Caste Census

জাতিগণনায় ভয় পান কারা

একটা আপত্তি হাওয়ায় ভাসছে— জাতিগণনা হলে নাকি জাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ বৃদ্ধি পাবে। কথাটা এতই সারবত্তাহীন যে, তা নিয়ে আলোচনা বাহুল্য।

Advertisement

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৩৭
Share:

—ফাইল চিত্র।

আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও তার কল্যাণমূলক কর্মসূচির ভিত্তিই হল নাগরিকের জীবন ও জীবনযাত্রার বিভিন্ন তথ্য-সঙ্কলন ও তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাষ্ট্রের সমস্ত উন্নয়নমূলক নীতি-প্রকল্প সেই তথ্যের উপরই নির্ভরশীল হওয়ার কথা। তা হলে যে জাতিব্যবস্থার দ্বারা আজও বহু মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্পর্ক, রোজগার, পদোন্নতি, জমির মালিকানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সুযোগ নির্ধারিত, তার হিসাব কষতে রাষ্ট্রের এত আপত্তি কেন? কার সুবিধা হয় এই গণনা না হলে?

Advertisement

একটা আপত্তি হাওয়ায় ভাসছে— জাতিগণনা হলে নাকি জাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ বৃদ্ধি পাবে। কথাটা এতই সারবত্তাহীন যে, তা নিয়ে আলোচনা বাহুল্য। আসল ভীতিটা অন্যত্র— যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়! যদি গণনায় প্রমাণিত হয় যে, অতি সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণ এখনও রাজ করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ পিছিয়ে পড়া মানুষের উপরে? তা হলে আবার নতুন করে রাষ্ট্রসিদ্ধ অধিকারের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে পদদলিত মানুষের জন্য। উঠবে সংরক্ষণ বিস্তারের দাবি— রাজনীতিতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কর্মক্ষেত্রে। বিহারে নীতীশ কুমার রাজ্যের জাতিগণনার তথ্য প্রকাশ করে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মুহূর্ত ও কম্পন সৃষ্টি করেছেন। তা প্রমাণ করে দিয়েছে, বিহারের পঁচাশি শতাংশ মানুষ, সাংবিধানিক ভাবে চিহ্নিত পিছিয়ে থাকা মানুষের দলভুক্ত।

এখনও তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থা, ব্রাহ্মণ-বানিয়া-ঠাকুর সম্প্রদায়ের থেকে তাঁরা ঠিক কতটা পিছিয়ে, সেই নথি প্ৰকাশের অপেক্ষায়। সে তথ্য সামনে এলে, ব্যবধানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও প্রকট হবে। কাজেই, জাতিগণনা না হলে কাদের সুবিধা, সেটা খুবই স্পষ্ট। সেই পনেরো শতাংশের সমষ্টি— যাঁরা রাজ্য, বাণিজ্য, পুঁজি, শিল্প ও সংস্কৃতি পরিচালনা করেন, বা করে এসেছেন সহস্র বছর ধরে— তাঁদের। শাসক, শোষক বা ক্ষমতাশীল— কেউই স্বেচ্ছায় বা কল্যাণার্থে বল, পদ এবং অধিকার ছাড়ে না। যে কারণে সংবিধানকে বিশেষ অধিকার দিতে হয়, উৎপীড়িত মানুষের রক্ষার্থে। সেটাই আধুনিকতার অন্যতম প্রতিশ্রুতি— পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়কে সমান আসনে আনার সঙ্কল্প।

Advertisement

সেই স্বীকৃতি ও প্রয়াসের আর এক নাম সংরক্ষণ। যাঁরা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের প্রয়াসকে খাটো করেন ‘কোটা’ বলে, তাঁরা বুঝতে চান না যে, মেধা জন্মগত বা জন্মসিদ্ধ নয়, তা বহুযুগীয় সামাজিক সুবিধার উৎপাদন। সেই প্রাধিকারের মূলে ছিল, এবং আছে, শিক্ষার উপরে উচ্চবর্ণের একচেটিয়া অধিকার। এবং সেটা নিম্নবর্গকে বঞ্চিত করেই। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে, তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের প্রগতির উৎস হল সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক সংহতি। তাঁদের প্রতিরোধের মূলে রয়েছে ঐতিহাসিক উৎপীড়নের সচেতনতা, সমান-ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে তাঁদের রাজনীতিকরণ। ফলত, কিছু মাত্রায়, যা ছিল অসংযত ও আরোপিত শারীরিক ও সামাজিক ব্যবধান ও নিপীড়ন, তা আজ রূপান্তরিত হয়েছে আইনসিদ্ধ দাবিতে। সেই প্রতিরোধ ও সাম্যের দাবি আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই জানা প্রয়োজন বিভিন্ন জাতির আর্থসামাজিক অবস্থান।

উন্নয়ন-প্রকল্পের কতটা অংশ তাদের ভাগে পড়েছে, সেই তথ্য পাব কোথায়, যদি জাতিভিত্তিক গণনা না হয়? জাতিগণনা হলেই যে জাতিভেদ উধাও হয়ে যাবে, তেমনটা নয়। কিন্তু জাতিগত সাম্যের দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব, যত ক্ষণ না সামাজিক অসাম্যকে সংখ্যা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, প্রদর্শিত বা প্রমাণিত করার জন্য তথ্যাবলি রচিত হচ্ছে। না কি, অসাম্য ব্যাপারটা উচ্চবর্ণের এতটাই মজ্জাগত যে, সমান হতে তাদের এত সামাজিক আপত্তি? জাতিগত বাস্তবিক আর্থসামাজিক ব্যবধানগুলো প্রকট হলে ধর্মের নামে, অপর-ধর্ম-বিরোধী রাজনীতি করতে অসুবিধা হবে কেন্দ্রীয় শাসক দলের? ভুললে চলবে না, রাম রথের চাকা কিন্তু এই বিহারেই আটকে গিয়েছিল ১৯৯০-এর অক্টোবরে— লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা রুখে দিয়েছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। মণ্ডলে মাত হয়েছিল মন্দিরের রাজনীতি।

ওবিসি রাজনীতি জাতিকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে— জাতিভেদ উদ্‌যাপনের স্বার্থে নয়, বরং তাদের প্রান্তিকতা জাহির করতে। ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের মূলে রয়েছে সম্প্রদায়ের সংখ্যার জোর, আর সেই সংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য দাবি— বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চে বা কর্মক্ষেত্রে। সেটি একমাত্র সম্ভব তথ্যের ভিত্তিতে, অনুমান বা আবেগের ভিত্তিতে নয়। আবার এ-ও ঠিক যে, সুবিধা হাতে পেলে তা কেউই বিতরণ করতে চায় না। তৈরি হয় ‘ক্রিমি লেয়ার’— অর্থাৎ পরিবার ও সম্প্রদায়ের ভিতরে প্রাপ্ত অধিকার কেন্দ্রীভূত করে রাখার প্রবণতা, যা ন্যায়বিস্তার বিমুখ। তবুও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে থাকা কোনও মানুষ, জাতিগণনার বিরোধী হতে পারেন না। কেবল নাগরিক স্বীকৃতি, ভোটাধিকার ও সংরক্ষণ পর্যাপ্ত নয় নিম্নজাতির প্রগতির স্বার্থে। কোনও রাষ্ট্র তার বঞ্চিত-নিপীড়িত বর্গের সার্বিক উন্নতি অবজ্ঞা করে অগ্রসর হয়নি। হলেও, তা হয়েছে মানবিকতার স্বার্থ উলঙ্ঘন করে। আধুনিক সমাজ-চেতনা ও রাষ্ট্রনীতির মূলে রয়েছে সামুদায়িক চিন্তা ভাবনা। জাতি— যা এখনও সমাজের অন্যতম মূল স্তর ও কাঠামো— তাকে আরও বিস্তারে জানতে এত ভীতি কিসের?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement