—প্রতীকী ছবি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, এক দেশে দু’টি আইন চলতে পারে না। দেশের সকল নাগরিককে একই পরিবারের সদস্যের মতো সমান সুবিধা দিতেই তিনি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাইছেন। এই প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ আইনের কথাও বলেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার শুনে মনে হয়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শুধু মুসলিম মেয়েদের জন্যই দরকার। ২০২২ সালের এপ্রিলে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুসলিম মহিলাদের জন্য, কারণ তাঁরা তাঁদের স্বামীর তিনটে বিয়ে আটকাতে চান।
এ দেশে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ (যারা হিন্দু সিভিল কোড আইনের আওতায়) ছাড়াও পারিবারিক আইনের আওতায় খ্রিস্টান, পার্সি যেমন রয়েছে, তেমনই বহু জনজাতিও রয়েছে। তবে মুসলিম পারিবারিক আইনের সংস্কার চেয়ে দেশে বেশ কিছু সংগঠন আন্দোলন করছে। তাদের দাবি, পারিবারিক আইনে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে। সপ্তম শতাব্দীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যে আইন জরুরি ছিল, এ যুগে তার সংস্কার দরকার, সেটা বুঝেছে বিশ্বের বহু মুসলিম, বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। ১৯৪৬ সালে মিশরে ‘ল অব টেস্টামেন্টারি ডিসপোজ়িশন’ প্রবর্তন করা হল, উত্তরাধিকারে মেয়েদের আরও সুবিধা দান করে। এই আইনের বিধান ১৯৫৩ সালে সিরিয়ায়, ১৯৫৭ সালে টিউনিজ়িয়ায় এবং ১৯৫৮ সালে মরক্কোতে গৃহীত হয়েছে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার হয়েছে। কিন্তু ভারতে এই আইন সংস্কারের দাবি তুললেই ‘ধর্মের নামে রাজনীতিকরণ’-এর ফাঁদে আটকে যাচ্ছে।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইন প্রণয়নের ইতিহাসের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়, আইন তৈরি হয় বাস্তব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই। কাজী আবদুল ওদুদ কোরানের অনুবাদে নারী-সম্পর্কিত বিধিনিয়ম সম্বলিত ‘সূরা-আন-নিসা’ অংশটি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ওহোদের যুদ্ধে সাতশো মুসলমান যোদ্ধার মধ্যে সত্তর জন নিহত হলে নারী আর অভিভাবকহীন ছেলে-মেয়ে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই সূরায় বিবাহের বিধিনিষেধ সম্বন্ধে, আর নারীদের ও অনাথদের সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে।
বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, বিধবা বিবাহ, সম্পত্তির অধিকার সম্বলিত মুসলিম পারিবারিক আইন সবটাই গঠিত বাস্তবের অনুষঙ্গে। দৃষ্টান্ত মজুত। কিন্তু এ দেশের মুসলিম মৌলবাদ অনড়। তারা শাহবানুর আন্দোলনের শরিক হয় না। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন যে পাঁচ মহিলা, তাঁদের সমস্যা মুসলিমদেরই সামাজিক সমস্যা। তবু তা রদ করার জন্য মুসলিম-সমাজ এগিয়ে এল না। এই রক্ষণশীলতা মুসলিম মহিলাদের দাবি পূরণের প্রধান অন্তরায়। তবু রাজনৈতিক দলগুলো ভোট-বৈতরণি পেরোতে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলিকেই হাওয়া দিয়ে চলেছে। মুসলিম মৌলবাদের অটল মনোভাব এ দেশের মুসলিমদের আরও বিপদের মুখে ফেলছে। সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই পারিবারিক আইন সংস্কারের জোরালো দাবি উঠলে মোদী সরকার মুসলিম মহিলাদের আইন সংস্কারের প্রয়োজনকে সামনে রেখে উস্কানিমূলক কথা বলতে পারত না।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে বাধা দিচ্ছে মুসলিম নেতাদের বিরোধিতা, এমন বার্তা সংখ্যাগুরুদের মজ্জায়-মননে প্রবেশ করাতে পারলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। খ্রিস্টান, পার্সি, জনজাতি, এমনকি সংখ্যাগুরু হিন্দু সকলেই কি চাইছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি? সবার এক আইন— ভাবলে ভাল লাগে। কিন্তু কী সেই আইন? মনুসংহিতা যাদের জীবনের সঙ্গী, তারা দেশকে কোন আইন উপহার দেবে? তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে। হিন্দু কোড বিল পাস করাতে হয়েছে হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে। যাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য মন্দির আর হিন্দু ধর্মের উৎসব, তাদের হাতে তৈরি হবে লিঙ্গ সাম্যের আইন?
বিজেপি সরকার ও তার দল ধারাবাহিক ভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। ভারতের মানুষ শুনল, মুসলমানরা নমাজ পড়ে কোলাকুলি করে, ওতেই করোনা ছড়িয়েছে। শুনল, ভালবাসাও ‘জেহাদ’। মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়েকে ভালবাসতে পারবে না। ২০২২ সালে বিজেপি পরিচালিত কর্নাটকের মন্দিরের সামনে বহু দিন ধরে ব্যবসা-করা মুসলিম ফল ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। দরিদ্র মুসলমানকে খুন হতে হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলার জন্য। গরুর মাংস আছে ফ্রিজে, সন্দেহে মুসলমান যুবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ করার নামে ফৌজদারি আইন তৈরি হয়েছে। পুরুষটিকে জেলে পাঠিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, কিন্তু তার স্ত্রীর সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভাবা হয়নি। ১৫ অগস্ট ২০২২, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ভাষণে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছিলেন, একই দিনে গুজরাতের বিলকিস বানোর ১১ জন ধর্ষক মুক্তি পায়। আর হিন্দুত্ববাদী দল তাদের ফুল-মালায় বরণ করে নেয়। এই কি নারীর ক্ষমতায়ন? এই কি সকলের জন্য এক উদার বিধি? বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যন্তর মন্তরে অবস্থানরত মহিলা কুস্তিগিরদের কথা কি আমরা তা হলে ভুলে যাব?