সংস্কৃতির দুধ ছেড়ে শুধু জলটুকুই শুষে নিয়েছে বাঙালি
Demerits of Audio-Visual Medium

যাহা পায় তাহা খায়

এখন পট-পরিবর্তনের পর অবশ্য নতুন সাপ্লাইও বাজারে এসে গেছে। ‘জনপ্রিয়’ লেখালিখির জগৎ কাঁপাচ্ছে ভূত-প্রেত-তন্ত্র-মন্ত্র।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:০৬
Share:

যাপনচিত্র: নববর্ষের রঙিন উৎসব, ঢাকায়। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

বাঙালি জাতে উচ্চমার্গের হাঁস, কিন্তু তালে সাক্ষাৎ জ়াকির হুসেন হওয়ায়, সে দুধটা ছেড়ে দিয়ে কেবল জলটা মনোযোগ দিয়ে খায়। বাংলা টিভি চ্যানেলের তরজা শুনলেই প্রতীতি হয়, বাঙালি অশোক মিত্র থেকে নিয়েছে কেবল ‘আমি ভদ্রলোক নই’ উক্তিটুকু। নবারুণ ভট্টাচার্য থেকে ছেঁকে তুলেছে স্রেফ অপশব্দের ব্যবহারবিধি। যাত্রাপালা থেকে বেছেছে তারস্বর, আর তরজাগান থেকে স্রেফ খেউড়ের অংশটুকু।

Advertisement

বাঙালি সাহিত্যে স্বপনকুমার। সত্যজিৎ রায় জীবনে বহু উচ্চমার্গের জিনিস সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আজকের জনপ্রিয় রহস্যকাহিনি দেখলেই টের পাওয়া যায়, ধেড়ে জনতা তার থেকে ছেঁকে নিয়েছে স্রেফ কিশোরপাঠ্য ফেলুদাটুকু। সেই সোজা-সরল আখ্যান টুকেই লেখা হচ্ছে হাজার-গন্ডা চিত্রনাট্য, গম্ভীর রহস্যোপন্যাস। সেগুলো অবশ্য ফেলুদার ধারে-কাছেও যায় না, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হল, ফেলুদার গপ্পেও যে ধরনের রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনিকে নিয়ে নির্মম ঠাট্টা-তামাশা করা হয়েছে, ‘ভ্যাঙ্কুভারের ভয়ঙ্কর’ জাতীয় সেই সব গপ্পোগাছা এখন বেস্টসেলার তকমা নিয়ে লেখালিখির মূলধারায়। এ সব লেখায় চিন্তাভাবনার প্রশ্নই নেই, গবেষণা তো নেই-ই, বরং যত্রতত্র নরখাদক জনগোষ্ঠী পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে-সেখানে অ্যাটম বোমা ঘাড়ে করে নিয়ে ফেলে আসছে ভিলেন। যে ধরনের উদ্ভট রহস্যকাহিনি আগে কিশোর-কিশোরীরা গোগ্রাসে গিলত আর বড়রা কাণ্ড দেখে মুচকি হাসতেন, সেই একই কাটিংয়ের বস্তু এখন বড়রা গিলছেন, আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, থ্রিলার-লেখকরা রোলমডেল হিসেবে বেছে নিয়েছেন জটায়ু ওরফে লালমোহনবাবুকে।

সিনেমায় বাঙালি অবশ্য আরও এক কাঠি উপরে। এ তল্লাটের গগনবিদারী-খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতারা বিশ্বসংসার থেকে নিয়েছেন কেবল হিন্দি-ইংরেজির উপরচালাকিটুকু, আয়ত্ত করেছেন কী করে বাংলা প্রায় না-জেনে বাংলায় অভিনয় করা যায় তার নিনজা টেকনিক। পরিচালক ইংরেজি ছাড়া একটা বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারছেন না, অভিনেতা ‘বাংলা প্রায় বলতেই পারি না’ ভাবে বিভোর, লিট-ফেস্টে আলোচক বাংলা বই নিয়ে বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে তেড়ে ইংরেজি বলছেন, এ সব চার দিকে। সর্বত্র ‘আমি কত কম বাংলা জানি’ তার সগৌরব প্রদর্শনী। এত কম বাংলা জেনে কী করে বঙ্গসংস্কৃতি-জগৎ আলো করা যায় তা কোনও রহস্য না, কারণ মাইকেল মধুসূদনের জীবনের প্রথম অংশেই তার উত্তর আছে: ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’ জাতীয় বিচ্ছিরি এপিসোড অবশ্যই বাদ।

Advertisement

আর সিরিয়ালে? এক-একখানা পরিবারের অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, ও-দিকে পুরুষমানুষ-পিছু অন্তত খানদুই বৌ। এ দিকে মেয়েরা ট্যাঙ্কটপ পরে ডিস্কো নাচছে, ও-পাশে সিঁদুরের রং অমূল্য। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, ঘটনার ঘনঘটায় পৃথিবী অন্ধকার। চরিত্ররা জামদানি-বালুচরি-তাঁত ছেড়ে উত্তর ভারতীয় ঝিকিমিকি শাড়ি পরে ঘুরছে, তাদের সংলাপে এক-একটা পাঞ্চলাইনে বারপাঁচেক ইকো, পিছনে বাজছে জনপ্রিয় হিন্দি গান। বাংলা গান অবশ্য এমনিও আর শুনতে পাওয়া যায় না। গানের রিয়্যালিটি শো-তে এন্তার হিন্দি, এফএম-এ বাংলা আতশকাচ দিয়ে খুঁজতে হবে। বাঙালি হিন্দিকে বেছে নিয়ে খুশি, তাই সিরিয়ালের মেধাবী চিত্রনাট্যকাররা নাগাড়ে ও নির্বিবাদে টুকছেন নব্বই আর শূন্য দশকের কে-সিরিজ়কে।

এ সবই গড়গড়িয়ে অবাধে নীচের দিকে চলেছে এবং কারও তেমন হেলদোলও নেই, তার কারণ বাঙালি বিশ্ববীক্ষায় প্রায় কার্ল মার্ক্স। এই সব কিছু যে ক্রমশ লাটে উঠতে চলেছে, তার ব্যাখ্যা হিসেবে সে বেছেছে একটাই জিনিস— হুঁ হুঁ, এ সব প্রোলেতারিয়েতের সংস্কৃতি। বছর পঞ্চাশ আগে জঞ্জির বা দিওয়ার-এর উত্থান সম্পর্কে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যান শুনলে একটা কথাই বোঝা যায় যে, ওগুলো নিচুতলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছে। ব্যস, ওখানেই খেল খতম। নিম্নবর্গের ছোঁয়া আছে, অতএব অখাদ্য জিনিসকে প্রাণনাথ বলতে হবে, বিচ্ছিরি গানকে আত্মার শান্তি, খারাপ সিনেমাকে জনপ্রিয় বলে মহিমান্বিত করতে হবে। যে শ্রমজীবী মানুষ সন্ধেয় অমিতাভ বচ্চনের দু’টি ডায়ালগ শুনে আমোদ পাচ্ছেন তাঁর সংস্কৃতিই বাংলার সংস্কৃতি, অতএব মধ্যবিত্ত বাঙালিও ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ জাতীয় তৃতীয় শ্রেণির ডায়ালগ শুনে তালিয়া দিয়ে আসছে, গানের জলসা ছেড়ে ‘হোপ-৮৬’এর নব আনন্দে জাগছে, একতা কপূরকে শিল্পের চূড়ান্ত বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। মুম্বইয়ের হিরোদের ধরে আনছে চলচ্চিত্রোৎসব উদ্বোধনে, পঠান দেখে পয়সা ছুড়ছে, কিছু তৃতীয় শ্রেণির অভিনেতার মঞ্চে উঠে দু’টি উদ্ভট ডায়ালগ ঝাড়াকেই বিনোদন বলে দাবি করছে। প্রোলেতারিয়েতের রুচি নিয়ে ফাজলামি নয়।

এ ব্যাপারে বাঙালি জ্ঞানপাপীও। কারণ অন্যত্র তার নাকটি উঁচু, আঁতলামিতে অতলান্তিক; সে বিলক্ষণ জানে যে, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি নিচুও না, অত সহজ বা সস্তাও না। বাউল বলতে সে অজ্ঞান, লোকসংস্কৃতি নিয়ে তার আদিখ্যেতার শেষ নেই। কিন্তু গলা-সাধার বালাই নেই বলে বাউল ফেস্টে তারস্বরে চিৎকারকেই আপাতত সে সঙ্গীত মনে করে। বাউল থেকে সুফি, এরা যে দীর্ঘ কৌশল ও দর্শন-চর্চার ফসল, সেটা সুবিধামতো তার হিসাব থেকে বাদ। এটাও সে বিলক্ষণ জানে যে, একটা জিনিস নীচের তলার মানুষের ভাল-লাগা মানেই সেটা নিম্নবর্গের সংস্কৃতি নয়— এক জন অভুক্ত মানুষকে ঘাস সেদ্ধ করে তেল-নুন দিয়ে মেখে দিলে, সেটাই সে গপগপ করে খেয়ে নেবে, কিন্তু তার মানে এই না যে ওটা সুষম খাদ্য, বা অভুক্ত মানুষের পছন্দের খাবার। কিন্তু জানলে কী হবে, রণজিৎ গুহ থেকে জ্ঞানপাপী বাঙালি বেছে নিয়েছে স্রেফ ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটা। ভুখা দর্শকের চাহিদা নিয়ে তার থোড়াই কোনও দাবিদাওয়া আছে!

নিম্নবর্গ হোক বা ভদ্রলোক, বাঙালি দর্শক মূলত ভুখা, হুজুগে এবং হাড়হাভাতে। সে ‘ফরেন’ ছাপ দেখলেই হাঁ করে থাকে, ডিস্কো-লাইট দেখলে চোখ ট্যারা করে ফেলে, এবং একেই সে সাংস্কৃতিক ঔদার্য বলে। নানা পট-পরিবর্তনে তার নানা আকাঙ্ক্ষা জাগে, এবং সে হাতের কাছে সাপ-ব্যাঙ যা পায় তা-ই খায়। জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭-এ প্রথম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, আর হাতের কাছে অন্য কিছু না পেয়ে সে বছরই বাঙালি সুপারহিট করে দিয়েছিল শাপমুক্তির গপ্পো বাবা তারকনাথ-কে। তার পর সেই বস্তু চলতে থাকে লাইন দিয়ে। ‘আজ তোমার পরীক্ষা, ভগবান’ বাজতে থাকে মাইকে-মাইকে, বামফ্রন্টের দিগ্বিজয়ের সঙ্গে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তাগা-তাবিজ, শনিপুজোর ধুম, তারকেশ্বরের জলযাত্রীর ভিড়— এখনও ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে আপিসের ফাঁকে কর্মরতারা নীলষষ্ঠী করে চলেছেন, আর স্লিভলেস আধুনিকা হাতের মাদুলি দেখিয়ে অধিকার বুঝে নেওয়ার স্লোগান দিচ্ছেন।

এখন পট-পরিবর্তনের পর অবশ্য নতুন সাপ্লাইও বাজারে এসে গেছে। ‘জনপ্রিয়’ লেখালিখির জগৎ কাঁপাচ্ছে ভূত-প্রেত-তন্ত্র-মন্ত্র। ‘ভদ্রলোকীয়’ সিরিয়ালের জমানা শেষ, এ বার স্রেফ হিন্দির রমরমা। ‘প্রগতিশীল’রাও এখন তেড়ে হিন্দিতে স্লোগান ঝাড়ছেন, হিন্দি সিনেমা দেখে মধ্যবিত্ত ‘মানাচ্ছে’ করওয়া-চৌথ আর ধনতেরস। গণেশপুজো হচ্ছে চতুর্দিকে, রামনবমীতে অস্ত্র মিছিল। গালিব থেকে ওয়াজ়েদ আলি শাহ সব বাদ, বাঙালি হিন্দুস্থানি সঙ্গীত থেকে বেছে নিয়েছে স্রেফ হনুমান চালিশা। কারণ, সে একাধারে হুজুগে ও অতি সুবোধ বালক— নিজের সংস্কৃতি আবার কী, যাহা পায় তাহা খায়। তাই তার ডিজে-বক্সে সারা ক্ষণই ফিস্টি চলছে, ভিডিয়ো-হলে ভোজপুরি শিল্পকীর্তি, ইউটিউবে পঞ্জাবি র‌্যাপ আর মোবাইলে কে-পপ। অবশ্য চাইলেই বা অন্য খাবার দিচ্ছে কে।

এই কারণেই বাঙালি বড় অসহায়ও। তার খিদে আছে, কিন্তু অখাদ্য ছাড়া খাবার নেই। তার আঁতেল আছে, কিন্তু তাঁদের বিকল্প কিছু খাবারদাবার বানানোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা নেই। হয় তাঁরা ‘জনপ্রিয়’ হবেন বলে যাচ্ছেতাই করে চলেছেন, নয়তো উচ্চমার্গের সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন, ‘পপ-কালচার’ শুনলেই প্রোলেতারিয়েতের নামে গড় করে কর্তব্য শেষ করেন। উৎপল দত্ত, এবং বিশেষ করে ঋত্বিক ঘটককে পেন্নাম না করে তাঁরা দিনযাপন করেন না, কিন্তু এঁদের এক জন যে যাত্রাপালাকে জনপ্রিয় করতে চেয়েছিলেন, আর অন্য জন যে স্রেফ জনপ্রিয় সিনেমা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টায় জীবনপাত করেছেন, সে সব হিসাব থেকে বাদ। জনপ্রিয় জিনিস বলতে সিনেমা-করিয়ে বোঝেন আধা-ইংরেজি আধো-বাংলায় চিত্রনাট্য লিখে সিনেমা বানানো, যা কেন ‘স্মার্ট’ তা বোঝা শিবেরও অসাধ্য। গায়ক বোঝেন তেড়ে হিন্দি গান গেয়ে ‘জনপ্রিয়’ হওয়া। সিরিয়াল-সাধক প্রবল উদ্যমে শাশুড়ি-বৌয়ের আখ্যান বানিয়ে তৃপ্তিলাভ করেন। লেখক ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় লিখতে বসেন ভূত-প্রেত-তন্ত্র-মন্ত্র-থ্রিলার। তাঁরা বিভূতিভূষণ থেকে বেছে নিয়েছেন স্রেফ তারানাথ তান্ত্রিককে, পরশুরাম থেকে বুদ্ধিমত্তাটুকু বাদ দিয়ে বেছেছেন স্রেফ ভূতের অংশটুকু, ফেলুদা থেকে বেছে নিয়েছেন জটায়ুকে। রাজনৈতিক কাজের পরাকাষ্ঠা হিসেবে বেছেছেন সদলবলে গিয়ে শাহরুখ খানের সিনেমা দেখাকে। আর হ্যাঁ, ঋত্বিক থেকে নিয়েছেন আঁতলামো-পুজোটুকু। ফলে বাঙালি যে দুধটুকু ফেলে দিয়ে স্রেফ জল খায়, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement