ক্ষোভ: বাঙালি অর্থনীতিবিদকে কদর্য আক্রমণের রাজনীতির প্রতিবাদ, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ নিজস্ব চিত্র।
কথায় বলে, কারও গরু হারালে মনের বিকারে সে নাকি তখন বৌকেও মা বলে! সমাজে ‘শিক্ষিত’ তকমাধারী দুই বঙ্গজনের সাম্প্রতিক হাল দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছে, সরাসরি ‘গরু’ না হারালেও ‘খুঁটি’ হারানোর শঙ্কায় বোধ হয় তাঁদের ণত্ব-ষত্ব ঘেঁটে গিয়েছে।
এঁদের এক জন তথাগত রায়। অপর জন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। উভয়েই শিক্ষিত হিসাবে জনমান্য। তাই তাঁদের এই ণত্ব-ষত্বহীনতাকে অবোধ আনন্দ বলে ভাবার কারণ নেই। বরং ওঁদের কৃতকর্মের ভিতর দিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির একটি নকশাও হয়তো উন্মোচিত হতে পারে। তাই বিষয়গুলি নিয়ে কিছু পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।
রাজ্য বিজেপির একদা সভাপতি তথাগতবাবু পর পর ভোটে হেরে দিল্লির ‘খুঁটি’র জোরে রাজ্যপাল হতে পেরেছিলেন। সবাই দেখেছেন, আগরতলার রাজভবনে ২০১৫ থেকে তিন বছর এবং শিলঙের রাজভবনে তার পরের দু’বছরের পর্বে তাঁর অন্যতম ‘কর্তব্য’ ছিল সমাজমাধ্যমে লিখে বিজেপির পক্ষে প্রচার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের মুণ্ডপাত। রাজ্যপালেরা যতই কেন্দ্রের কর্তাভজা হোন না কেন, রাজভবনের এমন বেআব্রু রাজনীতিতে তথাগতবাবুই অগ্রজ!
কলকাতায় ফিরে তিনি আবার কাগজেকলমে বিজেপি হয়ে উঠলেও লাভ হয়নি। তবু স্বঘোষিত ‘জ্যাঠামশাই’-এর মতো রাজ্য নেতাদের প্রচুর উপদেশ দিয়েছেন। উষ্মাও উগরে দিয়েছেন। আপাতত বিজেপির জায়গিরে তিনি প্রান্তিক বললে খুব ভুল হবে না।
রাজনীতির বাইরে অবশ্য তিনি কৃতী ইঞ্জিনিয়ার। এক কালে রেলের উচ্চপদাধিকারী, যাদবপুরের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান এবং সর্বোপরি বিদ্বজ্জন হিসাবে এ-যাবৎ কিছু মান্যতাও পেয়ে এসেছেন।
কিন্তু সেই ব্যক্তিকে যখন অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে অশালীন আক্রমণের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, এ হল রুচির বিকার! তা বলে তথাগত রায়ের সহসা ‘বুদ্ধিভ্রংশ’ হয়েছে ভাবলে চরম ভুল হবে। এটা আসলে তাঁর একটি চতুর পদক্ষেপ।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অমর্ত্যবাবুর অবস্থান নতুন নয়। সেখানে তিনি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘শ্রেণিশত্রু’। উপরন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মমতাকে প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার যোগ্য বলেও মনে করেছেন অমর্ত্য। সবাইকে এটা মানতে হবে বা তাঁর বলার জন্য মমতা প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন, এ কথা কেউ বলছে না। অমর্ত্য সেন নিজেও সে কথা বলেননি। তথাপি লোকসভা নির্বাচনের আগে নোবেলজয়ী ও ভারতরত্ন এই বাঙালির এমন মূল্যায়নের কিছু অভিঘাত সমাজে অবশ্যই পড়ে। বস্তুত সেই কারণেই অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত না হয়েও বিজেপির কোনও পদাধিকারী তাঁকে প্রকাশ্যে অশালীন আক্রমণ করার ঝুঁকি নেননি। কিন্তু তথাগতবাবু সম্ভবত ভেবেছেন, অমর্ত্য সেনকে নোংরা আক্রমণের লক্ষ্য করে তুলতে পারলে এই বাজারে দিল্লির প্রভুদের ‘প্রসাদভাজন’ হতে পারবেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী ‘অন্যের লেখা’ পদ্যের (রবীন্দ্র-কবিতার অনুকরণে) যে টুইটটি তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেখানে অমর্ত্য সম্পর্কে অন্তত একটি বিশেষণ খবরের কাগজেও ছাপার অযোগ্য! তথাগতের মতে, অমর্ত্য সেন ‘রাজনীতি’ করছেন। তাই এ সব নাকি তাঁকে সইতেই হবে!
বিস্ময়ের হল, তথাগতবাবু যে দলের ধ্বজাধারী বলে স্বীকৃত, তাদের নেতৃত্বের কোনও স্তর থেকে কেউ আজও পর্যন্ত এগুলি নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এই মৌন কি প্রচ্ছন্ন সম্মতির লক্ষণ? না কি, তথাগত রায়কে পাত্তা না দেওয়া? এখনও সেটা স্পষ্ট নয়।
তবে একটি বিযয় মানতে হবে। অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব বা পর্যবেক্ষণ নিয়ে মতভেদ যতই থাক, তাঁকে কাঁচা ‘খিস্তিখেউড়’ করা শিক্ষিত বাঙালি সমাজের গরিষ্ঠ অংশের কাছে কখনও গ্রহণীয় হতে পারে না। তাই যথাযথ প্রতিবাদ না করায় বিজেপিকে এর দায় বইতে হবেই। এটাও ভুললে চলবে না, অমর্ত্যবাবুকে ভারতরত্ন দিয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। তথাগত রায় বিজেপিকেও টেনে কাদায় নামালেন।
একই কথা অনেকাংশে প্রযোজ্য বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে। তাঁরও বিদ্যাবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ নেই। এমনকি, ২০১৮ সালে বিশ্বভারতীতে উপাচার্য হয়ে আসার আগে তিনি অন্য কোনও চাকরির জায়গায় কখনও অভিযোগের শিকার হয়েছিলেন কি না, সেই সব চর্চাতেও এখন মরচে ধরে গিয়েছে। ও সব থাক। আপাতত শুধু তাঁর ‘ভজনা’র কথা বলা যাক।
যাঁরা বলেন, এই উপাচার্যের নাকি কিছু ‘অ্যাজেন্ডা’ আছে, তাঁরা কি খুব ভুল বলেন? জানি না। তবে ‘ধন্দ’ অনেকটা খোলসা করে বিশ্বভারতী প্রশাসন সে দিন লিখিত বিবৃতিতে ঘোষণা করে দিয়েছে, “আমরা প্রধানমন্ত্রীর মার্গ দর্শনে চলতে অভ্যস্ত।” সোজা কথায়, মোদীর পথই তাঁদের পথ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে ছত্রে ছত্রে ভুলে ভরা বাংলায় বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিকের সই করা ওই বিবৃতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গোক্তি এবং রাজনৈতিক মন্তব্যে ভরা। এরও কোনও নজির নেই!
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অফিসারের এ-হেন স্পর্ধার ‘উৎস’ কোথায়, তা সহজেই অনুমান করা যায়। মোদী রাজনীতি করুন, মমতা রাজনীতি করুন। এটা তাঁদের কাজ। তা বলে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠান হাত ধুয়ে রাজনীতিতে নামবে! রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে এ সবই শতবর্ষের ‘নিদারুণ’ প্রাপ্তি! যেমন প্রাপ্তি উপাচার্যের একটি বাণী, “অমর্ত্য সেন নোবেল পাননি!”
আচ্ছা, নরেন্দ্র মোদী এ সব নিশ্চয় জানেন? বিশ্বভারতীর আচার্য হিসাবে এগুলি তো তাঁর জানারই কথা। তবে কি এই বিকৃতি, এই ব্যভিচারের মোচ্ছব তাঁদের অনুমোদন-পুষ্ট? প্রশ্ন তোলার কারণ, তথাগতবাবুর টুইট-কূটতার মতোই বিদ্যুৎ-চক্রের অশোভনতা নিয়েও কেন্দ্রের শাসকেরা নীরব। না দলে, না প্রশাসনে, কোথাও কোনও হেলদোল নেই।
এই যদি ‘প্রধানমন্ত্রীর মার্গ দর্শন’এর রূপ হয়ে থাকে, তা হলে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীকে সেই মার্গে চালানোর ‘পারিতোষিক’ মোদী নিশ্চয় বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে দেবেন। সে ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে তাঁর এই পদের মেয়াদ ফুরোলে ‘উপযুক্ত’ পুনর্বাসনের পথও নিশ্চয় পদ্ম-শোভিত হবে!
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর চৌহদ্দিতে রাজনীতি চাননি। বার বার সে কথা তিনি বলেছেন। যদিও তাঁর সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে বহু আগেই। তার দায় অবশ্যই সবার, নির্দিষ্ট কোনও দলের নয়। তবে এখনকার সঙ্গে আগের তফাত হল, কর্তৃপক্ষের ‘রাজনৈতিক’ হয়ে ওঠা। যখন সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে মোদীকে সাক্ষী রেখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠেছিল, কেউ টুঁ শব্দটিও করেননি। আজকের বিশ্বভারতী তো ‘প্রধানমন্ত্রীর মার্গ দর্শন’-এ চলতেই অঙ্গীকারবদ্ধ!
জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর কথা ছেড়ে দিলাম। বিশ্বভারতীর আচার্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে দেখেছি। এক বার সমাবর্তনের আগের রাতে বাম ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভ, অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়ার হুমকির মুখে উত্তরায়ণ থেকে বেরিয়ে সরাসরি প্রতিবাদীদের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন রাজীব। সমস্যা বুঝতে পড়ুয়াদের সঙ্গে ঘুরেছিলেন বিভিন্ন হস্টেলে। পর দিন সমাবর্তন নির্বিঘ্ন হয়।
‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ছাত্রদের ভার নেওয়ার অধিকারী তাঁরাই, যাঁরা জানেন শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা এবং যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলে গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হন না।
এখনকার বিশ্বভারতীতে উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রদের একটি বড় অংশের দূরত্ব কার্যত ঢিল ছোড়ার! রক্ষী-বেষ্টিত উপাচার্যের হাতে তাক করা ঢিলের ছবি তো তা-ই বলে! অধ্যাপক ও কর্মী মিলিয়ে এই আমলে সাসপেন্ড ভূরি ভূরি। প্রতিষ্ঠানের মান পড়ছে হুহু করে।
বাম আমলে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন ‘অনিলায়ন’ এসেছিল, বিশ্বভারতীতে কি আজ তেমনই ‘বিদ্যুদয়ন’! আবারও বলতে হয়, দিল্লির কাছে হয় এই বিশ্বভারতী আজ গুরুত্বহীন, অথবা দিল্লি এমনটাই চায়। তাই কোনও মাথাব্যথা নেই।
নিজ নিজ বৃত্তে তথাগত রায়, বিদ্যুৎ চক্রবর্তীরাও হয়তো সেই জন্যই অকুতোভয়।