোহিত্য করেন তিনি। শুধু তিনি কেন, ষষ্ঠী থেকে দশমী পুরো বড়ামহল্লাই মেনে চলে সব আচার। সব দোকান, সব রেস্তরাঁয় গোমাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। শুধু তা-ই নয়, কোনও বাড়িতেও রান্না করা হয় না এমন কিছু, যা পুজোর আচার-আচরণের পরিপন্থী, বা মানুষের ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করতে পারে।
শুধু তা-ই নয়। পুজোর প্রতিটি দিন, বিধিমতে পালিত হয় প্রতিটি বাড়িতেও। ষষ্ঠীতে সন্তানের কল্যাণে ব্রত পালন, অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ খাওয়া, নবমীতে নিরামিষ পাঁঠার মাংস— পুজোর আচার ও আয়োজন, আনন্দের উপকরণ সবই বিন্যস্ত থাকে থরে থরে। এবং এ ক্ষেত্রেও তথাকথিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচার-বিধি লঙ্ঘন না করে। অতি সূক্ষ্ম তারে বাঁধা থাকে পরস্পরকে অসম্মান না করা, স্বকীয়তা বজায় রেখেও অন্যকে আপন করে নেওয়া, দীর্ঘকাল পাশাপাশি বড় হওয়া দু’টি প্রাচীন ধর্মের মানুষদের বিষিয়ে দেওয়ার সুযোগ না দেওয়ার মতো বিষয়গুলি, তার সবটুকুই সুষ্ঠু ভাবে পালিত হয় খিদিরপুর বড়ামহল্লার এই পুজোতে।
সে সব কথাই বলেন কথক শাহিদ আলি। তার সঙ্গে এও বলেন কী ভাবে তিনি এলেন এই হিন্দু পুজোর পৌরোহিত্যে। তাঁদের গল্পগুলো দুর্গাপুজোর গল্পের থেকে কিছু কম আকর্ষক নয়।
যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উদ্যাপন শাহিদ আলির পৌরোহিত্যে, তা তাঁর উত্তরাধিকার। শাহিদ আলির বাবা ছিলেন একই পুজোর পুরোহিতের সহকারী, ছোটবেলা থেকেই পুজোর মণ্ডপে ঘোরাফেরা, পুজোর কাজ শেখা শাহিদের জীবনের অংশ। শিখেও নেন পুজোর কাজ, বাড়ির লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো করতে শুরু করেন। তাঁর ধর্মীয় পরিচয় বিস্ময়কর ভাবে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তবে সবার ক্ষেত্রে বিষয়টা এত মসৃণ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কাজ পছন্দ হলেও, তাঁদের নাম ও পদবি পছন্দ হয় না অন্যদের। যেমন স্বর্ণ চিত্রকরের আসল নাম রূপবানা বেগম। অনন্য চিত্রকর তিনি, প্রতিমার পিছনের চালচিত্রের খুঁটিনাটি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। কিন্তু কাজ পাওয়ার সুবিধের জন্য তিনি ব্যবহার করেন স্বর্ণ চিত্রকর নামটি। যেমন কার্তিক চিত্রকরের আসল নাম শেখ কাদের, অমর চিত্রকরের নাম শেখ উমর। এঁরা স্বর্ণ চিত্রকরেরই পূর্বপুরুষ। সকলেই ছিলেন দুর্গাপুজোর কারিগর, সকলেই ব্যবহার করতেন নামের আড়াল।
যে ভাবে শাহিদ আলি খিদিরপুরের বড়ামহল্লার পুজো করে আসছেন, সেটাই কিন্তু একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে আরও অনেক পুজো-উৎসব। ২০১৬ সালে বর্ধমানের ধরন গ্রামে মুসলিম গ্রামবাসীরা দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন, যাতে পুজোর আনন্দ করার জন্য হিন্দু গ্রামবাসীদের গ্রামের বাইরে যেতে না হয়। যেমন ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের সীমান্তের গ্রাম কুলুবাড়ি। গ্রামের নব্বই শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। ভীষণ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয় সে গ্রামে, লালপাড় সাদা শাড়ি পরে সিঁদুর খেলেন মুসলিম মহিলারা। ঠিক যেমন দেখা যায় আগরতলায় সংখ্যালঘু বস্তি মোল্লাপাড়া সংলগ্ন এলাকায়, খিদিরপুরের বড়ামহল্লার পুজোতে, আরও হয়তো অসংখ্য পুজোতেও— যেখানে কিছু আপাত অ-হিন্দু নামের মানুষের হাত থেকে ছড়িয়ে পড়ে অঞ্জলির ফুল, সম্প্রীতির সিঁদুর।
এ প্রসঙ্গে উঠে আসে এমন এক জনের নাম, যাঁর সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক ও মানসিক অনুষঙ্গ সাধারণ ভাবে বিরূপ। তিনি রবার্ট ক্লাইভ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে চক্রান্ত করে হারিয়ে দেওয়ার আধা-সহানুভূতি আধা-দুঃখের ইতিহাসের এক আপাত ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে রবার্ট ক্লাইভের নাম। সেই রবার্ট ক্লাইভের স্মৃতিচারণ বলছে, বাঙালির দুর্গাপুজোতে গিয়েছিলেন তিনি, রীতিমতো প্রথা মেনে পুজো প্রার্থনাও করেছিলেন।
সময়টা ১৭৫৬। কলকাতা দখল করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা, নাম রেখেছিলেন আলিনগর, ঘটেছিল কুখ্যাত ‘ব্ল্যাকহোল ট্র্যাজেডি’। তার পর যুদ্ধ হয়েছে দুই পক্ষের, সবেমাত্র সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করেছেন ক্লাইভ, তাঁকে বিতাড়িত করেছেন কলকাতা থেকে। কিন্তু ক্লাইভের মন উচাটন। কোনও প্রার্থনাগৃহে গিয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করতে চান তিনি। কিন্তু তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চলের যে একটিমাত্র গির্জা, তা যুদ্ধচলাকালীন ভাঙা পড়েছে সিরাজের হাতে। এই সময় ক্লাইভের এক বাঙালি সহকারী তার বাড়ির দুর্গাপুজোয় যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ জানায় তাঁকে। তা রক্ষাও করেন ক্লাইভ। তার স্মৃতিচারণ থেকেই জানা যায় শুধু ক্লাইভ নন, অন্যান্য নবাবরাও উপস্থিত থাকতেন, অংশগ্রহণও করতেন দুর্গাপুজোয়।
এই উৎসবের সময়টা তাই অন্য রকম। রবার্ট ক্লাইভ থেকে শাহিদ আলি, স্বর্ণ চিত্রকরের শারদীয় উত্তরাধিকার আরও এক বার মনে করে নেওয়ার। ঋদ্ধ ঐতিহ্যকে আকাশপিদিম দেখানোর।