Suicide

‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’

কিশোর বয়সে আত্মহননের মুখ্য কারণ অনপনেয় হতাশা। অধিকাংশ সময়ে এটি তৈরি হয় পারিবারিক অবহেলা বা অনাদর, অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা কিংবা অপরিণত বয়সে ভালবাসার জটিলতা থেকে।

Advertisement

শুভঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৪৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

আই অ্যাম সরি, পাপা মাম্মি।” শেষ উক্তি ছিল আলিগড়ের কিশোর দক্ষ রাঠৌরের। গত বছর দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ৯৩.৬% নম্বর পেয়েও সে আশাহত হয়। ফল, আত্মহত্যা। প্রতি বছর ঘটে এমন ঘটনা, পৃথিবী জুড়েই। কিন্তু ভারতের পরিসংখ্যান ভীষণ দুশ্চিন্তার। পরিচিত এক কিশোর ছেলে গত বছর আইআইটি-র এন্ট্র্যান্স পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে না-পারার আশঙ্কায় আত্মঘাতী হল। সে পরীক্ষায় খারাপ ফল করেনি— কিন্তু পাশ-ফেল নয়, এখন কাঙ্ক্ষিত শুধু শীর্ষতম সাফল্য। সে আকাঙ্ক্ষা শুধু সন্তানেরই নয়, অভিভাবকেরও— বাড়ির চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে শেষ অবধি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে ছেলেমেয়েরা, এমন উদাহরণ তো কম নয়।

Advertisement

কিশোর বয়সে আত্মহননের মুখ্য কারণ অনপনেয় হতাশা। অধিকাংশ সময়ে এটি তৈরি হয় পারিবারিক অবহেলা বা অনাদর, অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা কিংবা অপরিণত বয়সে ভালবাসার জটিলতা থেকে। এ ছাড়াও পারিবারিক ইতিহাসে জিনগত কারণও উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি যেটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা পরীক্ষায় পাশ-ফেল নয়, চূড়ান্ত সফল হতে না-পারার হতাশা।

ক্রমশই সবাই বিশ্বাস করেছেন যে, সাফল্যের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করতে হলে স্কুল-কলেজের ক্লাসের পড়া যথেষ্ট নয়, প্রাইভেট টিউশন নিতেই হবে। প্রাইভেট টিউশনের ভাল-মন্দ নিয়ে আগেও বিতর্ক কম হয়নি। সম্প্রতি আবার পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষাধিকরণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনের ২৮ ধারায় একই মর্মে ঘোষণা ছিল। তবে, সেই নিষেধাজ্ঞায় যে কাজ হয় না, হবেও না, সে কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

Advertisement

প্রতি বছর মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় স্থানাধিকারীদের অধিকাংশই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সগর্বে জানায়, তাদের প্রায় সব বিষয়ের জন্যই প্রাইভেট টিউটর ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই সে সফল ছাত্রী বা ছাত্রের বাবা-মা, পরিবার-পরিজনের উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য অভিভাবকদেরও ইচ্ছা হয় নিজের নিজের সন্তানদের একই ভাবে সফল করে তুলতে। শুরু হয় ইঁদুর দৌড়, নম্বরের প্রতিযোগিতা। অর্থনীতির সহজ সূত্র ধরে চাহিদা ও সরবরাহের নিত্যনতুন রূপ ধরা দিচ্ছে অলিতে-গলিতে, সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। ইদানীং আর খুচরো প্রাইভেট টিউশনেরও দিন নেই, এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড কোচিং ক্লাস তৈরি করে ফেলেছে এক সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা। বহু ছেলেমেয়েই শুনি এখন স্কুলের খাতায় শুধু নামটুকু লিখিয়ে রাখে— লেখাপড়া যা হয়, সবই কোচিং ক্লাসে।

এই অবধি আলোচনার সূত্র ধরে যদি সমস্যার গোটা ছবিটা বোঝার চেষ্টা করি, তা হলে সেটা এই রকম— যারা ভাল ছাত্র, তারা আরও ভাল, সবার চেয়ে ভাল করার তাগিদে নিজেদের উপর বিষম চাপ তৈরি করছে; কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অভিভাবকের তাড়নায়। স্কুলের বাইরে নাম লেখাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কোচিং ক্লাসে; কখনও শহর ছাড়ছে রাজস্থানের কোচিং রাজধানীতে পড়তে যাবে বলে, যেখানে হস্টেলের ঘরে পাখার চার পাশে গ্রিল লাগানো থাকে, যাতে কেউ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে না পড়তে পারে। যে সব ছাত্র লেখাপড়ায় ততখানি ভাল নয়, পারিপার্শ্বিকের চাপ তাদেরও ঠেলছে কোচিং ক্লাসের বাধ্যবাধকতায়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ছাব্বিশ ঘণ্টাই তাদের চলে যাচ্ছে আরও একটি ভাল রেজ়াল্টের সোনার হরিণ ধাওয়া করতে গিয়ে।

আমেরিকা, কানাডা বা ইউরোপের উন্নত দেশগুলোয় এমন নম্বর-নির্ভর ইঁদুর দৌড়ের প্রাসঙ্গিকতা নেই। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মূলত বিদ্যালয়ের আঙিনায় নির্ধারিত সময়েই সম্ভব করা যায়। গৃহ কাজ দেওয়া হলেও সেটির চাপ সহনীয় সীমার মধ্যে থাকে! বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে পড়ুয়াদের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলির বিকাশ বিঘ্নিত না হয়। খেলাধুলা, অঙ্কন, চিত্র, সঙ্গীত-সহ নানা কোমল বৃত্তি সেখানে বিশেষ প্রাধান্য পায়। আর পেশাগত প্রবেশিকা পরীক্ষার চাপ সে ভাবে না থাকায় প্রাইভেট টিউশনের প্রাসঙ্গিকতা প্রান্তিক।

তা হলে ভারতে এই সমস্যার মূল কোথায়? এক দিকে আছে বিদ্যালয়ের অনুন্নত পরিকাঠামো, ছাত্রের তুলনায় অপ্রতুল শিক্ষকসংখ্যা। অন্য দিকে আছে, বিপুল জনসংখ্যার দেশে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পেশায় ঢুকতে পারার প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়ার বিপুল চাপ। ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করে, এক বার কোনও প্রবেশিকা পরীক্ষার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তে পারলে আর চিন্তা নেই।

অমর্ত্য সেনের একটি বইয়ের শিরোনাম ধার করে তৃতীয় দিকটির কথা বলা যায়— ভারত হল ‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’। পরিপার্শ্ব আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে যে, সেরা না হলেও টিকে থাকতে অসুবিধা হয় না। কাজেই, যে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল অথবা খুব ভাল, তারা সবাই দৌড়চ্ছে আরও ভাল হয়ে ওঠার জন্য। যারা সেই দৌড়ের মাঝপথেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে, তাদের জন্য অবসাদ, অথবা বড় জোর এক দিন খবরের কাগজের পাতায় ছোট একটি আত্মহননের সংবাদ বরাদ্দ। হেরোদের মনে না-রাখাই এই যুদ্ধের ধর্ম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement