বিজ্ঞানের দুনিয়ায় মেয়েদের অনুপস্থিত ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত
Science

ওপেনহাইমার এবং সেই মা

অস্বীকার করব না, অবাক হয়েছিলাম। চেনা বৃত্তে এমন চেনা মেয়ে-মুখ বিশেষ ছিল না, যে বলতে পারে অঙ্ক করতে ভাল লাগে।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২৪
Share:

—প্রতীকী ছবি।

পর্দায় আলবার্ট আইনস্টাইন তখন জে রবার্ট ওপেনহাইমারকে বলছেন, “তোমাকে যথেষ্ট শাস্তি দেওয়ার পর ওরা তোমাকে স্যামন স্যান্ডুইচ খাওয়াবে, বড় বড় কথা বলবে, তোমাকে মেডেল দেবে, তোমার পিঠ চাপড়ে বলবে, সব ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু মনে রেখো, সব ওরা করবে নিজেদের জন্য, তোমার কথা ভেবে নয়।” আর পর্দায় একের পর এক ফুটে উঠছে, বিশ্বাসঘাতকের তকমা পাওয়া-সিকিয়োরিটি ক্লিয়ারেন্স হারানো-লাঞ্ছনা-অন্ধকারের পর ওপেনহাইমার পুরস্কৃত হচ্ছেন, ফিরে পাচ্ছেন সম্মান, পিঠে হাত, হাতে হাত।

Advertisement

সেই সঙ্গেই কেন বার বার মনে রেখে দিচ্ছি এই সংলাপও? “ওপেনহাইমার দেখতে এসেছি, ইংরেজি ছবি, ফিজ়িক্স, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইংরেজি, এ সব কি আমি বুঝি? কিন্তু মেয়ে বলল দেখবে, ওর বাবা এখানে নেই, তাই আমাকে আসতে হল।” ফিল্ম শুরুর আগে মোবাইল কানে নিজের মতো কথা বলে চলেছেন যখন সকলে, পাশ থেকে কথাগুলো কানে এল।

উঁকি মেরে দেখে নিলাম, মা-কে। কিশোরী কন্যা। মা আটপৌরে নন (প্রেক্ষাগৃহে মহিলাদের সংখ্যা দৃশ্যত অকিঞ্চিৎকর হলেও মেয়ে-মা জুটি চোখে পড়েছিল জনা চারেক, তাঁদের এক জন এসেছিলেন একেবারেই আটপৌরে পোশাকে)। কেন বলতে হল, “ইংরেজি ছবি, ফিজ়িক্স, আমি কি বুঝি?”

Advertisement

আলাপ নেই, তার উপর ছবি শেষে হল স্তব্ধ। কী ভাববেন, এই দ্বিধা কাটিয়ে আর জিজ্ঞাসা করা হল না যে, কেমন লাগল ইংরেজি ছবিটি? কেমন লাগল মহামৃত্যুর কারিগর বিজ্ঞানীর দোলাচল, কেমন লাগল এক বিজ্ঞানীকে কাঠগড়ায় তোলা? কেমন লাগল রসায়ন পড়ে আসা মেয়েটির ম্যানহাটন প্রোজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আধা দৃশ্য, আবেগপাগল কমিউনিস্ট মেয়ের প্রেম, দূরে ঠেলে দেওয়া এবং আত্মহত্যা, যেখানে পাপবোধে ভোগা বিজ্ঞানীকে স্ত্রী বলছেন, “ভুল করবে, আর প্রত্যাশা করবে তার জন্য অন্যরা তোমাকে দয়া দেখাবে, তা তো হয় না।” কেমন লাগল বিজ্ঞানীর বিশ্বাসঘাতকতা স্ত্রীর প্রতি, পুত্রের একটানা কেঁদে যাওয়া, ক্লান্ত স্ত্রী আর পৃথিবীকে ওলটপালট করে দেওয়া ক্ষমতার উল্লাস। পুরুষ এবং মহিলাদের। কেমনই বা লাগছিল যখন তরুণ ওপেনহাইমার ধ্বস্ত হচ্ছিলেন মস্তিষ্ক আর মননে, এক অন্য ব্রহ্মাণ্ডের হাতছানিতে।

মনে পড়ল বন্ধু সোনালিকে, অঙ্কে যে ছিল দীপ্ত, ক্যানসারে চলে গিয়েছে অকালেই।

তারারা কি মরে যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে যখন ওপেনহাইমার বলছেন, “হ্যাঁ, যদি তারা মরে যায়, তারা ঠান্ডা হয়ে যায়, তার পর মরে যায়। যত বড় তারা, তত ভয়ঙ্কর তার মৃত্যু। তাদের অভিকর্ষের তীব্রতা এত‌ই যে সব গ্ৰাস করে নেয়।” ...মনে এলেন উষাদি, যিনি প্রাথমিক বিভাগে শিখিয়েছেন বছরের পর বছর, সব ছাত্রীকে, অ্যালবামের কালো পাতার উপরে রুপোলি কাগজ কেটে কী ভাবে তারা তৈরি করতে হয়, কী ভাবে তৈরি করতে হয় কালপুরুষ, লুব্ধক, সপ্তর্ষিমণ্ডল। খাতা ভরে। কেন মায়েরাই যুগ যুগ ধরে বলে চলেন সন্তানকে, “মরে গেলেও থাকব, তারা হয়ে, আকাশে দেখবি নতুন তারা!”

মনে পড়ল মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার সেই মেয়েটিকে, নাবালিকা মেয়ে, স্কুলে আর যার পড়া হয়নি। একরাশ লোকের মধ্যে বসে আড়াল খোঁজার চেষ্টায় যে বলেছিল, “দিদি, আমার অঙ্ক করতে খুব ভাল লাগে।” তার বিয়ে ঠিকই করে ফেলেছিল মা, নাবালিকা মেয়েটি চলে গিয়েছিল সটান ওসির কাছে, বিয়ে সে যাত্রা ঠেকানো যায়। পুলিশ ডেকে পাঠায় মা-বাবাকে। হইহই ফেলে দেওয়া সেই খবর স্তিমিত হওয়ার বেশ কিছু পরে মেয়েটির বিয়ে হয় নাবালিকা বয়সেই, সন্তান হয়। স্কুলে গিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা তার আর হয়নি । তখনই তার সঙ্গে দেখা। প্রথম আলাপেই সে বলেছিল, “দিদি আমার অঙ্ক করতে ভাল লাগে।”

অস্বীকার করব না, অবাক হয়েছিলাম। চেনা বৃত্তে এমন চেনা মেয়ে-মুখ বিশেষ ছিল না, যে বলতে পারে অঙ্ক করতে ভাল লাগে। মেয়ে মানে দরজা ‘পুশ’ লেখা থাকলে ‘পুল’ করবে, ‘পুল’ লেখা থাকলে করবে ‘পুশ’! ফর্ম নিজে ভরতে পারবে না, কোনও পুরুষের দরকার হবে। ভাষায় দখল থাকতে পারে, প্রাণিবিজ্ঞান পড়তে পারে, সংসারের হিসাব মানসাঙ্কে চটপট করতে পারবে, তাই বলে অঙ্কে মাথা থাকবে না, বা মাথা না ঘামানোই ভাল বলে মনে করা হবে। মেয়েদের বিজ্ঞানী ভাবতে অসুবিধা হয় এখনও, যেমন সাহিত্যিক ভাবতেও। গল্প-টল্প লেখা, কবিতা-টবিতা লেখা ওই আর কী।

মনে পড়ছে, (সমাজমাধ্যমে সুনন্দিনী শুক্লার লেখা) এথনোম্যাথমেটিকস পড়াতে এসে অধ্যাপক ক্লদিয়া জ়াসলাভস্কির একটি ক্লাসের কাহিনি। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান-এ ১৬৮টা খাঁজকাটা দাগের একটি হাড়ের টুকরো দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেটি কী? জানিয়েছিলেন, খাঁজ কেটে সেখানে চান্দ্রমাসের হিসাব করা হয়েছে। ৬ মাসের হিসাব। এক ছাত্র বলেছিল, “ওহ! তা হলে এ হল আদিপুরুষের ক্যালেন্ডার তৈরির প্রথম চেষ্টা!” ক্লদিয়া বলেছিলেন, “কী করে বুঝলে এটা পুরুষের তৈরি? প্রতি মাসে ২৮ দিনের হিসাব রাখার প্রয়োজন কোন পুরুষের পড়ে? সম্ভবত কোনও মেয়ে হাড়ের টুকরোয় দাগ কেটে নিজের ঋতুচক্রের হিসাব রাখার চেষ্টা করেছিলেন।”

এক বার সংবাদকক্ষে এক জন একটি গল্প বলেছিল। গল্পটা হল, এক বাবা এবং তাঁর ছেলে যাচ্ছিল বেড়াতে। পথে দুর্ঘটনা। বাবা মারা গেলেন। ছেলেটির অবস্থা খারাপ। নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে। সার্জন দেখে বললেন, “আমি অস্ত্রোপচার করতে পারব না, এ তো আমার ছেলে।” বাবা তো মারাই গিয়েছেন, তা হলে কী করে এ সার্জনের ছেলে হল? প্রশ্ন শুনে শ্রোতারা উত্তর হাতড়াল, কেউ বলল সৎ বাবা, কেউ বলল, ছেলেটির পালক পিতা মারা গিয়েছেন, আসলে সার্জনই তার জন্মদাতা পিতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রোতাদের মধ্যে মেয়েরাও ছিল, কিন্তু কেউই ঠিক উত্তর দিতে পারেনি। শেষে প্রশ্নকর্তা মেয়েটি খুব হতাশ হয়ে বলেছিল, “তোমরা কেউ বলতে পারলে না, সার্জন তো ছেলেটির মা।”

সন্দেহ নেই, এখনকার দুনিয়ায় অনেকেই ভাববেন, এ আবার প্রশ্ন না কি, বোঝাই তো যাচ্ছে মা সার্জন। কিন্তু নাহ!

হার্ভার্ড এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্ব বিভাগের চার গবেষকের সমীক্ষা-নিবন্ধ জানাচ্ছে, সত্তরের দশকে আমেরিকার টিভি সিরিজ় অল ইন দ্য ফ্যামিলি-র সূত্রে জনপ্রিয় হয়েছিল এই ‘ধাঁধা’। এবং ওই সিরিজ়-এর ৫০ বছর পরেও সমীক্ষায় যোগদানকারী আমেরিকানদের ৮০ শতাংশ এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারেননি, এবং আমেরিকায় চিকিৎসকদের ৮০ শতাংশই পুরুষ। যেমন ভারতে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ২০১৪-১৫ সালে মেডিক্যাল পড়তে ঢোকা পড়ুয়াদের ৫০ শতাংশ মেয়ে হলেও পিজি-তে তা ছিল এক-তৃতীয়াংশ। আর দেশে তখন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের মাত্র ১৭ শতাংশ মহিলা। কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরেই কি ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করা থেকে পিছিয়ে আসছেন মহিলারা? প্রশ্ন তোলা হয়েছিল ওই সমীক্ষায়।

মাদাম কুরি যখন দ্বিতীয় বার নোবেল পদক গ্রহণ করতে চলেছেন রসায়নে, তার আগেই ফরাসি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাঁকে ওই সংস্থায় প্রাপ্য আসন থেকে বঞ্চিত করেছে, তাঁর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে ফরাসি সংবাদপত্র রসালো এবং আপত্তিকর নিবন্ধে, কটু-কাটব্যে ছয়লাপ, তাঁকে স্টকহোমে যেতে পর্যন্ত বারণ করেছে নোবেল কমিটি, পাছে সুইডেনের রাজবংশের উপস্থিতিসম্পন্ন অনুষ্ঠানের গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়, স্টকহোমে যেতে বলে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন আইনস্টাইন।

কেন মনে থেকে যাচ্ছে ওই সংলাপ— “তোমাকে যথেষ্ট শাস্তি দেওয়ার পর ওরা তোমাকে স্যামন স্যান্ডুইচ খাওয়াবে, বড় বড় কথা বলবে, তোমাকে মেডেল দেবে, তোমার পিঠ চাপড়ে বলবে, সব ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু মনে রেখো, সব ওরা করবে নিজেদের জন্য, তোমার কথা ভেবে নয়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement