২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটা মজার পরীক্ষা করেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তথ্য ও বিশ্লেষণ বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘দ্য আপশট’। ফ্লরিডার সম্ভাব্য ৮৬৭ জন ভোটারের উপর সমীক্ষা চালিয়ে প্রশ্নোত্তরের বিস্তৃত তথ্য তারা তুলে দিয়েছিল চার নামজাদা সমীক্ষক সংস্থার হাতে। অনুরোধ করেছিল ভোটের ফলের পূর্বাভাস করতে।
সমীক্ষায় কত শতাংশ মানুষ কাকে সমর্থন করছেন, সেটাই তো পূর্বাভাস হতে পারে না। কারণ, যাঁদের নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়, তাঁরা সব সময় ভোটারদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমানুপাতিক হন না। তাতে নানা ভাবে সামঞ্জস্য আনে সংস্থা। জনশুমারির তথ্যভান্ডার ও ভোটার তালিকার সাহায্য নেয়। জাতি, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষা, নিবাস, আগে কাকে ভোট দিয়েছেন ইত্যাদি তথ্যের ভিত্তিতে সমীক্ষার গুরুত্ব ঠিক করা হয়। কোনও কোনও সংস্থা রাশিবিজ্ঞানের জটিল মডেলেরও সাহায্য নেয়। সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতি কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা। ফলে বদলে যেতে পারে পূর্বাভাসও। ‘দ্য আপশট’-এর এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথিতযশা তিন সংস্থা তাদের পূর্বাভাসে হিলারি ক্লিন্টনকে এগিয়ে রেখেছিল, যথাক্রমে ৪, ৩ ও ১ শতাংশ ভোটে। অন্যটি আবার ট্রাম্পকে এগিয়ে রেখেছিল ১ শতাংশ ভোটে। অর্থাৎ, চারটি একই তথ্যের বিশ্লেষণভিত্তিক ফলাফলে নামকরা সংস্থার ৫ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য! প্রশ্ন হল, যদি সংস্থাগুলি নিজেদের মতো করে নমুনা-সংখ্যা ঠিক করত, সমীক্ষার প্রশ্নাবলি প্রস্তুত করত নিজেরাই, সমীক্ষাও চালাত, তা হলে ফারাক কতটা বাড়তে পারত? আমেরিকার মতো প্রধানত দ্বিদলীয় ব্যবস্থাতেই এই অবস্থা, আমাদের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্রে না জানি কী হবে! আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় তথ্য থেকে আসন সংখ্যার অনুমানে কতটা ভ্রম হতে পারে?
ভোটের পারদ চড়তে না চড়তেই সমীক্ষক সংস্থাগুলি হাজির রংবেরঙের অনুমানের পসরা নিয়ে। সেগুলো মূলত ভোট শতাংশ আর আসন সংখ্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার না আছে নমুনা সংগ্রহ বা তথ্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতির বর্ণনা, না আছে তথ্যের প্রয়োজনীয় সারসংক্ষেপ। সুতরাং, খুব সহজে তথ্যের দৃঢ়তা যাচাই করাও প্রায় অসম্ভব। জনমত সমীক্ষা তাই অনেক ক্ষেত্রেই স্ব-আরোপিত ভবিষ্যদ্বাণী। যদিও সেই ‘আকাশবাণী’ জানতে আমাদের ব্যগ্রতার অভাব নেই।
চার্চিল নাকি বলেছিলেন, ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ বলে কিছু হয় না, পুরোটাই ‘পাবলিশড ওপিনিয়ন’। আমরা ভুলে যাই, অধিকাংশ জনমত সমীক্ষাই কিন্তু বলেছিল যে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল টেনেটুনে জিতবে, তারা অনুমান করতে পারেনি এই বিপুল জয়। আবার, ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গেই বিজেপির ১৮টি আসন লাভের অনুমানে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ সমীক্ষা। গত কয়েক দশকে ওপিনিয়ন পোল মুখ থুবড়ে পড়েছে বার বার। দেশে ও বিদেশে। এর সাক্ষ্য দিতে পারতেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, এড মিলিব্যান্ড বা হিলারি ক্লিন্টন। ২০১৬-র আমেরিকার নির্বাচনে জনমত সমীক্ষার ভুল তো প্রায় সে দেশের লোককথায় ঢুকে পড়েছে! ২০২০ সালে আবার অধিকাংশ সমীক্ষাই বাইডেনের জয়ের পূর্বাভাস করেছিল। মজার কথা, শতাংশের হিসেবে এ বার ওপিনিয়ন পোলের ভুলের পরিমাণ মোটামুটি আগের বারের মতোই, বাইডেন জিতে যাওয়ায় বিশেষ সমালোচনা হয়নি, এই যা তফাত। ব্রিটেনে ২০১৫-র ভোট, ২০১৬-র ব্রেক্সিট গণভোট, ভারতে ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, এমনকি দিল্লির মতো ছোট ও শহুরে রাজ্যের বিধানসভাতেও জনমত সমীক্ষা বার বার দিগ্ভ্রান্ত হয়েছে। তা ভোটের এবং আসন্ন জয়-পরাজয়ের আঁচ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দিগ্ভ্রান্ত করেছে ভোটারদেরও।
খেয়াল করব, জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাসেও কী প্রচণ্ড রকমফের! সদ্যসমাপ্ত বিহার ভোটে কোনও এক সংস্থার আরজেডি-কে দেওয়া সবচেয়ে কম আসন ছিল ৭১, আর সবচেয়ে বেশি ছিল ১৯১! মোট আসন ২৪৩। বাকি সব পূর্বাভাস এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। আরজেডি-র পক্ষে কি এই সীমার বাইরে আসন পাওয়া সম্ভব ছিল?
ভোটের পূর্বাভাসের সঙ্গে বরং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের বেশ মিল আছে, দুটোর কোনওটাই নিখুঁত বিজ্ঞান নয়। ইজ়রায়েলের ভোটে নেতানিয়াহু-র জেতার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ আর আগামিকাল বৃষ্টির সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ, এই দুই পূর্বাভাসের মধ্যে চরিত্রগত মিল প্রচুর। বৃষ্টি না হলেও বলা যাবে যে, ৩০ শতাংশ এমন সম্ভাবনা তো ছিলই। ভোটের ফলের পূর্বাভাসও অনেকটা সেই রকমই। অমিলও রয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কথা শুনে তো আবহাওয়া চলে না। কিন্তু ভোটারেরা জনমত সমীক্ষা শোনেন, তাকে গুরুত্ব দেন, ‘পাবলিশড ওপিনিয়ন’-এ অল্পবিস্তর প্রভাবিতও হন। জনতার যে হেতু জয়ীর সঙ্গে থাকার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, তাই সমীক্ষায় এগিয়ে থাকা দলের জনপ্রিয়তার গাড়িতে সওয়ার হতে সেই পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেন অনেকেই। ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’-এর উল্টোটাও সত্যি, যাকে বলা হয় ‘আন্ডারডগ এফেক্ট’। পিছিয়ে থাকা প্রার্থী বা দলের পক্ষেও বইতে পারে সহানুভূতির হাওয়া। ২০০৮ সালে আমেরিকার ভোটে যেমন বারাক ওবামা আর জন ম্যাকেন দু’জনেই নিজেদের ‘পিছিয়ে পড়া’ দেখিয়ে সহানুভূতির ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন। জনমত সমীক্ষা কৌশলগত ভোটের সুযোগও করে দিতে পারে। বিশেষত, তৃতীয় পক্ষের ভোটাররা নিজেদের মূল দলকে সমর্থনের পরিবর্তে শীর্ষ দুই দলের কোনও একটিকে বেছে নিতে পারেন পছন্দমতো। এমন ‘স্ট্র্যাটেজিক ভোটিং’-ও আমরা বার বার দেখেছি। ২০১৪-র নেদারল্যান্ডস, ২০১৫-র কানাডা (জাস্টিন ট্রুডো-র অভাবনীয় জয়), ২০১৯ লোকসভার ভোটে পশ্চিমবঙ্গেও। কখনও আবার জনমত সমীক্ষা ভোটারদের নিরুৎসাহও করে দিতে পারে। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সমীক্ষায় বব ডোল-এর থেকে বহু এগিয়ে ছিলেন বিল ক্লিন্টন। অনেকেই ভোট দিতে উৎসাহ পাননি। ভোট পড়েছিল মাত্র ৪৯ শতাংশ, যা ৭২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পূর্বাভাস সাঙ্ঘাতিক ভুল হলে সমীক্ষক সংস্থাগুলি দোষ দেয় ভোটারদের ব্যতিক্রমী আচরণকে। কখনও নাকি ‘লাজুক’ ভোটাররা তাদের বিভ্রান্ত করেছেন, কখনও ‘অলস’ ভোটাররা ভোটের দিন বুথ পর্যন্ত যাওয়ার উৎসাহ পাননি। কিন্তু, সমীক্ষকদের তো এ সব হিসেব দেখেই বিশ্লেষণ করা উচিত। প্রশ্ন উঠবে আরও। সমীক্ষকেরা কি সাধারণ ভাবে তাঁদের পরিকল্পনা, নমুনা সংগ্রহ, তথ্যের বিশ্লেষণ যথাযথ রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্ব মেনে করেন? তাঁদের নমুনা সংখ্যা বা ‘স্যাম্পল সাইজ়’ কী ভাবে ঠিক করা হয়? নমুনা কি ‘র্যান্ডম’ বা যথেচ্ছ? তা কতখানি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ? সংগৃহীত তথ্যের সামঞ্জস্য সাধিত হয় কী ভাবে? কী ভাবে হিসেব হয় ভোট থেকে আসনের? যে বিপুল সংখ্যক মানুষ সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, সেই সামঞ্জস্য বিধানই বা কী করে সম্ভব? এত সব অস্পষ্টতা ভোটের পূর্বাভাসকে আরও ধোঁয়াশায় ভরিয়ে তোলে। তাই সমীক্ষা হয়ে ওঠে প্রায়-দৈববাণী।
তবু এ কথা ঠিক যে, প্রাক্-নির্বাচনী এবং বুথফেরত সমীক্ষা আমাদের ভোট-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়েই। এ সব বাদ দিলে ভোটের উত্তেজনা হয়তো অর্ধেক মাটি হয়ে যাবে। আবার এও ঠিক যে, অজস্র ভুল ও অস্পষ্টতা সত্ত্বেও জনগণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলছে এই সবকে। বুথফেরত সমীক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা কম, তা আর যা-ই হোক ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু জনমত সমীক্ষা বিষয়টাকে কিছুটা অনুশাসনের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার সময় বোধ করি হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতির খুঁটিনাটি জানানো বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবা যেতে পারে। বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে নানা দিক থেকে তথ্যের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করাও। নইলে স্ব-আরোপিত ‘আকাশবাণী’ কিন্তু ভোটকে প্রভাবিত করতেই থাকবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা