একশো দিন হল ওঁরা প্রতিবাদ করছেন। সেই এক বছর আগের শাহিন বাগ দেখেছিল এক প্রতিবাদী উন্মাদনা। পঞ্জাব থেকে জাঠা এসেছিল। এসেছিলেন মহিলারা। সহমর্মিতার তাগিদে, হাড়-কাঁপানো ২০১৯-২০’র শীতে অন্ন-বস্ত্রের জোগান নিয়ে। দুটো ভিন্ন সম্প্রদায় পাশাপাশি এসে বুঝে নিয়েছিল জীবনধর্ম। আর এই বছর— এনআরসি-সিএএ’র মতো কৃষি আইন একতরফা ভাবে পাশ হয়ে যেতেই ফুঁসে উঠল পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকসমাজ। মাস দুয়েক বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ কর্মসূচির পর তাঁরা নিশানা করলেন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল রাজধানীকে। ‘দিল্লি চলো’। প্রায় মাস ছয়েকের খাদ্যসংস্থান নিয়ে হাজার হাজার ট্র্যাক্টর রওনা দিল হাইওয়ে ধরে। ক্ষমতার নাকের ডগায় দৃশ্যমান হতে হবে। আগুয়ান কৃষকদের অভ্যর্থনা জানাতে বর্ডারে এগিয়ে এলেন সাবেক দিল্লিবাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ফিরিয়ে দিল শাহিন বাগের সৌজন্য। গুরুদ্বারগুলো যেমন ফেব্রুয়ারি ২০২০-র হিংসাকবলিত মানুষের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল, ঠিক তেমনই আজ এগিয়ে এল লঙ্গর ব্যবস্থাপনায়। গণ-উৎসবের চেহারা নিল দিল্লি প্রান্তে সিংঘু, টিকরি, গাজ়িয়াবাদ বর্ডার।
অবস্থানের শুরু ২৬ নভেম্বর ২০২০। কনকনে শীতের রাতে তাঁবু খাটিয়ে, আগুনের তাপে শরীর সেঁকে একবগ্গা কৃষক জায়গা করে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। জলকামান তোয়াক্কা না করে উন্মুক্ত শরীরে শৌর্যধারী শিখ হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। দফায় দফায় আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে। অনড় কৃষক মোর্চার নেতারা। প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রতিরোধে শামিল বয়স্ক বেশ কয়েক জন ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে। আবেগতাড়িত হয়ে আন্দোলন কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।
এর মধ্যেই ঘটে গিয়েছে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস। অনমনীয়, অনুশোচনাহীন সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ব্যারিকেড বাধা পেরিয়ে শয়ে শয়ে কৃষক ট্র্যাক্টর ঢুকে পড়ল রাজধানীর বুকে। রাজার হাত থেকে প্রজা ‘তন্ত্র’ অধিকার কেড়ে নিতে গেলে যে বিশৃঙ্খলা হয়, সেটাই হল। মুখিয়েই ছিল গণমাধ্যমগুলো, যে টেকনো-কর্পোরেট যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে এই নয়া ব্যবস্থা, তার অনেক ক্ষমতা। ছবি উল্টে গল্পও পাল্টানো যায়। শাহিন বাগকে পাকিস্তানি বলার মতো কৃষক আন্দোলনকে খলিস্তানি বলার ছিল এই মোক্ষম সুযোগ। গুলিয়ে দেওয়া হল হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ বৃহত্তর কৃষকসমাজের অংশগ্রহণকে। চেষ্টা করা হল ফিরিয়ে আনতে ১৯৮৪-র শিখ-বিরোধী আবেগ। জনমত ঘুরিয়ে দেওয়ার এই মুহূর্তে অবস্থান মঞ্চগুলো হটিয়ে দেওয়ার রাতভর পরিকল্পনা চলল। অনেকটাই ছত্রখান হয়ে যাওয়া ধর্না মঞ্চগুলো সারারাত আগলে রাখলেন কৃষক নেতৃত্ব। যে পুরুষালি শৌর্যে আমরা জাঠ কৃষকের ছবি এঁকেছি, তা ভেঙে খানখান হয়ে গেল কৃষকনেতা রাকেশ টিকায়েতের কান্নায়। হাড়হিম শীতের রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশঙ্কায় কেটেছে ২৭, ২৮ জানুয়ারির রাত। ক্রোধ আর কান্না মিলেমিশে আবারও উত্তাল করে তুলেছে কৃষকসমাজকে। এ যেন এক সামাজিক দায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে রাষ্ট্রসেবকের আক্রমণ নেমে আসে, তাদেরই দেখা গেল দিল্লির বর্ডারে কৃষকের পাশে। জনবাদী মহিলা সমিতির অক্লান্ত পরিশ্রমে পুরুষ-অধ্যুষিত কৃষক জমায়েতে কৃষক মেয়েদের এসে দাঁড়ানো, এক অন্য মাত্রা এনে দিল এই প্রতিরোধকে।
সিংঘু, টিকরি, গাজ়িয়াবাদ— এই তিন সীমান্ত যেন পিছু ছাড়ছে না ‘সীমান্ত রাজনীতি’-প্রিয় বর্তমান শাসকের। ফ্যাসিস্ত ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে দুর্গ নির্মাণের দৃশ্য। হাইওয়ে খুঁড়ে সিমেন্টের ঢালাই ভরে ব্যারিকেড কাঠামোর সঙ্গে লম্বা লম্বা লোহার পেরেক পুঁতে অভূতপূর্ব এক রক্ষণবেষ্টনী দিয়ে দেশের রাজধানীকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নেট কানেকশন দিনের পর দিন কেটে রেখে নয়া কায়দার অবদমনে আমাদের নিশ্ছিদ্র ‘সুরক্ষা’র দায় নিয়েছে রাষ্ট্র। অন্য দিকে, নাছোড় সংযুক্ত কৃষক মোর্চা দেখিয়ে দিচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিকল্প স্বরগুলোর গুরুত্ব। সংসদে সংখ্যার গুরুত্বের বাইরেও বিশাল এই দেশে কখনও নাগরিকত্ব, কখনও শ্রম আইন অথবা কৃষি আইনের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ উঠবেই। আপাত নিরবচ্ছিন্ন অতিমারির জীবনযাপন, গণপরিসর সঙ্কোচনের দুঃসহ সময়ে এটাই মনে হয় পাওনা। বন্ধু কবি অমিতাভ দেব চৌধুরী বছরখানেক আগে ক্রান্তদর্শী কয়েকটা লাইন পাঠিয়েছিলেন: “চলুন, একটা খেল খেলি/ আপনি বর্ডার পুলিশ/ আর আমি বিদেশি/ এইবারে আমি লুকোবো/ আর আপনি আমাকে খুঁজবেন। ভাববেন না খেলাটা অতটা সহজ/ আমি কিন্তু যেখানে সেখানে/ লুকোবো না/ লুকিয়ে পড়ব এক্কেবারে/ ইতিহাসের পাতায়, কেমন?...”
বর্ডার মানে এখন তো দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা শুধু নয়। শহরপ্রান্তে, পাড়ায় পাড়ায় বর্ডার; বাড়ি ঘিরে রেখেছে বর্ডার; মানুষে মানুষে বর্ডার।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়