জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ এবং গাজ়াবাসীদের উপর আক্রমণ
Israel Palestine Conflict

নব বর্ণবাদের বিজয়

ইজ়রায়েলি সেনাধ্যক্ষ, মন্ত্রিবর্গ, টিভি সঞ্চালক, এবং জনপ্রতিনিধিদের মুখে এ সব কথা শোনা গেছে গত দু’মাস ধরে গাজ়াবাসীদের বিরুদ্ধে, প্যালেস্টাইনিদের সম্পর্কে।

Advertisement

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৬
Share:

সরব: যুদ্ধবিরতি আর মুক্ত প্যালেস্টাইনের দাবি নিয়ে বিক্ষুব্ধ মিছিল, বস্টন, ১৭ ডিসেম্বর। রয়টার্স।

বার বার শোনা এ সব উক্তি। “ওরা মানুষ নয়, পশু ওরা, ওরা শয়তান।” “ওদের সবাইকে হত্যা করা উচিত। দশ হাজার নিধন যথেষ্ট নয়, কুড়ি লাখ লোকেরই মরা উচিত।” “ওদের নিজেদের শাসনের অধিকার নেই। ওদের চলে যেতে হবে অন্যত্র। নইলে সিনাই মরুভূমিতে শিবির করুক। তাঁবু খাটিয়ে থাকুক।” “আমরা তো বলেই দিয়েছি, হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়শিবির, এ সব ছেড়ে অন্যত্র চলে যাক। বাড়িগুলোয় আছে কেন, আমরা তো লিফলেট আকাশ থেকে ছড়াচ্ছি যে আমরা এগুলোর উপর বোমাবর্ষণ করব।” “কোথায় যাবে? নিজেরা ঠিক করুক। মিশরে যাক, জর্ডনে যাক। এ দেশে থাকা চলবে না।”

Advertisement

ইজ়রায়েলি সেনাধ্যক্ষ, মন্ত্রিবর্গ, টিভি সঞ্চালক, এবং জনপ্রতিনিধিদের মুখে এ সব কথা শোনা গেছে গত দু’মাস ধরে গাজ়াবাসীদের বিরুদ্ধে, প্যালেস্টাইনিদের সম্পর্কে। এক জনগোষ্ঠীর প্রতি অন্য জনগোষ্ঠীর বিদ্বেষ, হত্যাকাঙ্ক্ষা, শক্তি এবং আধিপত্যের উল্লাস। এ শুধু উপনিবেশবাদী আচরণ নয়, চরম বর্ণজাতিবিদ্বেষের প্রকাশ। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দুনিয়া নিঃশব্দে এ সব মেনে নিয়েছে। কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশে প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা অপরাধ।

একই ভাবে, ইহুদিজাতিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। ইজ়রায়েলের আগ্রাসী ও গণহত্যাকারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, গাজ়াবাসীদের সমর্থন করা অথবা ইহুদিজাতিবাদের সমালোচনা আজ ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষের সমার্থক বলে গণ্য করা হচ্ছে। ইহুদিজাতিবাদের সমালোচনা করলে দেশে যেতে হবে, চাকরি যাবে, কাজ যাবে। মুখ খোলা যাবে না। এক প্রবল দক্ষিণপন্থী হাওয়া সমগ্র পশ্চিমে বইছে। জাতি এবং বর্ণবিদ্বেষবাদ এখন পশ্চিমি গণতন্ত্রের মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

এই বর্ণবিদ্বেষী পরিবেশের মধ্যেও প্রতিবাদ হচ্ছে। শান্তির সমর্থনে, যুদ্ধবিরতির দাবিতে, গাজ়াবাসীর জীবনের অধিকারের সমর্থনে এবং সাধারণ ভাবে প্যালেস্টাইনবাসীদের জাতীয় দাবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কলেজে, রাস্তায়, বিভিন্ন ময়দানে প্রতিবাদ হচ্ছে, সমাবেশ সভাযাত্রা হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমি সরকারসমূহ ও ইজ়রায়েলকে আগ্রাসন ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের পথ থেকে নিরত করার পক্ষে এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট নয়। এই সব প্রতিবাদ সরকারগুলোর গা-সওয়া। যে গভীর বর্ণবিদ্বেষপ্রসূত এই আগ্রাসন ও নরহত্যাকাণ্ড, তা এই প্রতিবাদে নিরস্ত হবে না। কোনও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক প্রতিবাদে সংযত হয় না। বরং গণতান্ত্রিক পোশাক পরে বলে, আমরা সংখ্যাধিক্যের ভোটে সরকারে এসেছি। আমরাই গণতান্ত্রিক। তোমরা দেশবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, হিংসার সমর্থক। তোমরা সামাজিক শান্তি চাও না। গণতন্ত্রের এই বিবর্তনে বর্ণবিদ্বেষ এক বড় ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু শুধু মতাদর্শের ভিত্তিতে জাতিবর্ণবাদ বেড়ে ওঠে না। বর্ণবাদের বৃদ্ধির জন্য আধিপত্য বিস্তার ও শক্তিপ্রদর্শনের প্রয়োজন। তারই চরম রূপ হল আগ্রাসন ও অন্য দেশ ও জাতিকে পরাজিত করে, তার উপর কর্তৃত্ব স্থাপন। বর্ণের পার্থক্য বাড়ে জয়ী ও পরাজিতের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে।

প্যালেস্টাইনবাসীদের উপর ইহুদিজাতিবাদীদের আগ্রাসন ও কর্তৃত্ব স্থাপন দিয়ে এই তীব্র বর্ণবিদ্বেষের শুরু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বালফুরের পরিকল্পনা (১৯১৭) অনুযায়ী ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে ইহুদি জনবসতি তৈরি করা শুরু হয়। তার আগেও প্যালেস্টাইন ও সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ইহুদি জনগণ ছিল, কিন্তু এই জনপরিচিতি কোনও ধর্মবাদী রাজনৈতিক সত্তায় প্রকাশিত হয়নি। অতিকথা কাজ করেছে ইউরোপের এই ধর্মবাদী মনোভাবের বৃদ্ধির পিছনে। প্যালেস্টাইন আদিতে ইহুদিদের জন্মভূমি, এটা তাদেরই আদি দেশ, অন্যদের এখানে থাকার অধিকার নেই। যার অর্থ প্যালেস্টাইনবাসীদের বিতাড়ন। এই বিতাড়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চলছে। যাকে বিতাড়িত প্যালেস্টাইনবাসীরা বলে, তাদের জীবনে, জাতির জীবনে বিপর্যয়।

বর্ণবাদ জয়ী হয় এই ভাবে। অতিকথা, গায়ের জোর, মতাদর্শ, যুদ্ধজয় ও উপনিবেশ স্থাপন, পরাজিতদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, অর্থনৈতিক শোষণ: এই সব উপাদানের সমন্বয়ে আধুনিক বর্ণবাদ ও বর্ণাধিপত্যের সৃষ্টি। এই বর্ণভেদ ও আধিপত্যের চরম প্রকাশ গায়ের রঙের পার্থক্য, ভাষার পার্থক্য, ধর্মের পার্থক্য, সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে দৈহিক পার্থক্যে পরিণত করার মধ্যে। নিম্নতর বর্ণ বলে যাদের গণ্য করা হল, তাদের ধ্বংস করতে হবে, তাড়াতে হবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই বিদ্বেষ এবং আধিপত্যকামনা থেকে গাজ়ায় বোমাবর্ষণ ও হত্যালীলার শুরু। সামান্যতম প্রতিবাদ হলেও প্রতিবাদীকে নিঃশেষ করো। নিহতদের মধ্যে অর্ধেক হল শিশু, বৃদ্ধবৃদ্ধা, এবং নারী। এরা অন্য বর্ণ এবং জাতির। তাই সদয় হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

প্রশ্ন হল, বাকি রাষ্ট্রগুলো মুখে কিছু প্রতিবাদ করলেও কেন মূলত, হাত গুটিয়ে আছে? শিশুহত্যা, সাংবাদিক হত্যা, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী হত্যা, হাসপাতাল এবং বিদ্যালয় ধ্বংস নিয়ে কেন আমরা নীরব? শিশু-অধিকার ও শিশুকল্যাণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কেন মুখ খুলছেন না? চিকিৎসক সমাজ কেন প্রতিবাদ করেন না হাসপাতাল ধ্বংসের বিরুদ্ধে? শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা কেন সরব হন না, স্কুল কলেজ ধ্বংসের প্রতিবাদে? সারা পৃথিবীতে এই ধরনের নীরবতা বিস্ময় জাগায়। বোঝা যায়, বর্ণবাদ আমাদের কাছে কতটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য ইউরোপের দেশগুলো দরজা খুলল। খবরের কাগজ ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের মানবতাবাদী চেহারার ঢক্কানিনাদ হল, কিন্তু সহস্র সহস্র আফগান শরণার্থীর জন্য দরজা বন্ধ রইল। শুধু বেছে বেছে অল্প সংখ্যক শরণার্থীকে নেওয়া হল।

নয়া উদারনীতিবাদ গণতন্ত্রকে ক্রমশ স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেছে। বর্ণবাদের এক বড় ভূমিকা আছে এই পরিবর্তনের পিছনে। আধুনিক প্রযুক্তি বর্ণবাদকে আরও শক্ত করেছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় ইজ়রায়েল যে ভাবে গাজ়াবাসীদের উপর যুদ্ধ চালাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধির সাহায্যে বলা হচ্ছে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নাকি কমানো গেছে। অথচ যা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বিপরীত। একটা বড় বাড়িতে যদি এক জন হামাসকর্মী বা প্যালেস্টাইনি রাজনৈতিক কর্মী থাকে, তাকে হত্যা করার জন্য পুরো বাড়ি বা সেই এলাকা, রাস্তাঘাট ধ্বংস করা হচ্ছে। এক ছটাক তেল যদি হামাসের প্রতিরোধ যজ্ঞে কাজে লেগে যায়, তার জন্য কুড়ি লক্ষ লোকের তেল সরবরাহ বন্ধ করা হচ্ছে। পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে। এমন ভাবে বোমাবর্ষণ হচ্ছে, যাতে গাজ়াবাসীরা ফিরে এসে আর নতুন করে জীবন শুরু করতে না পারে। এই সব হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে। সমগ্র গাজ়া ভূখণ্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে খোঁজা হচ্ছে সন্দেহভাজন ও চিহ্নিত গাজ়াবাসীদের অবস্থান, যাতে তাদের হত্যা করা যায়। এ সবই যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ। স্কুল, ধর্মস্থান, উপাসনাগৃহ, দোকানপাট ধ্বংস করা, হাসপাতালের উপর বোমাবর্ষণ, অসামরিক সাধারণ মানুষ হত্যা, শিশুহত্যা, সাধারণ ঘরবাড়ি ব্যাপক ভাবে ধ্বংস করা, এ সব যুদ্ধাপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক শক্তি যদি এগুলো করে, তা হলে ছাড়। ইজ়রায়েলে ভোট হয় তাই ইজ়রায়েল গণতান্ত্রিক, তাই তাদের হত্যালীলা যুদ্ধাপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হবে না। আগেও হয়নি। ইজ়রায়েলের বিচারবিভাগ প্রকাশ্যে বলে, উৎখাত হওয়া প্যালেস্টাইনবাসী ইজ়রায়েলে ফেরত আসতে গেলে সৈন্যবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে। আইনের অনুশাসনের প্রশ্ন তুলে ইজ়রায়েলের উচ্চ আদালত তাতে মানা করবে না। ইজ়রায়েল গণতান্ত্রিক দেশ। তাই বিচারবিভাগের এ সব নিয়ে ভাবার দরকার নেই। বর্ণবিদ্বেষ এবং জাত্যভিমানের এই হল জীবন্ত উদাহরণ।

তবু, এর মধ্যে গাজ়ায় জনজীবন চলছে। প্যালেস্টাইনি সাংবাদিকরা ছোট ছোট তথ্যচিত্র তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিহত হওয়ার আগে রেকর্ড করে যাচ্ছেন ইজ়রায়েল সংঘটিত হত্যালীলা। প্যালেস্টাইনিদের দৃঢ়তা এখনও টিকে আছে। এই দৃঢ়তা টিকে আছে বলে ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী সহমর্মিতা বাড়ছে।

প্রতিরোধ দীর্ঘতর ও দৃঢ়তর হলে তবেই এই বর্ণবাদী আগ্রাসন, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ বন্ধ হবে। হত্যাকারীদের বিচার হবে, প্যালেস্টাইনিদের জাতীয় মুক্তি অর্জিত হবে।

এই যুদ্ধের জয় পরাজয়ের উপর নির্ভর করবে প্যালেস্টাইনিদের জাতীয় মুক্তি পূর্ণাকৃতি নিতে পারবে কি না। ইজ়রায়েল ও তার সমর্থক শক্তিবৃন্দ চাইবে এই যুদ্ধকে গাজ়ায় সীমাবদ্ধ করে, গাজ়াবাসীদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করা। অন্য দিকে, তার বিরোধিতা কতটা ব্যাপকতা অর্জন করবে, তার উপর নির্ভর করে দুর্বলতর শক্তির প্রতিরোধের মাত্রা এবং সাফল্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement