জোশীমঠে রাস্তায় ফাটল। ছবি: পিটিআই।
হাজার মিথ্যে দিয়েও যে একটা সত্যিকে আড়াল করা যায় না, তা নেতা-মন্ত্রীরা আর কবে বুঝবেন? উন্নয়নের নামে তথাকথিত বৈধ ও অবৈধ যথেচ্ছাচার যে কী বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, উত্তরাখণ্ডের দুর্বিপাক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশেষ ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমিকম্প-প্রবণতা, ভূমি ও তুষার ধস, মেঘভাঙা বৃষ্টিতে হড়পা বান, এই সবই পাহাড়ি এই রাজ্যটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কাও। তবে দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক দশক ধরে উত্তরাখণ্ডে একের পর এক বিপর্যয় যত না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে মানুষের নানা অপকর্মের কারণে।
প্রায় প্রতি বারই বিপর্যয়-উত্তর এ রাজ্যের জন্য দেশের সরকার নানা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করলেও তাদের প্রস্তাব ও পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। উন্নয়নের গাজর ঝুলিয়ে সরকারি উদ্যোগেই একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্য দিকে নির্বিচারে নির্মাণ এবং চার ধাম প্রকল্পের চওড়া রাস্তা প্রসারিত হচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে, এমনিতেই ভঙ্গুর পাহাড়কে আরও ভেঙে গুঁড়িয়ে। পরিণতি বিধ্বংসী বিপর্যয়, রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ চরম বিপদের সম্মুখীন।
উত্তরাখণ্ডে ২০১৩-র জুনে বিপর্যয়ের পর রবি চোপড়ার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দলের রিপোর্টে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল অন্তত ২৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার, কারণ রাজ্যে ঘটে চলা বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সেগুলির ভূমিকা। অলকানন্দা ও ভাগীরথীর অববাহিকাতেই রয়েছে ৩৬টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ওই অববাহিকায় চামোলি, পিথোরাগড় ও উত্তরকাশীতে আছে ৩০টিরও বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, ২০১৬ পর্যন্ত অর্ধেকেরও বেশি বিপর্যয় ঘটেছে সেখানে। ২০১৩-র ভয়ঙ্কর বন্যায় প্রায় ছ’হাজার মানুষ মারা যান, ওই অঞ্চলে জলাধার নির্মাণকেই হড়পা বান বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে চিহ্নিত করেছিল জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থা। তবু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালানোর উদ্যমে ভাটা পড়েনি।
আজ শুধু জোশীমঠ নয়, সমগ্র চামোলি জেলা, রুদ্রপ্রয়াগ, পিথোরাগড়, উত্তরকাশী, নৈনিতাল, পৌড়ী, আলমোড়া— প্রায় ন’কোটি মানুষ অধ্যুষিত এ রাজ্যের ৮৫ শতাংশ জেলারই বিপদঘণ্টা বেজেছে। জোশীমঠের ভূগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া তো শুরু হয়েই গিয়েছে। প্রকৃতি যে মানুষের ঔদ্ধত্য সহ্য করে না, সে কথা আমরা ভুলে যাই। নদী, পাহাড় তথা প্রকৃতিকে দখল করার চেষ্টা, নিজেদের মর্জিমাফিক তার চলমানতাকে নিয়ন্ত্রণ করা, প্রকৃতির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই উন্নয়নের বোঝা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ক্রমাগত অবিবেচনা তার সহনশীলতার প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। সেই গ্রাসে এখন পাহাড়ের পথঘাট, মানুষের ঘরবাড়ি, অফিস, দেবালয়ও তলিয়ে যেতে বসেছে।
উত্তরাখণ্ডে ২০১১ সালে মানুষের জন্য পুনর্বাসন নীতি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যপূরণ থেকে তা রয়ে গিয়েছে বহু দূরে। ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, উত্তরাখণ্ড রাজ্য দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে রাজ্যের ৪৬৫টি গ্রামকে চিহ্নিত করেছিল, সেগুলির বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে। এক দশকে মাত্র ৪৪টি গ্রামের পরিবার স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বাকি ৪২১টি গ্রামের হাজার হাজার বাসিন্দা কোন ভয়ঙ্কর পরিণতির জন্য দিন গুনছেন, এখনও তা অজানা। অসহায় পাহাড়ি মানুষের প্রতি সরকারি ঔদাসীন্যের এ এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ।
মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৯-এর নভেম্বরে চামোলির রেনি গ্রামে চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গৌরা দেবীর প্রবীণ পুত্র চন্দর সিংহ রানার ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথা। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে তপোবন-রেনির মর্মান্তিক বিপর্যয় যে আশঙ্কাকে সত্যি করেছিল। ওই বছরেরই জুলাইয়ে চামোলির জেলা প্রশাসন নিরাপদ ভেবে, রেনি গ্রাম থেকে গৌরা দেবীর মূর্তিটি ২৫ কিমি নীচে জোশীমঠ শহরে স্থানান্তরিত করে। সে শহরটিও এখন পাহাড়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার মুখে। পালানোর কোনও পথ নেই। শহরের ন’টি ওয়ার্ডকেই বিপর্যস্ত ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সেখানে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড় ফাটিয়ে ১২ কিমি লম্বা সুড়ঙ্গ তৈরিকেই বিপর্যয়ের কারণ বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। কর্ণপ্রয়াগের বহু বাড়িতেও ফাটল দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠছে ক্রমশ। তাই সরকারকেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে হচ্ছে, বদ্রীনাথ ধামের প্রবেশদ্বার জোশীমঠের তলিয়ে যেতে বসার কথা।
ভূবিজ্ঞানী ও জলবিজ্ঞানীদের সতর্কবাণীকে অগ্রাহ্য করা, বিশেষজ্ঞ কমিটিগুলির প্রস্তাবকে ফাইলবন্দি করে রাখার ঔদ্ধত্য দেখানোর সরকারি প্রবণতার মাসুল গুনতে হচ্ছে পাহাড়বাসীকে— মুশকিলটা এখানেই। কার্য-কারণের স্বতঃসিদ্ধতাকে অস্বীকার যে মূর্খামিরই নামান্তর, এক উত্তরাখণ্ডই বার বার বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ‘মানুষের জন্য উন্নয়ন’ নিশ্চয়ই মানুষের জীবনের বিনিময়ে হতে পারে না। উন্নয়নের জাদুদণ্ড দেবভূমিতে কোনও সৃষ্টির নয়, বপন করে চলেছে ধ্বংসের বীজ।