Coronavirus in India

আপাতত যে ভাবে লড়তে হবে

বাজারে-দোকানে, জনসভায় যে ভাবে মাস্কহীন জনগণ ভিড় জমিয়েছেন, মাস্ক পরার কথা বললে যে ভাবে তির্যক উত্তর দিয়েছেন, তার পর সচেতনতার আশা না করাই ভাল।

Advertisement

বিষাণ বসু

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪২
Share:

দেশে ও রাজ্যে কোভিড পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। মৃত্যুর সংখ্যায় কোমর্বিডিটি তত্ত্বের প্রলেপ এখনও শুরু হয়নি, আপাতত ভোট নিয়ে ব্যস্ততা। সরকারি কোমর্বিডিটির তত্ত্ব যেমন, ক্যানসার-আক্রান্ত কেমোথেরাপি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলে দুর্ঘটনাকে মৃত্যুর কারণ না বলে ক্যানসারকেও ধরা যায়— মৃত ব্যক্তি হয়তো কেমো নিয়ে দুর্বলতার কারণেই গাড়ির হর্ন শুনতে পাননি। প্রসঙ্গটা তুললাম, কেননা কাগজের প্রথম পাতায় এ-রাজ্যে মোট কোভিড-মৃত্যুর খতিয়ানে আশি শতাংশের অধিকই নাকি কোমর্বিডিটি-জনিত।

Advertisement

আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যার চাইতেও হাসপাতালে বেডের জন্যে হাহাকারটা আতঙ্কের। এবং এটা সবে সঙ্কটের শুরু। দায়-দোষারোপের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এখন কী করণীয়? গত এক বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পারেনি। যদি পারত, তা হলে বুঝতাম, কাজ মূলত তিনটে।

এক, জরুরি ভিত্তিতে পরিকাঠামোর উন্নতি। কাজটি রাতারাতি হওয়ার নয়। গত মাস ছয়েক ধরে কোভিড ব্যাপারটাকে ভুলে না থাকলে অনেকটা কাজ করে রাখা যেত। সে-সব কিছুই হয়নি। লোহার খাট বিছানা, পাশে স্যালাইনের বোতল ঝোলানোর স্ট্যান্ড দিলেই কোভিড-চিকিৎসার উপযুক্ত শয্যা হয় না। অন্তত অক্সিজেনের ব্যবস্থাটুকু জরুরি। দেশের অপরিণামদর্শী সরকার গত বছর প্রায় দশ হাজার টন অক্সিজেন রফতানি করেছে, এখন দেশের সর্বত্র অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। এ-রাজ্যেও সমস্যা অনিবার্য। এমতাবস্থায় নতুন করে হাজারটা কোভিড-বেডের গল্প নিষ্ঠুর রসিকতার মতো শোনায়।

Advertisement

পরিকাঠামোর অন্যতম অঙ্গ মানবসম্পদ। এ-দেশে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী যে প্রয়োজনের অনুপাতে অপ্রতুল, সেটা সকলেই জানেন। সঙ্কটকালে সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর কোভিডের শুরুতেই বড় মাপের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ছড়ানোর কারণে। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সবাইকে যদি একই সঙ্গে ডিউটি করানো হয়, এমনটি অবশ্যম্ভাবী। শুরুর সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে পরে ভাগ করে ডিউটি করানো হয়েছিল, বড় অংশের স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল বন্ধ হওয়ার উপক্রম আর হয়নি। এ-দফায় সরকারি অফিসে পঞ্চাশ শতাংশ উপস্থিতির নির্দেশিকা জারি হলেও সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সবাইকে একসঙ্গে ডিউটি করানো চলছে। বড় সঙ্কট আসন্ন (দিল্লিতে যা শুরু হয়েছে)।

দুই, জনসচেতনতা। বাজারে-দোকানে, জনসভায় যে ভাবে মাস্কহীন জনগণ ভিড় জমিয়েছেন, মাস্ক পরার কথা বললে যে ভাবে তির্যক উত্তর দিয়েছেন, তার পর সচেতনতার আশা না করাই ভাল। তদুপরি একশ্রেণির বিজ্ঞ কোভিডের বিপদকে লঘু করে দেখিয়ে, সুরক্ষাবিধিকে বার বার গুরুত্বহীন বলে বিপদ গভীরতর করেছেন।

যাঁরা সুরক্ষা বিধি মেনে চলেছেন, তাঁরা নতুন করে সংশয়ে— কোভিড নাকি বায়ুবাহিত এবং বর্তমান সুরক্ষা বিধি নাকি সে ক্ষেত্রে অকার্যকর? বায়ুবাহিত হোক বা না হোক, ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানো বন্ধ হয়নি। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ ড্রপলেটের মাপটি পূর্বানুমানের তুলনায় ছোট, বাতাসে সেই ড্রপলেট মিশবেও সহজে, সংক্রামিতের হাঁচি-কাশি না হলেও ভাইরাস পার্টিকল বাতাসে মিশতে পারে, সাধারণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মুহূর্তেও ভাইরাস পারিপার্শ্বিকে মিশে যেতে পারে, পার্টিকল বাতাসে থাকবেও দীর্ঘ ক্ষণ। কাজেই মাস্ক পরুন, অনেকটা সুরক্ষা মিলবে। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে জানলা খোলা রাখলে দখিনা বাতাস এসে আপনাকে কোভিড দিয়ে যাবে কিংবা সন্ধেবেলার মশার মতো করে জানলা দিয়ে করোনাভাইরাস উড়ে আসবে। বদ্ধ জায়গায়, এসি ঘরে বেশি লোক জড়ো হলে বিপদ। খোলামেলা জায়গায় বিপদ তুলনায় কম, গাদাগাদি ভিড় হলে বিপদ বেশি। পার্টিকল-এর সাইজ আরও ছোট, মাস্ক পরার ব্যাপারে সচেতন ও নিখুঁত হতে হবে। দূরত্ব রাখা, আঁটসাঁট মাস্ক পরা, বন্ধ বাতানুকূল ঘরে একত্রে হইহই এড়ানো, অরক্ষিত হাত নাকে-মুখে না দেওয়া, এ-সব সাধারণ সুরক্ষা বিধি মেনে চলা জরুরি।

তিন, গণ টিকাকরণ। এই পরিস্থিতিতে টিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য, অথচ টিকা নিয়ে প্রবল সংশয়। চিকিৎসা গবেষণার সিংহভাগ কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে, বহুজাতিক কর্পোরেট মুনাফা নিয়ে ভাবিত, যে কোনও সঙ্কট মুনাফার নতুনতর সুযোগ, এ-সব সত্যি। কিন্তু তাতে টিকার গুরুত্ব কমে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা বেশি। মারণশক্তি হ্রাস পাক বা না পাক, বহু মানুষ সংক্রামিত হলে নড়বড়ে পরিকাঠামোয় মৃত্যুহার বাড়বেই। এ অবস্থায়, আংশিক কার্যকর টিকাও সঙ্কট কমাতে পারে। বিপদের দিনে টিকার ট্রায়ালের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে গভীর আলোচনা বিবেচনার কাজ নয়।

কোভিড কোনও গুজব নয়, এক মস্ত বড় বিপদ। আপাতত সঙ্কট থেকে উদ্ধারের রাস্তা উপরের তিনটিই। বিপদ কাটিয়ে ওঠার পরে না হয় অন্যান্য আলোচনায় বসা যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement