সব দলের শাসকরাই সমালোচনার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছেন
Politics

চুপ! সরকার চলছে

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের দুই সহচরের আপাত-সমালোচনা শুনেই চটে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী তানিয়াকে বিনা তদন্তেই ‘মাওবাদী’-র তকমা দিয়েছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২২ ০৫:১৭
Share:

শাসকরা ভুল স্বীকার করলে সমালোচকদের রাষ্ট্রদ্রোহী, মাওবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। প্রতীকী ছবি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে দিন রাগে ফুঁসে উঠে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে ‘মাওবাদী ক্যাডার’ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কোনও ‘মাওবাদী’ প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না। ২০১২ সালের কথা। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। সে উপলক্ষে এক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমজনতার আলাপচারিতার আয়োজন হয়েছিল। তানিয়া মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতেই বিপত্তি— মুখ্যমন্ত্রী চটে গিয়ে অনুষ্ঠান ছেড়েই বেরিয়ে যান।

Advertisement

সে দিন তানিয়া কী প্রশ্ন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে? পুরনো ভিডিয়ো খুঁজলে দেখা যাবে, তানিয়া মুখ্যমন্ত্রীর দিকে কোনও অভিযোগের আঙুল তোলেননি। তাঁর সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেননি। রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতার কথাও বলেননি। তিনি শুধু জানতে চেয়েছিলেন, তৃণমূলের দুই নেতা, মদন মিত্র ও আরাবুল ইসলাম যে ভাবে ক্ষমতার আস্ফালন করছেন, তা না করে তাঁদের কি আর একটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল? মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের দুই সহচরের আপাত-সমালোচনা শুনেই চটে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী তানিয়াকে বিনা তদন্তেই ‘মাওবাদী’-র তকমা দিয়েছিলেন।

তার পরে দশ বছর কেটে গিয়েছে। সময় বদলেছে। শাসকের স্বর বদলায়নি। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন, নকশালবাদের সমস্ত রূপকেই পরাজিত করতে হবে। বন্দুকওয়ালা নকশালবাদ তো বটেই, কলমওয়ালা নকশালবাদও। সবাইকেই কেটে ফেলে দিতে হবে। বার্তা স্পষ্ট। এখন আর বন্দুক ধরার প্রয়োজন নেই। কলম ধরলেই যথেষ্ট। তা হলেই নকশালবাদ বলে কেটে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু কলম কার বিরুদ্ধে? রাষ্ট্র, না সরকার? না কি, প্রধানমন্ত্রী?

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লার বক্তৃতায় ‘পঞ্চ পণ’ বা পাঁচটি সঙ্কল্প করার ডাক দিয়েছিলেন। আগামী পঁচিশ বছরে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। মন থেকে ব্রিটিশদের দাসত্বের ভাবনা মুছে ফেলতে হবে। নিজের ঐতিহ্যের প্রতি গর্ববোধ করতে হবে। একজোট হয়ে থাকতে হবে। ভারতীয় হিসাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে হবে। তার পর থেকে যে কোনও অনুষ্ঠানেই এই পাঁচটি সঙ্কল্পের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সে দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনেও বলেছেন। কিন্তু এই সঙ্কল্প যে তাঁর ভাবনা, বা তাঁর সরকার এই সঙ্কল্প নিয়ে চলতে চায়, প্রধানমন্ত্রী সে কথা বলেন না। তিনি বলেন, দেশ এই সঙ্কল্প করেছে। শুধু এই পঞ্চ পণের কথাই নয়। তাঁর যে কোনও সিদ্ধান্তকেই এখন ‘দেশের সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করেন নরেন্দ্র মোদী। অর্থাৎ, তিনিই সরকার, তিনিই দেশ। তাঁর বা তাঁর সরকারের সমালোচনা করলে সেটা রাষ্ট্রের সমালোচনা। নকশালবাদ। রাষ্ট্রদ্রোহিতা।

চলতি বছরের মে মাসেই সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনে স্থগিতাদেশ জারি করেছে। ব্রিটিশ জমানার ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধেও সরকারের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরার প্রয়োজন পড়ত না। সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জানিয়ে মুখ খুললে, বিদ্বেষ প্রকাশ করলেই তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ত। সুপ্রিম কোর্ট তাতে স্থগিতাদেশ জারি করে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে অবাধ ছাড়পত্র দিতে চেয়েছে এমন নয়— আদালত আসলে সংবিধানপ্রদত্ত বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারকে রক্ষা করতে চেয়েছে। সরকারের সমালোচনায় মুখ খুললে এখন আর কাউকে দেশদ্রোহিতার আইনে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী এখন মুখ না খুলে কলম ধরলেও তা নকশালবাদ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।

তানিয়া একা নন। পশ্চিমবঙ্গে বেলপাহাড়ির সভায় সারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কৃষক পরিবারের শিলাদিত্য চৌধুরীকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদী বলে তকমা দিয়েছিলেন। কামদুনির ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদী মহিলাদেরও মাওবাদী বলেছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এখন গুজরাত ভোটের আগে নিজের রাজ্যে প্রচারে গিয়ে বলছেন, ‘শহুরে নকশাল’-রা গুজরাতের উন্নয়নে বাধা দিতে চাইছে। পরিবেশ বাঁচানোর দাবিতে, আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার দাবিতে নেহরুর আমল থেকেই সর্দার সরোবর প্রকল্পের বিরোধিতা হয়ে আসছে। পরবর্তী কালে প্রকল্পের বহর যত বেড়েছে, বিরোধিতাও বেড়েছে। পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র না মেলায়, আদিবাসীদের পুনর্বাসন হওয়ায় প্রকল্পের দেরি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এখন সব দোষ ‘শহুরে নকশাল’-দের উপরে চাপাচ্ছেন।

প্রশ্ন উঠছে যে, সরকারের সমালোচনা করলেই, সরকারি প্রকল্পের বিরোধিতা করলেই ‘কলমওয়ালা’ বা ‘শহুরে নকশাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হলে, বা জেলে পোরার চেষ্টা হলে সংবিধানের বাক্‌স্বাধীনতার অধিকার কোথায় যাবে? মানবাধিকারই বা কোথায় গিয়ে মুখ লুকোবে?

মোদী জমানায় মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী, আইনজীবী, বিভিন্ন অসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারের কোপ পড়েছে। সমাজকর্মী, আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র মতো কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। অসরকারি সংস্থার বিদেশি অনুদানের রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। রাহুল গান্ধী এক সময় তার সমালোচনা করে বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে শুধু একটাই অসরকারি সংস্থা থাকবে। তার নাম আরএসএস।

মুশকিল হল, এ বিষয়ে কংগ্রেসের ইতিহাসও কালিমামুক্ত নয়। নরেন্দ্র মোদী উঠতে-বসতে দেশের সব সমস্যার জন্য যাঁকে দায়ী করেন, সেই জওহরলাল নেহরু বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারে লাগাম পরাতে চেয়েছিলেন। কাজেই এমন নয় যে, শুধু নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেই সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। স্বয়ং নেহরুর প্রস্তাব ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সংবাদমাধ্যমের ক্ষমতা খর্ব করা হোক। আদালতের অবমাননা, মানহানি করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকায় ফেলা হোক। তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার সময় বাক্‌স্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের অধিকারে কতখানি হস্তক্ষেপ করেছিলেন, তা অজানা নয়। রাজীব গান্ধী সংসদে মানহানি বিল পেশ করেছিলেন। কারও সম্পর্কে অসত্য খবর ছাপা হলে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তকমা দিতে চেয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবাদ, ধর্মঘট, আমজনতার বিক্ষোভের মুখে রাজীব সেই বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। বিল পাশ হলে আজ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সংবাদপত্র বা বই প্রকাশকদের সম্পর্কে যে কোনও তথ্য জোগাড় করার ক্ষমতা থাকত। মোদী জমানাতেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে রদবদল করে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে সরকারের অপছন্দের সংবাদে রাশ টানার অধিকার চাইছে সরকার। সংবাদপত্রে কারা সরকারের সমালোচনা করছে, তাঁদের উপর নজরদারি করে, তাঁদের কালো তালিকাভুক্ত করে ফেলার প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

শোনা যায়, রাজীব গান্ধীর মানহানি বিলের ভাবনা কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল। এই চিদম্বরমই মনমোহন সরকারের আমলে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন মাওবাদী দমনে বায়ুসেনাকে কাজে লাগিয়ে আকাশ থেকে মাওবাদীদের ডেরায় অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন। সরকারের মধ্যে থেকেই আপত্তি ওঠে। চিদম্বরম তখন যুক্তি দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো মাওবাদী সমস্যায় জর্জরিত রাজ্যগুলিই বায়ুসেনাকে কাজে লাগাতে চাইছে।

শুধু বায়ুসেনা নয়। মাওবাদী মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় সিপিএমের সশস্ত্র ক্যাডারদেরও নামানো হয়েছিল। সিপিএমের সেই সশস্ত্র ক্যাডাররাই মাওবাদী সন্দেহে নেতাইয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপরে গুলি চালিয়েছিল। ক্ষমতা হারানোর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই ভুল স্বীকার করে বলেছিলেন, “নেতাইয়ে আমাদের ছেলেরা ভুল করেছিল। ভীষণ ভুল!” কিন্তু দল তাঁর সেই ভুল স্বীকার অনুমোদন করেনি।

আসলে শাসকদের ভুল স্বীকার করতে নেই। শাসকরা ভুল স্বীকার করলে সমালোচকদের রাষ্ট্রদ্রোহী, মাওবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement