নির্বাচন এলে বঙ্গ রাজনীতির অবনমন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে
Politics

প্রশ্নটা রাজনীতির আদর্শের

কোনও এক সমাজমাধ্যমে দেখলাম এক জন জনপ্রিয় তরুণী গায়িকা জানাচ্ছেন যে, তিনি জনৈক বলিউডের গায়িকার মতো সুন্দরী হতে পারেন না, কারণ তার জন্য প্রয়োজন তাঁর রূপচর্চায় আরও কয়েকগুণ অর্থ ব্যয়।

Advertisement

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৪ ০৮:৩৩
Share:

—প্রতীকী ছবি।

কয়েক দিন আগে এক সন্ধ্যায় একটি রাজনৈতিক দলের পথসভা দেখছিলাম। ছোট মঞ্চ, জনা তিন-চার বসতে পারেন, সামনে গোটা কুড়ি চেয়ার। বক্তা ছাড়া তিন জন মঞ্চে আসীন। এঁরা স্থানীয় কমিটির বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, দলের একেবারে আঞ্চলিক ছোট নেতা। এক-এক বক্তার ভাষণের পর মঞ্চে আসীন কেউ কেউ নেমে যাচ্ছেন, নতুন কাউকে ডেকে নেওয়া হচ্ছে। মঞ্চে কিছু ক্ষণ থাকা মানে কিছুটা গুরুত্ব অর্জন। এ বার এক তরুণীকে ডেকে নেওয়া হল, একটু পরে বলবেন তাও ঘোষণা হল। তখনও বেশ ঠান্ডা, তরুণীর পরনে একটা সাধারণ সালোয়ার, গায়ে একটি পুরনো সাধারণ গরম চাদর, পায়ে হাওয়াই চটি। বলতে উঠে তিনি খুবই সাবলীল। কিন্তু গত এক দশকের রাজনীতি দেখার নিরিখে মনে হল এই তরুণী কি ভবিষ্যতে নেত্রী হতে পারবেন?

Advertisement

কোনও এক সমাজমাধ্যমে দেখলাম এক জন জনপ্রিয় তরুণী গায়িকা জানাচ্ছেন যে, তিনি জনৈক বলিউডের গায়িকার মতো সুন্দরী হতে পারেন না, কারণ তার জন্য প্রয়োজন তাঁর রূপচর্চায় আরও কয়েকগুণ অর্থ ব্যয়। মনে হল লতা মঙ্গেশকর বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়দের আলোচনায় গানের বাইরে কখনও রূপের কথা আসেনি। এখন সেই চর্চা রাজনীতির অঙ্গনেও প্রবেশ করেছে। ওই মঞ্চের তরুণীকে আগামী দিনে নেত্রী হতে গেলে তাঁকে দলের নেত্রীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সেই নেত্রীরা এখন চলচ্চিত্রের ছোট বড় নায়িকা, কেউ ফ্যাশন ডিজ়াইনার, এক কথায় ‘পেজ থ্রি’র নারী। তাঁদের সাজগোজ, পরিধান সবই আকর্ষণীয়, সে রকম না হলে নেত্রী হওয়া আজকাল মুশকিল। দলের সাধারণ কর্মীরাও দিনে দিনে এতে বেশ মুগ্ধ হয়েছেন। সঙ্গে দু’-চার জন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রধারী থাকতে হবে। এই তো রাজার লোকের পরিচয়, দূর থেকে এ সব দেখলেই মনে হয় তেমন নেতা এসেছেন। তাঁর রাজনীতি সমাজকর্ম পরে দেখা যাবে।

অথচ যে নারী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পালাবদল ঘটালেন, তাঁর এ সব দরকার হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপমহাদেশে এক ব্যতিক্রমী নারীনেত্রী, যিনি নিজের রাজনৈতিক শক্তিতেই এই অসম্ভব ঘটিয়েছেন। বংশগৌরব, অর্থনৈতিক প্রাচুর্য, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, শিক্ষার ঝলকানি বা প্রচলিত ধারণার রূপের বাহুল্য, এ সাহায্য ছাড়াই এমন সাফল্য অর্জনের আর একটি উদাহরণ পাওয়া কঠিন। কিন্তু রাজনৈতিক সত্তার এই গুরুত্বকে কি তিনিই লঘু করার প্রয়াস নিলেন?

Advertisement

বামপন্থীদের অপশাসন এবং একটি সজীব বিরোধী নেতৃত্বের দশকব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকাধিক রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হল। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ১৮৪টি আসন, সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস ৪২টি। সিপিএম সরকারকে এ ভাবে একেবারে ধরাশায়ী করা যাবে তা সিপিএম-বিরোধীরাও ভাবেননি। এবং সব কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী-তালিকায় প্রায় সব দলীয় সহকর্মীরাই ছিলেন, চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ছিলেন এক জন মাত্র অভিনেত্রী। এখানে এ কথাটা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, যে কোনও পেশার লোক নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতেই পারেন কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সামাজিক বৌদ্ধিক কোনও কর্মে যোগ না থাকলে সেখানে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

২০১১-র এই বিপুল জয় স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মবিশ্বাস একেবারে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছিল। এর পর তিনি সরবে বলতে পারেন যে, সব কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী, ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কয়েক মাস পরেই বলতে পারেন যে, প্রতিশ্রুত সব কাজ প্রায় হয়েই গিয়েছে। এ-হেন আত্মবিশ্বাসী রাজনৈতিক ব্যক্তি তিন বছর পর ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনে বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু করলেন— বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একেবারে শীর্ষ পাঁচ অভিনেতা অভিনেত্রীকে প্রার্থী করে। জিতলেন এঁরা, লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেসের জয় হল আশাতীত। সামাজিক, বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক কাজের পরিচয়কে একেবারে অবজ্ঞা করে বাংলার রাজনীতিতে আনা হল এক জনপ্রিয়তার ধারা। বাংলার রাজনীতির মান অবনমনের এক নতুন পর্ব শুরু হল। এই অবনমনের হাত ধরেই শুরু হল দলবদল, ফের দলবদলের ধারা।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কংগ্রেস ও পরে বামপন্থী রাজনীতির সার্বিক উপস্থিতিতে বাংলার রাজনীতিতে সামাজিক রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়টা দীর্ঘ দিন প্রাসঙ্গিক ছিল। চৌত্রিশ বছরের একাধিপত্যের শাসনের মৌতাতে ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনীতির আদর্শ একেবারেই ক্ষীণ হয়ে এল, হয়ে উঠল স্রেফ কথার কথা। তৃণমূল দলটি একটি স্থানীয় দল। তার একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা দখল। রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তৃণমূল খুব একটা বাক্য খরচ করে না, সুশাসন দেওয়াই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। ইতিমধ্যে ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে এসেছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কিছু গুরুত্ব পেতে শুরু করল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে একই ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস জিতল আরও বেশি আসন এবং বিধানসভাতেও দেখা গেল চলচ্চিত্র, ক্রীড়া মহলের অরাজনৈতিক প্রার্থীদের বহুল উপস্থিতি।

বামপন্থীদের ছন্নছাড়া উপস্থিতি ও কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন, এই আবহে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় উঠে এল। এই প্রথম বামপন্থী আদর্শের বিপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ আর এক দিশার কথা শুনতে শুরু করল, বিস্মৃতপ্রায় নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আবার স্মরণে এসে গেলেন। বাংলায় আবার পরিবর্তনের কথা প্রায় এক দশক পর শোনা যেতে থাকল। এসে গেল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন।

সফল ব্যক্তির কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষাগ্রহণ জরুরি। কিন্তু তার অনুকরণ সুখকর না-ও হতে পারে। নতুন বিরোধী শক্তির মধ্যে এর প্রবণতা দেখা গেল শুরু থেকেই। শাসক নেত্রীর অসংযত বাক্য ব্যবহার থেকে বিভিন্ন আচরণের অনুকরণ করার চেষ্টা চলল বিরোধী নেতাদের। সুবিধাবাদী দল বদলের ধারা গৃহীত হল বিরোধী শিবিরেও। দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অতীত ও দলীয় আদর্শ দূরে সরিয়ে শুরু হল নেতা ক্রয়-বিক্রয়ের বিপণি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী-চয়নে তৃণমূল পুরনো জনপ্রিয়তার ধারাকেই বজায় রাখল, এলেন নতুন বক্স অফিস কাঁপানো চলচ্চিত্র জগতের লোকেরা। নতুন বিরোধী দল রাজ্যে তখনও তেমন দাক্ষিণ্য প্রদানের অবস্থায় নেই, তবু তারাও অভিনয় জগতের দ্বিতীয় সারির তারকাদের সামনে নিয়ে এল। এ ছাড়া সর্বভারতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের মতোই এদের দিল্লির নেতাদের মন রেখে চলতে হয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিদের দিল্লির আদেশে নির্বাচনে প্রার্থী করতেই হয়। এ ভাবেই দলের সারা বছরের কর্মীরা দেখেন দলের রাজনীতি নয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, অন্য কিছু অরাজনৈতিক বিবেচনাই দলের নেতা নির্বাচনে কার্যকর। মোদী হাওয়ায় লোকসভায় ১৮টি আসনের প্রাপ্তি এই সহজ জনপ্রিয়তার ধারাকেই আরও সজীব করল।

এর পর ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী-তালিকায় ছিলেন ৩ জন অভিনেত্রী ও ৪ জন অভিনেতা, তখন উজ্জীবিত বিজেপির প্রার্থী-তালিকায় ছিলেন ৯ জন অভিনেত্রী ও ৩ জন অভিনেতা। এ ছাড়া ছিলেন দল বদল করা নেতা এবং দিল্লি থেকে প্রেরিত প্রার্থীরা। এ বার আর জয় এল না। ন্যূনতম রাজনৈতিক ও আদর্শগত আনুগত্য না থাকায় অনেকেই পরে বিদায় নিয়েছেন, অনেকে রয়ে গেছেন নিরুপায় হয়ে। যাঁরা থেকে যান তাঁদের অনেকেই দু’দিনে নেতা হয়ে বসেন, নির্বাচনে প্রার্থী না হলে গোসা করেন। এ সবই দলের অনুগত কর্মীরা নীরব দর্শক হয়ে দেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন।

সুতরাং, একেবারে শুরুতে বলা সাধারণ মেয়েটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর আদর্শগত আনুগত্যের জোরে বেশি দূর কি এগোতে পারবেন? এই মেয়েটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা কি পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের কোনও ইঙ্গিত দেয়? অপশাসন, দুর্বৃত্তায়ন ও আদর্শহীনতা বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে, তৃণমূল সেই একই পথে দ্রুততর গতিতে এগোচ্ছে। আদর্শ নিয়ে তৃণমূলের কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না, ক্ষমতা লাভের সহজ সেই পথেই মনে হয় ছুটছেন বিরোধীরাও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাটা শুধু কিছু দুর্নীতি, কিছু অপশাসন নয়, পশ্চিমবঙ্গের সমস্যার সঙ্গে জড়িত পশ্চিমবঙ্গের জন্মের ইতিহাস ও তার আগামী দিনের অস্তিত্বের সঙ্কট। আপনি যে পক্ষেরই হোন না কেন, প্রশ্নটা আদর্শের, রাজনীতির। আদর্শ ও রাজনীতি ছাড়া জনপ্রিয়তার পরিবর্তন হতেই পারে কিন্তু তাতে পশ্চিমবঙ্গের মূল সমস্যার কোনও পরিবর্তন হবে না। কারণ, জনপ্রিয় নেতা বা দিল্লির সিপাইরা এত সমস্যার ব্যাপার জানার দরকারই মনে করেন না। তাঁরা কেবল জানেন যে, পাড়ার মঞ্চে ওঠার আগে সেই মেয়েটি তাঁদের জন্য ফুলের তোড়া নিয়ে তৈরি থাকবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement