নির্বাচন নিয়ে কথা চলছে সংবাদমাধ্যম থেকে সমাজমাধ্যমে। এ বারের ক্ষমতার দাবিদার নতুন— বিজেপি। নির্বাচনী প্রচারের বিষয়ও নতুন, বিজেপির ক্ষেত্রে ‘তোলাবাজ ভাইপো’, তৃণমূলের ক্ষেত্রে ‘বহিরাগত’। এত অন্তঃসারশূন্য বিষয় নিয়ে দুই প্রধান দল লড়ছে, এমনটা আগে দেখা যায়নি। ১৯৭৭ ও ২০১১, গত যে দু’টি বিধানসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে পরিবর্তন এসেছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচার ছিল অনেক জোরদার, জীবনের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। এমনকি গত বিধানসভা নির্বাচনেও সারদা-নারদের মতো বিষয় ছিল। ‘তোলাবাজ ভাইপো’ প্রচারের ভিত্তি কী তা জানা নেই, আর এই দেশে কবে কোন দলের সব রাজনৈতিক নেতা সততার পরাকাষ্ঠা ছিলেন তাও অজানা। উল্টোটা শুনতে চাইলে আসমুদ্রহিমাচল অজস্র গল্প পাওয়া যাবে। ‘বহিরাগত’ নিয়ে এত মাতামাতি কেন তাও জানি না। ছোটবেলায় দেখেছি ‘আমরা বাঙ্গালী’ নামে একটি দল ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডে আলকাতরা লাগাত। সেই কাজ আদৌ প্রশংসনীয় ছিল না। ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সুচেতা কৃপালনী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত। তিনি বিবাহসূত্রে কৃপালনী, জন্ম বাঙালি পরিবারে। বহিরাগত তত্ত্ব মানলে তো তাঁকে সে পদে বসানো অন্যায় হয়েছিল বলতে হয়!
বিজেপির প্রচারের আরও একটা বিষয় আছে, যা তাদের কথা থেকে বেরিয়ে আসে। তা হল, বিজেপি-শাসিত গুজরাত কত ভাল আছে, আর তৃণমূল ও একদা বাম-শাসিত বাংলার মানুষ কত খারাপ আছে। রাজনীতির লোকেরা তাঁদের ক্ষমতাধীন অঞ্চলের উৎকর্ষ দাবি করে অন্য অঞ্চলের মানুষের আস্থা বা মন জয় করতে চাইবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ও বিজেপি-বিরোধীদের কথাতে যা বলা হচ্ছে তার অর্থ, বিজেপি ও গুজরাত সমার্থক। কেউ বলছেন ‘বাংলাকে গুজরাত বানাব’, কেউ বলছেন ‘বাংলাকে গুজরাত হতে দেব না’। এ দেশে বিজেপি সরাসরি রাজ্য সরকারে আছে বারোটি রাজ্যে, যার একটি গুজরাত। বিজেপির জন্ম গুজরাতে নয়, দিল্লিতে। তাদের মতাদর্শগত গুরু আরএসএস-এর জন্মও গুজরাতে নয়, নাগপুরে। ভারতে প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীও গুজরাতে নয়, রাজস্থানে। ভৈরোঁ সিংহ শেখাওয়াত মুখ্যমন্ত্রী হন ১৯৯০ সালে, বিজেপি গুজরাতে প্রথম ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর আগে।
কাজেই বিজেপির শাসনে কী ভাল হতে পারে তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের কথা আসা স্বাভাবিক, কিন্তু তা শুধু গুজরাতে আটকে রাখা ঠিক নয়। তুলনা যদি করতেই হয়, কমবেশি বারোটি রাজ্যের সঙ্গেই করতে হবে। আসলে এ রাজ্যে বিজেপি একটা মিথকে হাতিয়ার করতে চাইছে: বিজেপি মানে নরেন্দ্র মোদী, মোদী মানে সোনার গুজরাত, অতএব বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলা হবে সোনার বাংলা। অবশ্য যাঁরা বিজেপি-কে চাইছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের মনোভাব আসলে এমন, যে খুশি আসুক কিন্তু তৃণমূল যাক।
এই বারোটি রাজ্যের মানুষ বাংলার তুলনায় কতটা ভাল আছেন? বিজেপি-শাসিত তিনটি রাজ্যের স্বাস্থ্য বরাদ্দ পশ্চিমবঙ্গের থেকে বেশি— মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশ। একটা ধারণা আছে, পশ্চিমবঙ্গ মানেই বেকারত্ব। অনেককেই এ রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে হয় রুটি-রুজির আশায়। কিন্তু বাংলাতেই শুধু কাজের হাহাকার, বাকি (বিজেপি-শাসিত) রাজ্যে অবস্থাটা অন্য? তথ্য কিন্তু তা বলছে না। একমাত্র গুজরাত ছাড়া বাকি সব বিজেপি-শাসিত রাজ্যের থেকে বাংলায় বেকারত্বের হার কম। কোন রাজ্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের কত শতাংশ ব্যয় করে, তার তালিকা করলে সবচেয়ে নীচে যে রাজ্যের দেখা মিলবে তার নাম গুজরাত। বোঝাই যাচ্ছে, কাজের সূচকে গুজরাত সবচেয়ে উপরে থাকলেও সেই কাজের অনেকটাই কায়িক শ্রমের কাজ। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে সে রাজ্যের ভাগ্যে অনেক বেশি প্রকল্প মেলে। এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি। গুজরাতের ভাগ্যে এটা বহু কাল মিলেছে। সেখানে বেশি শিল্প হয়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এটাই একমাত্র বিচার্য হলে তো সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করতে হয়, আলাদা ভাবে কোনও রাজ্য সরকারের জন্য নির্বাচন করারই মানে থাকে না।
অপরাধের নিরিখেও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির অবস্থা করুণ। সরকারি ভাষায় যাকে বলে ‘রেট অব কগনিজ়েবল ক্রাইম’, সেই সূচকে তিনটি বিজেপি-শাসিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভাল— অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা ও মণিপুর। বাকি ন’টি রাজ্যেই অপরাধ অনেক বেশি, এদের মধ্যে প্রথম হরিয়ানা, দ্বিতীয় সেই গুজরাত।
ভারতে স্বাধীনতার পর থেকেই একটা ব্যাপার হয়ে আসছে, একটি বা কয়েকটি শ্রেণির উন্নতি, বাকিদের দুরবস্থা। এ রাজ্যে উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই ব্যবধান অন্য অনেক জায়গার থেকে অনেক বেশি। অনেকগুলি মানবিক পরিষেবার ক্ষেত্রে গুজরাত ভয়াবহ ভাবে পিছিয়ে। ভোট দেওয়ার সময় তাই ভাবা দরকার। মরীচিকার পিছনে ছুটলে ভবিষ্যতে অশান্তি আরও বাড়বে।