বিপুল দুর্নীতি এবং বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের একের পর এক মামলা নিয়োগ-পদ্ধতিকে ভয়ানক জটিল করে তুলেছে। ফাইল চিত্র।
এ রাজ্যের সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে শিক্ষকদের চাকরির ‘পোস্টিং’ দেওয়ার পদ্ধতি এবং বদলি-ব্যবস্থা দুটোই শুরু থেকেই ভীষণ রকম বৈষম্যমূলক এবং গোলমেলে। বৈষম্যের সূচনা হয়েছিল ২০০৭ সালে, যে বছর পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন চাকরি-প্রাপক শিক্ষকদের জন্য কাউন্সেলিং-ব্যবস্থা চালু করল। এর আগে পরীক্ষায় সফলদের লটারির মাধ্যমে ‘র্যান্ডমলি সিলেক্ট’ করে পোস্টিং দেওয়া হত। দুর্জনে অবিশ্যি বলে, লটারি-ফটারি বাজে কথা, পোস্টিং স্থির হত মূলত রাজনৈতিক আনুগত্য এবং সুপারিশের ভিত্তিতে। স্বভাবতই তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রচুর কথা উঠতে থাকে। তখন চালু হয় ওই ‘কাউন্সেলিং’-ব্যবস্থা, যাতে সফল পরীক্ষার্থীদের সামনে শূন্যপদ-যুক্ত স্কুলের একটি তালিকা দেওয়া হত এবং প্রার্থীরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দমতো স্কুল বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। ব্যবস্থাটা চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক, কারণ কোনও সরকারি চাকুরেই কোনও দিন গ্রামে থাকতে চান না। এমনকি তাঁরা গ্রামের বাসিন্দা হলেও নয়। চাকরিজীবী সচ্ছল মধ্যবিত্তরা সব সময়ই নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য পেতে চান। সন্তানের জন্য ভাল ইংলিশ মিডিয়াম, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের উন্নত মানের চিকিৎসা ইত্যাদি সবই তো শহরে। তাই চাকরি-প্রাপকদের তালিকার উপর দিকে থাকা তুলনামূলক অধিক যোগ্য এবং মেধাবী প্রার্থীরা সকলেই বেছে নিতে লাগলেন শহরের দিকের স্কুলগুলি। গ্রামের জন্য পড়ে রইলেন তালিকার নীচের দিকে থাকা লোকজন।
নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে শিক্ষক-শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করতে ‘জেনারেল ট্রান্সফার’ চালু করল। কিন্তু ‘বিসমিল্লায় গলদ’ হল সেখানেও। আবারও একই ভাবে শূন্যপদের একটি তালিকা প্রকাশ করে বদলি নিতে আগ্রহী শিক্ষকদের সেখান থেকে কর্মস্থল বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। দেখা গেল, শূন্যপদের বেশির ভাগ গ্রামের দিকে আর বদলি নিতে ইচ্ছুকদের গতি সেই শহরমুখী। সাধারণ বদলি বন্ধ করে দেওয়া হল। চালু রাখা হল কেবলমাত্র আপস বদলি এবং গুরুতর অসুস্থতাজনিত ‘বিশেষ বদলি’-র ব্যবস্থা। দেখা গেল, খুবই অদ্ভুত ভাবে দলে দলে শিক্ষক ওই ‘অসুস্থতাজনিত বিশেষ বদলি’ নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো স্কুলে যোগ দিচ্ছেন। দুষ্টু লোকে বলে, সে সময় গুরুতর অসুস্থ থাকার প্রমাণ হিসেবে কোনও ‘মেডিক্যাল পেপার’ নয়, জমা দিতে হত মোটা অঙ্কের প্রণামী। ‘অসুস্থতাজনিত’ বদলি নিয়ে দুর্নীতিটা বাড়াবাড়ি আকার ধারণ করায় এবং ছোট-বড়-মেজো নেতার সুপারিশের জ্বালায় অস্থির হয়েই নাকি শিক্ষা মন্ত্রকের তরফে ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল চালু করা হয়। এই নতুন ব্যবস্থায় মাত্র পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে এবং বাড়ি থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটারের বেশি হলেই বদলির সুযোগ দেওয়া হল। এই চূড়ান্ত অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থায় যা হওয়ার তা-ই হল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই দেখা গেল গ্রামের দিকের স্কুলগুলোর টিচার্স-রুম প্রায় খালি। সবাই ভিড় করেছেন শহরে। কলকাতা শহরের আশেপাশে এমন অন্তত খানপঞ্চাশেক স্কুলের তালিকা এই মুহূর্তেই দিতে পারি, যাতে সর্বমোট ছাত্রসংখ্যা একশোর কম, অথচ সেখানে শিক্ষকের সংখ্যা কুড়ির বেশি।
বাম আমল হোক বা তৃণমূল জমানা, নিয়োগ হোক বা বদলি, সমস্ত ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের ব্যক্তিগত পছন্দকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় কেন? আর কোনও সরকারি চাকরি কি আছে, যেখানে ‘পোস্টিং’ বা ‘বদলি’-র আগে কর্মচারীদের নিজেদের কর্মস্থল বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়? নিজের বাসগৃহের কাছে স্কুল হলে শিক্ষকরা তুলনামূলক ভাল পড়াবেন— এমন কোনও তথ্য আছে কি? বরং উল্টোটাই। বছরের পর বছর চেনা পরিবেশে, চেনা লোকজনের মধ্যে কাজ করার ফলে এক রকমের স্থিতাবস্থার শিকার হয় মানুষ, তাতে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে, মানসিক জড়ত্বও কাবু করে। কিছু দলগত কায়েমি স্বার্থও মাথা চাড়া দিতে থাকে।
শুরু থেকেই যা দরকার ছিল তা হল বাধ্যতামূলক এবং চক্রাকার বদলির ব্যবস্থা। যেমনটা পুলিশ বা ব্যাঙ্ককর্মীদের ক্ষেত্রে করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ডাক্তারির মতো চাকরি জীবনের অন্তত বছর পাঁচেক গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক করা দরকার। শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া কারও জন্যই ছাড় থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
রাজ্য জুড়ে এই মুহূর্তে শিক্ষক-শূন্যপদের সংখ্যা বিপুল, এবং তার বেশির ভাগই গ্রামাঞ্চলে। নতুন শিক্ষক নিয়োগের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। বিপুল দুর্নীতি এবং বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের একের পর এক মামলা নিয়োগ-পদ্ধতিকে ভয়ানক জটিল করে তুলেছে। আমরা যেন না ভুলি, এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী কিন্তু এখনও গ্রামের স্কুলগুলোতেই রয়েছে। তাই যে ভাবেই হোক সেখানে শিক্ষকদের পাঠানো দরকার। ‘শিক্ষক-স্বার্থ’ নয়, অগ্রাধিকার দিতে হবে ‘ছাত্র-স্বার্থ’কেই। রাজনৈতিক সুপারিশ বা হস্তক্ষেপের অবকাশ না রেখে এবং ভোটের মায়া ত্যাগ করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক বদলির নীতি প্রণয়ন জরুরি। দীর্ঘ দিন শহরের স্কুলে চাকরিরত শিক্ষকদের নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের মায়া ত্যাগ করে গ্রামে যেতে হবে, নইলে এ রাজ্যে শিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা ঠেকানোর আর কোনও উপায়ই থাকবে না।