—প্রতীকী ছবি।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখা শুরু করি। কয়েক দিন আগে আমার এক বন্ধু ফেসবুকে একটা লেখা তাঁর নিজের বলে চালিয়ে দিলেন। ঘটনা হল, সেই লেখাটি আমাদের পরিচিত— অন্য আর এক বন্ধুর লেখা। কাজেই, তাঁর এই কুম্ভিলকবৃত্তি দেখে আমরা বেশ কয়েক জন সমস্বরে প্রতিবাদ করি, সবাইকে এই ঘটনাটির কথা জানাই। স্বভাবতই, এই কাজটিও আমরা সমাজমাধ্যমেই করি। সেই ‘বন্ধু’টি অবশ্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা প্রকাশ করলেন না। কোনও সময় নষ্ট না-করে তিনি আমাদের সবাইকে ‘আনফ্রেন্ড’ করে দিলেন। তাতে যে আমরা খুব মর্মাহত হয়েছি, তা অবশ্য নয়। নিজেদের মধ্যে খানিক হাসাহাসি করে আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম— আমাদের এই সদ্যবিচ্ছিন্ন বন্ধুটি খুব শিগগির রাজনীতিতে নামবেন, আর নির্ঘাত সফল হবেন। হয়তো আমাদের পরিচিতদের মধ্যে আমরা এক জন মন্ত্রী পেতে চলেছি— কে বলতে পারে? রাজনীতিতে সফল হওয়ার সমস্ত গুণই তিনি প্রদর্শন করে ফেলেছেন, এ বার অফারটি পেলেই হয়!
ছোটবেলা থেকে শুনেছি যে, ধরা না-পড়লে চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা। কিন্তু, ধরা পড়লে এক গাল মাছি। আমাদের এই কুম্ভিলক বন্ধুর এখন সেই অবস্থা— অনুশোচনা প্রকাশ করুক বা না-করুক, লজ্জাশরম আছে— ফেসবুকের বন্ধুতালিকা থেকে আমাদের বাদ দিতে হয়েছে মুখ লুকানোর জন্য। তবে, প্রবাদবাক্যটি যে এখনও সব ক্ষেত্রেই সত্যি, সে কথা বলতে পারি না। ইদানীং খবরের কাগজ খুললেই যে সব চুরির কথা দেখতে পাই, তার প্রধান কুশীলবদের আজ অবধি লজ্জিত হতে দেখিনি। আর, সেই কুশীলবদের পিছনে যাঁর আশীর্বাদী হাত থাকে? অন্য একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ছে, যাতে ‘বড় গলা’ সংক্রান্ত কিছু কথা আছে।
তবে, চুরি ধরা পড়ে গেলে যে শুধু চোরই লজ্জা পাবে, তা কিন্তু নয়। এক পরিচিত ভদ্রমহিলা তাঁর নিজের বেডরুমেই ঢুকেছিলেন। দেখলেন, তাঁর গৃহ-সহায়িকা আলমারির পাল্লা খুলে হাতসাফাই করতে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ জিভ কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কারণ, গৃহ-সহায়িকা যদি জেনে যান যে গৃহকর্ত্রী তাঁর এই কাণ্ডটি দেখে ফেলেছেন, তা হলে তিনি পর দিন থেকে আর কাজে আসবেন না। তাতে কর্ত্রীর গুরুতর বিপদ। অতএব, চুরি দেখেও না-দেখার ভঙ্গিটিই নিরাপদ পলায়নপন্থা। ভেবে দেখলে, এই ‘কিছুই না-দেখা’র নীতি কি আমরা সবাই অনুসরণ করছি না? কত ছোট-বড় চুরি-ডাকাতি-রাহাজানিই তো দেখেও দেখি না— আর, সেই অপকীর্তিগুলির অধিকাংশই যাঁদের, তাঁরা ক্ষমতায় সামান্য গৃহ-সহায়িকার চেয়ে অনেক উপরে।
এক জন ব্যক্তি কেন চুরি করেন, তার অনেক কারণ থাকে। সেই কারণগুলোর একটা বড় অংশ আর্থিক; কিন্তু কিছুটা মনস্তাত্ত্বিকও বটে। আর্থিক কারণগুলো আমাদের সকলের জানা— কারও যদি মনে হয় যে, তিনি আর্থিক ভাবে সচ্ছল নন, তা হলে তাঁর হয়তো বাড়তি কিছু আয়ের প্রয়োজন পড়তে পারে। সৎ পথে আয় যদি করা না যায়, তা হলে অসদুপায়ে কিছু রোজগার করার চেষ্টা করাটা খুব চোখে পড়ে। তাই আর্থিক অসাচ্ছল্য সদুপায়ে কিছু রোজগার করার থেকে বিচ্যুতির একটি কারণ, সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। কিন্তু এটাও বলে রাখা দরকার যে, যত মানুষ আর্থিক কষ্টে আছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু অসদুপায় অবলম্বন করেন না; তাঁদের একটি বেশ বড় অংশ যথেষ্ট সৎ। তাঁরা নিজেরা সৎ পথে যতটা আয় করেন তাতেই সম্মানের জীবন যাপন করেন। তাঁদের জীবনে মূল্যবোধের একটি জায়গা আছে, এবং তাঁরা সারা জীবন মূল্যবোধ নিয়েই চলেন।
সমস্যা হল তাঁদের নিয়ে, যাঁরা আর্থিক ভাবে যথেষ্ট সচ্ছল, কিন্তু দুর্নীতি বা চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। আর্থিক অসাচ্ছল্য দিয়ে তাঁদের এই অনৈতিক আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় না। তা হলে কি মূল্যবোধের অভাব? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু শুধু কি মূল্যবোধের অভাবটাই একমাত্র কারণ? এখানেই অন্য একটি দিক তুলে ধরা প্রয়োজন। সেই কারণটি কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণমূলক। আচরণমূলক দিকটিতে ঢোকার আগে অর্থনীতির একটি সহজ তত্ত্বের কথা বলি, যা অর্থশাস্ত্রের একেবারে প্রাথমিক পাঠক্রমের অংশ— ‘মোর ইজ় বেটার’, অর্থাৎ যত বেশি পাওয়া যায়, তত ভাল। এই অন্তহীন বাসনা অর্থশাস্ত্রের অকৃত্রিম চালিকাশক্তি। ‘আরও চাই, আরও চাই’ এই তত্ত্ব দিয়েই অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়, এমনকি এক জন সচ্ছল ব্যক্তির চৌর্যবৃত্তি পর্যন্ত। ‘ইকনমিক্স অব করাপশন’ বা ‘দুর্নীতির অর্থনীতি’ নিয়ে অজস্র গবেষণা হয়েছে। কিছু তাত্ত্বিক, গাণিতিক; কিছু তথ্যনির্ভর। বিষয়টি জটিল, এবং এর সমস্ত আঙ্গিক একটি প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমি ‘চৌর্যবৃত্তি’ সংক্রান্ত একটি আচরণমূলক আঙ্গিক নিয়ে কথা বলব।
ধরা যাক এক জন ব্যক্তি আর্থিক ভাবে সচ্ছল, কিন্তু তাঁর জীবনে কিছু না-পাওয়া বা অতৃপ্তি আছে। এই অতৃপ্তি তাঁর পেশা সংক্রান্ত বিষয়ে হতে পারে, বা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত বা তাঁর গবেষণাতে ব্যর্থতা সংক্রান্তও হতে পারে। অর্থাৎ, যা তিনি হতে চেয়েছিলেন তা হতে পারেননি, কিন্তু বর্তমানে তাঁর আর্থিক কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সেই অতৃপ্তি তাঁকে কুরে-কুরে খায়— হয়তো সমাজ থেকে যে শ্রদ্ধা বা স্বীকৃতি চেয়েছিলেন তা পাননি, সমাজের চোখে কৃতি বা ‘এলিট’ হয়ে উঠতে পারেননি। এমন মানুষরা অনেক সময় মূল্যবোধহীন হয়ে পড়েন, এবং ব্যক্তিগত না-পাওয়া থেকে হিংস্র হয়ে, ভাগ্য বা সমাজের উপর আক্রোশ থেকে সমস্ত কিছু কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘আরও চাই, আরও চাই’ মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন।
একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে— প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেই যে সমাজে সম্মান পাওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। অর্থাৎ সমাজে ‘স্টেটাস’ সব সময় পয়সা বা ক্ষমতা দিয়ে পাওয়া যায় না। তাই অনেক সচ্ছল ধনী মানুষকেও দেখা যায় শুধু স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ক্ষমতাধারী গোষ্ঠীর পদলেহন করতে। নিজ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিতেও তাঁরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না।
ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতা থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়ার মানসিকতার একটি নিকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ হল ‘দুর্নীতি’ বা ‘চৌর্যবৃত্তি’। সমস্যা হল, একটি বিরাট অতৃপ্ত জনগোষ্ঠী যদি চৌর্যবৃত্তির গণতান্ত্রিক স্বীকৃতির কারণ হয়ে ওঠে, তখন চৌর্যবৃত্তি হয়ে ওঠে মহাবৃত্তি— অধ্যয়নের জলাঞ্জলি, সামাজিক অধঃপতন সম্পূর্ণ।
এর ব্যাখ্যা তথাকথিত অর্থনীতি দিয়ে সম্ভব নয়, ‘আচরণমূলক মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি’ ছাড়া গতি নেই। আচরণমূলক অর্থনীতিতে আরও একটি ধারণা আছে, যাকে বলে ‘ইনিকুইটি অ্যাভারশন’ বা অসাম্য থেকে অতৃপ্তি। এই তত্ত্ব দিয়েও চৌর্যবৃত্তির কিছুটা ব্যাখ্যা করা যায়— তবে, এই অসাম্য আর্থিক নয়, খ্যাতি বা স্বীকৃতির অসাম্য, ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার অসাম্য। আর্থিক সাচ্ছল্য সত্ত্বেও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এই মনস্তাত্ত্বিক অসাম্য ও অতৃপ্তি ঘোচানোর চেষ্টাও এক ধরনের মহাবৃত্তি, যদি না-পড়ে ধরা।