ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-তে (এনসিআরবি) ২০২১-২২ সালে ৬৪,৪৭১টি পরিবেশ অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। প্রতীকী ছবি।
ভারতে পরিবেশ অপরাধের ছবিটি কেমন? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-তে (এনসিআরবি) ২০২১-২২ সালে ৬৪,৪৭১টি পরিবেশ অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে অরণ্য বিধি এবং অরণ্য সংরক্ষণ বিধির অধীনে নথিভুক্ত হয়েছে ২,২৯২টি পরিবেশ অপরাধ। অরণ্য বিধির অধীনে সবচেয়ে বেশি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, চণ্ডীগড়, গুজরাত, ঝাড়খণ্ড, পঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, বিহার, অসম ও উত্তরপ্রদেশে। এরই মধ্যে ভারতের অন্য ১০টি রাজ্যে অরণ্য বিধি ভাঙার নথিভুক্তির ঘটনা কমেছে। এই রাজ্যগুলি হল মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মেঘালয় ও তেলঙ্গানা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ, এই চারটি রাজ্যে অরণ্য বিধির অধীনে পরিবেশ অপরাধের ৮৫% ঘটনা নথিভুক্ত হয়।
একটি অতি দুশ্চিন্তার খবর হল, ইদানীং বন্যপ্রাণ চোরাকারবারিরা ইন্টারনেটে শতাধিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বেআইনি ব্যবসা দিন-দিন বাড়িয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এ তথ্যটি জানিয়েছে। বহু নামজাদা ওয়েবসাইটও এই তালিকায় রয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বছরে এই চোরাশিকারের ব্যবসার আর্থিক পরিমাণ ২৩০০ কোটি ডলার।
ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ কনজ়ার্ভেশন সোসাইটি-র কাউন্টার ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাফিকিং দল ২০২০ সালে অনলাইনে প্রাপ্য সব ক’টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বন্যপ্রাণ চোরাকারবারের উপর এক প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদনে ২০২০ সালে ভারতের ৫২২টি বন্যপ্রাণ চোরাশিকার ও চোরাকারবারি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (৮৯টি) চোরাশিকার ও চোরাকারবারের ঘটনা ঘটেছে খুরযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে।
বন্যপ্রাণ অপরাধ রুখতে ভারত সরকার ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সাউথ এশিয়া ওয়াইল্ডলাইফ এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক-এর বিধি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আরও ৭টি দেশ, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মলদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা-র সঙ্গে মিলে আন্তঃসীমান্ত বন্যপ্রাণ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবে।
ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশে চোরাশিকারের রমরমা সত্ত্বেও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কাজে অর্থবরাদ্দের পরিমাণ কমিয়েছে। যেমন, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ সালে বন্যপ্রাণীদের বাসভূমি উন্নয়নে বরাদ্দ কমেছে ৪৭%, বাঘ প্রকল্পে কমেছে ৪০% এবং হাতি প্রকল্পে কমেছে ১৬%। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য (৯ অগস্ট, ২০২১) অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০২১, এই সময় কালে ভারতে মোট ৫৭৯টি বাঘ মারা পড়েছে। বিগত ৭ বছরে হাতি মারা পড়েছে ৬৯৬টি।
কোভিড-১৯ রুখতে ভারতে যখন লকডাউন চলছিল, তখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছিল। পৃথিবী জুড়ে বন্যপ্রাণ ব্যবসা তদারককারী সংস্থা ট্রাফিক-এর এক প্রতিবেদনে লকডাউনের আগের ছ’সপ্তাহ (১০ ফেব্রুয়ারি–২২ মার্চ, ২০২০) এবং লকডাউন চলাকালীন ছ’সপ্তাহের (২৩ মার্চ–৩ মে, ২০২০) এক তুলনামূলক ছবি তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে যে, আলোচ্য সময়টিতে চোরাশিকারের ঘটনা ৩৫ থেকে বেড়ে ৮৮ হয়েছে। বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিধি-র অন্তর্গত তফসিল-১ প্রাণীদের চোরাশিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে। প্রাক্-লকডাউন পর্বের ২২টি চোরাশিকারের ঘটনা লকডাউন কালে বেড়ে ৩৭ হয়েছিল। চোরাশিকারের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে তফসিল-৩’এর অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে। প্রাক্-লকডাউন পর্বের ৫টি ঘটনা লকডাউনে বেড়ে দাঁড়ায় ২৮টিতে। লকডাউন কালে এ সমস্ত চোরাশিকারের ঘটনা প্রাক্-লকডাউন কালের তুলনায় প্রায় ১৫১% বেড়েছিল। অবশ্য এ সব বেআইনি কারবারি পরিবেশ অপরাধীদের পুলিশি ধরপাকড়ের সংখ্যাও প্রাক্-লকডাউন পর্বের ৮৫ থেকে বেড়ে লকডাউন কালে ২২২-এ দাঁড়িয়েছিল।
ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে যে, লকডাউনে যত চোরাশিকার হয়েছে, তার ৪৪% খুরযুক্ত প্রাণী। এদের পরেই হয়েছে বানর, প্যাঙ্গোলিন, বড় কাঠবিড়াল, ভাম, খরগোশ, ছোট বনবিড়াল ও শজারু-র চোরাশিকার। এ সব প্রাণীর চোরাশিকার প্রাক্-লকডাউন কালের ১৭% থেকে বেড়ে লকডাউনে ২৫% হয়েছিল। এই প্রাণীগুলিকে মূলত হত্যা করা হয়েছিল তাদের মাংস খেতে এবং স্থানীয় ব্যবসার জন্য। কারণ, এ সময়ে যানবাহন চলাচল ও বাজার বন্ধ থাকায় দেশের অন্যত্র বা বাইরের দেশে পাচার করা সম্ভব ছিল না।
ট্রাফিক আরও জানাচ্ছে যে, লকডাউনে বাঘ চোরাশিকারের ঘটনা বাড়েনি, তা ছিল দেশের মোট চোরাশিকারের ২০% (লকডাউনের আগেও তা-ই ছিল)। পাখি চোরাশিকার এ সময়ে ১৪% থেকে কমে ৭% হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, কিছু বড় জাতের পাখিকে এ সময়ে শিকার করা হয় তাদের মাংস খাওয়ার জন্য। কচ্ছপ চোরাশিকার হয়নি। সামুদ্রিক প্রাণীদের চোরাশিকার প্রাক্-লকডাউন পর্বের ১১% থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১%।
পরিবেশ বিষয়ক চিন্তার মধ্যে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রসঙ্গটি আদৌ গুরুত্ব পাচ্ছে কি?