পরিবেশ নিয়ে কথা শুরু হলেই মনে হয় বেশ একটা সর্বজনপ্রিয় সর্বসম্মত শুভ চিন্তার অঙ্গনে প্রবেশ করা গেল। সবাই চাই সুন্দর পৃথিবী, শুভ্র হিমালয়, সবুজ অরণ্য, নীল আকাশ, দূষণহীন পরিবেশ। টিভিতে, কাগজে, হরেকরকমবা এনজিও-র প্রচারপত্রে ‘পরিবেশ বাঁচাও’-এর পবিত্র আহ্বান। এ রকম একটা ঝকঝকে প্রেক্ষাপটে রাজনীতির কলুষ মাখানো অনেকের কাছেই জামিন-অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে, তবু কিছু বলতেই হয়। বিশেষত রাজ্যে নির্বাচন সামনে, এ সময় মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, রাজনৈতিক দলগুলি ও নেতারা পরিবেশকে আদৌ গুরুত্ব দেন না, বড় জোর নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতির ভিড়ে দু’-একটি পরিবেশ-সংক্রান্ত ভাল কথা জুড়ে দেওয়া হয়।
ভারতের প্রথম সফল ও বহু প্রচারিত পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ অরণ্য, যা তার নামই নয়। কেরলের নীলগিরি পাহাড়ের এই অরণ্যের আসল নাম সৈরিন্ধ্রীবনম, সেখানে যে নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল, সেই নদীর নাম কুন্তী। সাহেবরা একে বানালেন সাইলেন্ট ভ্যালি। ১৯৭০ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত কেরলে কংগ্রেস, সিপিএম সবাই ক্ষমতায় এসেছে এবং সব দল এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। কেরল বিধানসভা দু’বার এই প্রকল্পের সমর্থনে সর্বসম্মত প্রস্তাব নিয়েছে, পালক্কড় জেলার মানুষ দু’বার হরতাল করেছেন এই প্রকল্পের পক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর একক প্রচেষ্টায় পরিবেশ সংরক্ষণের দাবিতে এই প্রকল্প বন্ধ হয়। অর্থাৎ, জনসাধারণের দাবির বিপরীতে পরিবেশবাদীদের দাবি জয়ী হল এক রাজনৈতিক নেতার জন্য, অথচ পরিবেশবাদীরা ইন্দিরা গাঁধীর উল্লেখ করেন বলে শোনা যায় না। পরিবেশের সবুজ রঙে এ ভাবেই মিশে আছে অন্য রাজনীতির রং।
অথবা, দেখা যাক সারা বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত ভারতীয় পরিবেশ আন্দোলন গঢ়বাল হিমালয়ের চিপকো আন্দোলনকে। এক জন স্কুল ছাত্র জানে যে, চিপকো আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাহাড়ে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে। কিন্তু সে ভুল জানে। চিপকো আন্দোলন শুরু হয়েছিল গাছ কাটার অধিকার স্থানীয় মানুষদের হাতে রাখতে। কারণ, উত্তরপ্রদেশের (তখনও উত্তরাখণ্ড নয়) সমতলের ঠিকাদাররা যোগসাজশ করে এই গাছ কাটার ঠিকা পেত ও আইনকে কলা দেখিয়ে জঙ্গল কাটত। উত্তরপ্রদেশের পাহাড়ের আটটি জেলা নিয়ে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবি দীর্ঘ দিনের, এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি পাহাড়ের সম্পদ ব্যবহারে স্থানীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠা। চিপকো আন্দোলনের প্রাথমিক নেতা ছিলেন আঞ্চলিক নেতা চণ্ডীপ্রসাদ ভাট, পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব চলে যায় উত্তরপ্রদেশের শ্রদ্ধেয় গাঁধীবাদী নেতা সুন্দরলাল বহুগুণার কাছে। বিষয়টি আর আঞ্চলিক থাকে না, পরিবেশ আন্দোলনের রূপ পেতে থাকে। পৌঁছে যায় দিল্লির পরিবেশপ্রেমীদের কাছে, যাঁরা দিল্লির ধাবায় ধাবায় পেটের দায়ে কাজ করা গঢ়বালি কিশোরদের খোঁজ না রাখলেও গঢ়বালের পাহাড় অরণ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় গাছ কাটার বিরুদ্ধে। এবং সেই ইন্দিরা গাঁধী সক্রিয় হন, ফলে চিপকো আন্দোলনের জয়। যদিও উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবি আদায়কারী আন্দোলনকারীরা চিপকোর ব্যাপারে আদৌ প্রসন্ন ছিলেন না। চিপকো আন্দোলনকে অত্যন্ত সুচারু ভাবে সারসংক্ষেপ করা হয়েছে ভারত সরকারের জাতীয় অরণ্য নীতিতে (১৯৮৫)— “যদিও ১৯৭৩-এর চিপকো আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল জঙ্গলের সম্পদ আহরণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল এবং স্থানীয় অরণ্য নির্ভর শিল্পে কম দামে কাঁচা মাল বণ্টন, কিন্তু পরে এই আন্দোলনের লক্ষ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। সাময়িক স্বার্থভিত্তিক অর্থনীতি থেকে এটি উন্নীত হয়েছে একটি চিরস্থায়ী অর্থনীতির পরিবেশ আন্দোলনে।” সোজা কথায়, জনসাধারণের স্থানীয় অধিকারের দাবির বিপরীতে একটি অর্থনৈতিক আন্দোলনকে পরিবেশ আন্দোলন করা হল। এটাই পরিবেশের রাজনীতি। এখানেও পরিবেশবাদীরা রাজনীতিবিদ ইন্দিরা গাঁধীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিয়েছিলেন বলে জানি না।
অবশ্য এই পরম্পরা বহমান। বাংলায় (হয়তো ভারতেও) প্রথম পরিবেশ ও নারী সমস্যা নিয়ে ১৯৮১ সালে চালচিত্র চলচ্চিত্র করেন বামপন্থী মৃণাল সেন। বিষয়, রান্নাঘরের ধোঁয়া ও মেয়েরা। সেখানে তিনি সমাধানও বলেছেন, গ্যাসের উনুন। পরিবেশবাদীদের অনেকেই ঘোর নারীবাদী, নারী ও পরিবেশের নাড়ির যোগ স্বীকৃত। ভারতের দরিদ্র নারীদের ঘরে ঘরে বিনামূল্যে গ্যাস পাঠিয়ে সেই সমাধান করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কোথাও শুনেছেন পরিবেশবাদীরা মোদীকে সংবর্ধনা দিচ্ছেন? না। কারণ, এটাই হল পরিবেশের রাজনীতি।
পুরসভা পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা নির্বাচনে জল সরবরাহ, শৌচালয় নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী সংযোজন ইত্যাদির কথা আলোচনায় আসে, প্রতিশ্রুতি থাকে— কিছু কাজও হয়। কিন্তু এ সবই হয় উন্নয়নের অঙ্গ হিসেবে। মুশকিল হচ্ছে, পরিবেশবাদীদের বড় অংশ গরিব দেশে উন্নয়নের বিরোধী। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ আছেন, যাঁরা নিজেরা স্বেচ্ছায় খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন ও মানুষকে সেই জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলেন— যেমন, সুন্দরলাল বহুগুণা। কিন্তু বেশির ভাগ অনুসরণ করেন পরিবেশের জন্য নোবেলজয়ী আমেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরকে, যাঁর ব্যক্তিগত বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল গড় আমেরিকানের ২০ গুণ বেশি, গড় ভারতীয়ের ৩০০ গুণ বেশি। ইনি বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখবার জন্য উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের বার্তা দেন। ফলে পরিবেশের এই রাজনীতির সঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতির সংঘাত অবাক করে না।
এই নির্বাচনী আবহাওয়ায় সম্প্রতি হিমালয়ে ঘটল এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা। প্রবল বর্ষণের মধ্যে নন্দাদেবী হিমবাহের কিছু অংশ হঠাৎ নেমে আসে ধৌলিগঙ্গায়, সেই জলস্রোতে দু’টি নির্মীয়মাণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের শ্রমিকরা আটকে পড়েন এবং শতাধিক মারা যান। এই ঘটনার কারণ এখনও অনুসন্ধান চলছে, কিন্তু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে সেই পুরনো রেকর্ড— চেরাপুঞ্জিতে হচ্ছে না বৃষ্টি/ নিশ্চয় এটা কমিনিষ্টি-র মতো, এ সবের জন্য দায়ী উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। হিমালয় একটি সচল পর্বতমালা, ফলে কিছুটা ভঙ্গুর, ভূমিকম্পপ্রবণ। যখন হিমালয়ে এত রাস্তাঘাট হয়নি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়নি— তখনও ১৮৯৩, ১৮৯৪, ১৯৭০, ১৯৭৭ সালে বড় বড় বন্যা ঘটেছে। ১৯৯১-এ উত্তরকাশী, ১৯৯৯-এ চামোলীর ভূমিকম্পের স্মৃতি এখনও মলিন হয়নি। ২০১৩-র বন্যার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে উত্তরাখণ্ডে ২৪টি প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানাতে বলে। ভারত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে এ ব্যাপারে মতানৈক্যের ফলে বিষয়টির এখনও ফয়সালা হয়নি। ইতিমধ্যে ২০২০ সালের অগস্ট মাসে উত্তরাখণ্ড সরকার সুপ্রিম কোর্টে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য আবেদন করেছে, কারণ এই সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ আটকে যাওয়ায় সেখানে বিদ্যুৎ সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। পরবর্তী শুনানি ২০২১-এর জুলাইয়ে! অবশ্য হিমালয়ের অন্য দিকে তিব্বত জুড়ে চলছে উন্নয়নের জোয়ার, রেল থেকে জলবিদ্যুৎ সবই হচ্ছে। এ রাজ্যের বামমনস্ক সতত প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা তিব্বত হিমালয় ভুলেও চেনেন না। এটাও মনে রাখা উচিত যে, বিলেতের হাউস অব কমন্স-এর কমিটি প্রথম রেল চালানোর পক্ষে মত দিতে চায়নি। উন্নয়নের পথে এ সব বিতর্ক থাকেই, তবু এগোনোই মানব সভ্যতা।
যে দেশের মানুষ আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দানে যত উন্নত জীবন যাপন করে, সে তত পরিবেশপ্রেমী বা পরিবেশবিলাসী হয়ে ওঠে। অনুন্নত জীবনযাত্রাকে সহনশীল, পরিবেশবান্ধব ইত্যাদি বাজারি প্রচার চলে। প্রগতিশীল আবেগের ফুলঝুরির আড়ালে উন্নয়ন-বিরোধিতায় মাঠে নেমে পড়েন কবি, সাহিত্যিক, এনজিও-রা। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর প্রিয় লেক ডিস্ট্রিক্টে রেল লাইন বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন, ইংরেজরা তা মানেনি। মার্ক টোয়েন মিসিসিপি নদী সম্পর্কে লিখছেন— “দশ হাজার নদী কমিশন, দুনিয়ার সব সম্পদ দিয়েও এই অবাধ্য নদীকে বশ মানানো যাবে না।” কিন্তু প্রযুক্তিবিদরা মিসিসিপিকে বাধ্য ছেলের মতোই আটকে রেখেছেন। এই সব আবেগ, পরিবেশবিলাসকে সরিয়ে রেখে রাজনীতিকদের ভাবতে হয় মানুষের উন্নয়নের কথা, অন্তত ভোটের জন্য। পরিবেশ ও উন্নয়ন তাই এক সঙ্গে চলে, কেউ বহিরাগত নয়।