পেল্লায় হলঘর। আর তার ঠিক মাঝখানে একখানা খাড়া সিঁড়ি। ঠেকনা দেওয়া ইস্পাতের মই বলাই ভাল। সিলিং থেকে হৃষ্টপুষ্ট কলা ঝুলছে এক কাঁদি। আর মেঝেয় বসে তার দিকে লোভাতুর চোখে চেয়ে রয়েছে ১০টি বাঁদর। ছাড়া পেলেই ওই কলার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়।
এই ছবি কোনও চিড়িয়াখানার নয়। বরং আমেরিকা-সহ সারা বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারের! তা সেখানে হঠাৎ বাঁদর আর কলা কেন? এমন সাত-পাঁচ চিন্তা মনে ভিড় করার আগেই এক সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হল বাঁদরগুলোকে। যা হওয়ার ছিল, তা-ই হল। এক ছুটে তারা পৌঁছে গেল সেই মইয়ের কাছে। দুদ্দাড় বেগে, উঠতে লাগল তা বেয়ে। লক্ষ্য, নধর কলার কাঁদি।
কিন্তু ‘কাহানি মে টুইস্ট’। যখন সেই ১০ ‘বিচ্ছু’ মইয়ের মাঝপথে, তখনই চার দিক থেকে হোজ় পাইপের মাধ্যমে প্রবল গতিতে বরফ-ঠান্ডা জল আছড়ে পড়ল তাদের শরীরে। প্রথমে তারা হতভম্ব। তার পরে বেগতিক বুঝে প্রাণপণে মই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। কিন্তু জলের তোড়ে শেষ রক্ষা হল না। ১০ জনই ছিটকে পড়ল এ দিকে-ও দিকে। গায়ে চোট। মুখে এক রাশ ক্ষোভ, হতাশা, বিরক্তি। পছন্দের খাবার ফস্কে যাওয়ার তিক্ততাও।
বাঁদর মাটিতে পড়ে যেতেই বন্ধ করে দেওয়া হল জলকামান। খানিক ক্ষণ দেখে ফের মইয়ের দিকে রওনা দিল বাঁদরের দল। কিন্তু মাঝ-মইয়ে ফের সেই একই বিপত্তি। নাছোড় বাঁদরেরা কলা পেড়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেল আরও বেশ কয়েক বার। কিন্তু প্রতি বারই পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সইতে হয় দেখে এক সময়ে হাল ছেড়ে দিল তারা। দেখা গেল, জলকামান বন্ধ করে দেওয়ার বহু ক্ষণ পরেও মইয়ের দিকে আর চট করে এগোচ্ছে না কোনও বাঁদরই।
পরিস্থিতি এক সময়ে এমন দাঁড়াল যে, দলের মধ্যে এক বাঁদর ‘সাহস করে’ মইয়ের দিকে এগোতে গেলেও তাকে টেনে-হিঁচড়ে থামিয়ে দিচ্ছে বাকিরা! গবেষকরা বুঝলেন, ভয় বাসা বেঁধেছে বাঁদরদের মনে। যদি আবার প্রবল তোড়ে ঠান্ডা জল ধেয়ে আসে। যদি ফের আছাড় খেতে হয় মাটিতে। তার চেয়ে বরং কলা থেকে দূরে থাকাই ভাল। এই ভয় একেবারেই অমূলক নয়, বরং নিতান্ত স্বাভাবিক। যদি কিছু করতে গিয়ে বার বার, প্রতি বারই একই রকম আঘাত কিংবা যন্ত্রণা পেতে হয়, তবে অনন্তকাল সেই চেষ্টা আর চালিয়ে যাবে কত জন?
কিন্তু এই পরীক্ষার আসল মজা লুকিয়ে তার পরে! এ বার ওই ১০ বাঁদরের মধ্যে একটিকে চুপিসারে ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে তার বদলে নতুন একটি বাঁদরকে ঢুকিয়ে আনা হল ওই হলঘরে। গায়ে প্রবল বেগে আছড়ে পড়া ঠান্ডা জলের যন্ত্রণা সে তো জানে না। তাই কলার কাঁদি ঝুলতে দেখেই সে দৌড় লাগাল মইয়ের দিকে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে পৌঁছনোর আগেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি ৯ ‘পোড়খাওয়া’ বাঁদর। ভয় একটাই, ওই আনকোরা বাঁদর মইয়ে চড়লে যদি ফের সকলের দিকে জল ছিটকে আসে। অতএব, আগে রুখে দেওয়াই ভাল!
স্বাভাবিক। অতীতের তেতো অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কেউ চাইবেই বা কেন?
এ বার এক-এক করে বাকি নয় বাঁদরকেই বদলে দিলেন বিজ্ঞানীরা। প্রতি বার নতুন বাঁদর ঘরে ঢোকার পরে পুরনোদের একই প্রতিক্রিয়া। মইয়ের দিকে এগোলেই টেনে সরিয়ে আনা। একটা সময় এল, যখন ঘরে দশ বাঁদরই ‘নতুন’। অর্থাৎ, প্রথমে যখন মইয়ে উঠতেই সত্যিই প্রতি বার জল ছোড়া হচ্ছিল, তখন ঘরে ছিল না এদের কেউ। এরা এক-এক করে পরে ঢুকে শুধু দেখেছে, মইয়ের দিকে উঠতে গেলেই রে-রে করে তেড়ে এসে থামিয়ে দেয় পুরনোরা!
আসল চমক এখানেই। দেখা গেল, এর পরে ঘরে নতুন ঢোকা আর এক বাঁদর মইয়ের দিকে এগোতেই, একই ভাবে রে-রে করে তেড়ে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিচ্ছে ওই আগে থেকে ঘরে থাকা ‘নতুন’ বাঁদরেরাও! সত্যি করে জলকামানের ঠান্ডা স্রোতের সামনে যারা এক বারও পড়েনি! কেন?
এটিই অজানা ভয় বা ‘ফিয়ার অব আননোন’। কস্মিন্কালেও ঠান্ডা জলের অত্যাচার সহ্য না করা ওই বাঁদরগুলির পুরনোদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, নিশ্চয় ওই মইয়ে চড়তে গেলেই মারাত্মক কোনও অনর্থ ঘটে। তাই ঠিক কী ঘটে তা না জেনেও, তারা এমন সন্ত্রস্ত!
এই সার সত্যই তো একেবারে গুলে খেয়েছে এ-কালের হাড়হিম সন্ত্রাসের লাল চোখ দেখানো জঙ্গিরা! ফি বছর তাদের বুলেটে কিংবা বোমায় পৃথিবী জুড়ে যত মানুষের প্রাণ যায়, তার থেকে ঢের বেশি জন মারা যান স্রেফ অপুষ্টিতে, পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে না পেয়ে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির মতো নিতান্ত ‘চেনা অসুখ’ও প্রতি বছরে যত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তার পাশে হিংসায় মৃত্যুর সংখ্যা নস্যি। তবু বেশির ভাগ মানুষ আচমকা জঙ্গিহানাকে যতখানি ভয় করেন, অনেক প্রাণঘাতী অসুখও তাঁদের ততটা ভাবায় না। ততখানি ভয়ঙ্কর ঠেকে না পেটপুরে খেতে না পাওয়া। অন্তত প্রথম কিছু দিন।
কেন এমনটা হয়? এ নিয়ে গবেষণায় উঠে আসা তথ্য বলছে, কারণ একাধিক। প্রথমত, এই জাতীয় জঙ্গি-হামলার ঘটনা ঘটে হঠাৎ। অতর্কিতে নেমে আসে মৃত্যু। তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগই প্রায় মিলবে না, এই আতঙ্কই কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় হাঁটুতে। দ্বিতীয়ত, ঘটনার বীভৎসতা এবং দিনভর সংবাদমাধ্যমে তার ছবি-ভিডিয়ো-বর্ণনা-কাটাছেঁড়া। ভরা বাজারে, ভিড়ে ঠাসা বাসে কিংবা ঠেলাঠেলি ট্রেনে রক্তে মাখামাখি, ছিন্নভিন্ন লাশের মিছিল স্বাভাবিক ভাবেই মনে ভয় ধরায়।
কিন্তু এর বাইরে তৃতীয় কারণ অবশ্যই সেই ‘অজানা ভয়’। কখন কোথায় হঠাৎ কী ঘটে যায়, সেই প্রবল অনিশ্চয়তা। যে শপিং মলের রেস্তরাঁয় মোমের নরম আলোয় নিশ্চিন্তে ‘ডিনার’ সারছেন কেউ, তার পেটেই হয়তো কেউ রেখে গিয়েছে প্রাণঘাতী বোমা। ট্রেনের হালকা দুলুনিতে যখন চোখ লাগে-লাগে, তখনই হয়তো শুরু হল আচমকা বুলেট-বৃষ্টি। প্রাণ গেল বেঘোরে। এই অনিশ্চয়তার বীজ, এই অজানা ভয়ের বীজ ‘সযত্নে’ মনে গেঁথে দিতে পারে বলেও জঙ্গিহানা এত ভয়ঙ্কর।
কিন্তু ইদানীং দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই ‘অজানা ভয়’-এর চাষ কি আরও সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে রাজনীতির পাকা খেলোয়াড়দের হাতে। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের পরে সামনের ক’মাসে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। বছর ঘুরলেই লোকসভার ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এই ভরা ভোট-মরসুমে বাঁদরের এই পরীক্ষার কথা প্রায়শই মনে পড়ে। কারণ, দলীয় ইস্তাহারে, প্রচারের মাইকে নেতাদের চড়া গলার বক্তৃতায় সেই তো ‘অজানা ভয়’কেই উস্কে দেওয়ার চেষ্টা! প্রতি দিন, প্রতি বার! কোনও দল ঠারেঠোরে বোঝায়, ‘আমাদের ভোট না দিলে, এ দেশের দখল নেবে একটি বিশেষ সম্প্রদায়। অর্থাৎ, এই বেলা ভালয়-ভালয় ভোট না দিলে, বিপদ সংখ্যাগুরুদেরই! হিন্দু খতরে মে হ্যায়!’ আবার কোনও দল স্লোগান তোলে, ‘চুরি-দুর্নীতির অভিযোগ যতই উঠুক, ভোটটা শেষমেশ আমাদেরই দিয়ো বাপু! নইলে চরম দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে সংখ্যালঘুদের জীবনে! আমরা চলে গেলে, কে চালাবে এত সামাজিক প্রকল্প? তখন নির্ঘাত বন্ধ হয়ে যাবে ফি মাসে ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা ঢোকা। সুতরাং সাবধান!’
ভোট এলেই এমন ‘অজানা ভয়’-এর বেসাতি করা দেশের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রচারের অঙ্গ। হয়তো বা ভোটবাক্সে নিজেদের চিহ্নে ব্যালট-গুনতি বাড়ানোর পরীক্ষিত কৌশলও।
তবে কি ‘আমি’ ক্ষমতায় এলে কী করতে পারি, তা প্রচার কিংবা বিশ্বাস করানোর তুলনায় ‘আমি’ না এলে কী হবে, সেই ভয় ধরানো অনেক সহজ? ‘অজানা ভয়’-এর জোর কি সত্যিই এত বেশি? উত্তর গবেষকদের পকেটে। কে জানে, রাজনৈতিক দলগুলি হয়তো মনে করে যে, হাজার বিবর্তনেও আমাদের ‘বাঁদরত্ব’ পুরোপুরি ঘোচেনি। ছেড়ে যায়নি ‘অজানা ভয়’-এর জুজু। রাজনীতির কারবারিরা সে সুযোগ ছাড়বেন কেন!