আমেরিকান ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়ছে। গত ১৫ জুন এক ডলারের বিনিময়ে ৭৭.৯ টাকা পাওয়া যাচ্ছিল। ঠিক এক মাস পরে, ১৫ জুলাই, পাওয়া যাচ্ছে ৭৯.৭৫ টাকা। অর্থাৎ ডলারের নিরিখে এক মাসে টাকার দাম পড়েছে ২.৩৬%। মাত্র এক মাসের মধ্যে এতটা পতনের মানে হল, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় টাকা বিক্রি করে ক্রেতারা পাইকারি হারে আমেরিকান ডলার কিনছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা ধাঁধা। সাধারণত দু’টি দেশের মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য, পুরোপুরি না হলেও, অনেকটা নির্ভর করে তাদের আপেক্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হারের উপরে। যে দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি, সে দেশের মুদ্রার মূল্য অন্য দেশটির মুদ্রার নিরিখে কমে যায়। মূল্যবৃদ্ধি মানে ক্রয়ক্ষমতার পতন— যে দেশে মূল্যবৃদ্ধি বেশি, সে দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা বেশি হারে কমছে। ফলে তুলনামূলক ভাবে সেই দেশের মুদ্রার দামও কমে যাওয়ার কথা। টাকা-ডলার বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে কিন্তু উল্টোটা ঘটছে। বেশ কয়েক মাস হল, ভারতীয় মূল্যবৃদ্ধির হার আমেরিকার মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। গত মাসে ভারতীয় মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.০১%, আমেরিকার ৯.১%। তা হলে আমেরিকান ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়ছে কেন? টাকার তুলনায় ডলারের ক্রয়ক্ষমতা বেশি হারে কমা সত্ত্বেও ক্রেতারা টাকা বিক্রি করে ডলার কিনছেন কেন?
শুধু যে টাকার দাম পড়ছে তা-ই নয়, আমেরিকান ডলারের নিরিখে ইউরো, পাউন্ড স্টারলিং, জাপানি ইয়েন সকলের দামই পড়ছে। ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই, এই এক মাসের মধ্যে ডলারের নিরিখে ইউরোর দাম পড়েছে ৩.১২%, পাউন্ড স্টারলিং-এর ২.৪৩%, জাপানি ইয়েনের ২.৫৩%। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত মাসে জাপানে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫%, ইউরো অঞ্চলে ৮.৬% এবং ব্রিটেনে ৯.১%। অর্থাৎ, আমেরিকার সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় জাপানে মূল্যবৃদ্ধি অনেক কম, ইউরো অঞ্চলে কিছুটা কম, ব্রিটেনে মোটামুটি একই রকম। অর্থাৎ, ভারতের মতো গরিব দেশের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যাচ্ছে— আপেক্ষিক মূল্যবৃদ্ধির দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। কোনও অজ্ঞাত কারণে অন্য সব মুদ্রা বিক্রি করে দিয়ে ক্রেতারা শুধু ডলার কিনছেন।
কেন ক্রেতারা এই ভাবে ডলার কিনছেন, তার একটা চটজলদি ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া যায়। বলা যায়, বিদেশি মুদ্রার বাজারে একটা ক্ষণস্থায়ী বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ ক্রেতা মনে করছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ডলারের দাম বাড়বে। ফলে প্রত্যেকেই অন্যান্য মুদ্রা বিক্রি করে ডলার কিনতে চাইছেন। ফলে ডলারের চাহিদা বাড়ছে, দামও সত্যি সত্যি বেড়ে যাচ্ছে। অর্থশাস্ত্রে এর নাম ‘সেলফ ফুলফিলিং বিলিফ’, যার বাংলা তর্জমা করা যায় ‘আত্মপরিপূরক বিশ্বাস’। প্রশ্ন হল, কোনও কারণে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করলে এই রকম বুদ্বুদ তৈরি হতেই পারে এবং বুদ্বুদ তৈরি হলে ডলারের দাম উত্তরোত্তর আরও বেড়ে যেতেই পারে, কিন্তু প্রাথমিক ভাবে ডলারের দাম বাড়ল কেন?
এটা সত্যি যে, গত ত্রিশ বছরে পৃথিবীর উদীয়মান দেশগুলির আয় যে হারে বেড়েছে, উন্নত দেশগুলির আয় সে হারে বাড়েনি। সবচেয়ে দর্শনীয় চিনের বৃদ্ধি। কিন্তু এই তালিকায় আরও দেশ আছে। এই দেশগুলির আয়বৃদ্ধি ঘটেছে মূলত রফতানি বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে। দেশগুলি পণ্য রফতানি করে যে বিদেশি মুদ্রা পাচ্ছে, সেটা জমা পড়ছে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলিতে। ফলে এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুদ্রা হিসেবে ভান্ডারে রেখে দিলে তো কোনও সুদ পাওয়া যাবে না। একমাত্র মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে কিছু লাভ হতে পারে। কিন্তু সেই লাভ অনিশ্চিত, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য কমেও যেতে পারে। তার থেকে ঢের ভাল বিদেশি মুদ্রা দিয়ে কিছু আমানত কিনে রাখা, যার উপর নিশ্চিত হারে সুদ পাওয়া যাবে। যে সব আমানতের উপর নিশ্চিত হারে সুদ পাওয়া যাবে, তাদের নিরাপদ আমানত বলা যায়। নিরাপদ আমানতের উপর শুধু যে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি ভরসা করছে তা নয়, পেনশন ফান্ড, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বিমা সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠান, যাদের হাতে বিনিয়োগ করার মতো নগদ আছে, তারাও নির্ভর করছে।
উদীয়মান দেশগুলি যে নিরাপদ আমানত কিনতে চাইছে, সেটা জোগান দিচ্ছে উন্নত দেশগুলি। সমস্যা হল, এক দিকে উদীয়মান দেশগুলির অধিক আয়বৃদ্ধির কারণে নিরাপদ আমানতের চাহিদা বেড়েই চলেছে, অন্য দিকে উন্নত দেশগুলির কম আয়বৃদ্ধির দরুন নিরাপদ আমানতের জোগান ততটা বাড়ছে না। বস্তুত, নানা কারণে সেটা কমে আসছে। একটা সময় ছিল, যখন রেটিং এজেন্সিদের দেওয়া ‘ট্রিপ্ল এ’ সার্টিফিকেট পাওয়া আমেরিকান ব্যাঙ্কগুলির ঋণপত্রগুলিকে নিরাপদ মনে করে সারা পৃথিবীর লগ্নিকারীরা তাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম ক্রাইসিস প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সেই আমানতগুলি আদৌ নিরাপদ ছিল না। একই সঙ্গে ইটালিয়ান ও স্প্যানিশ সরকারের ঋণপত্রগুলিকেও এক সময় নিরাপদ মনে করা হত, যে হেতু এই দেশগুলি ইউরো অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ক্রমশ এই দেশগুলির আর্থিক ভঙ্গুরতা লগ্নিকারীদের নজরে এসেছে— পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, এই ঋণপত্রগুলি আদৌ নিরাপদ নয়। বস্তুত, সাব-প্রাইম ক্রাইসিসের পরে শুধুমাত্র আমেরিকা, জার্মানি এবং ফ্রান্সের সরকারি ঋণপত্রকে নিরাপদ মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে নিরাপদ আমানতের জোগান কমে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে যে সব আমানতকে নিরাপদ মনে করা হত, পৃথিবীর মোট আয়ের ৩৬.৯% তাতে লগ্নি করা ছিল। ২০১১ সালেই নিরাপদ বিনিয়োগ পৃথিবীর মোট আয়ের ১৮.১%-এ নেমে এসেছিল। লক্ষণীয় যে, পৃথিবীর আয়ের অনুপাতে মোট নিরাপদ লগ্নি কমলেও আমেরিকান সরকারের ঋণপত্রে লগ্নি বেড়েছে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সরকারের ঋণপত্রে লগ্নি ছিল পৃথিবীর আয়ের ৭.৯%। ২০১১-তে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৩.৩%। অর্থাৎ, সাব-প্রাইম ক্রাইসিসের উৎপত্তিস্থল আমেরিকা হলেও আমেরিকার সরকারের উপর মানুষের আস্থা বিন্দুমাত্র কমেনি।
এই আস্থার ফলে আমেরিকার সরকারের ঋণপত্রের জন্য একটা উদ্বৃত্ত চাহিদা তৈরি হয়েছিল। সাধারণত কোনও আমানতের জন্য উদ্বৃত্ত চাহিদা তৈরি হলে তার দাম বাড়ে, এবং তার উপর প্রদেয় সুদের হার কমে। কিন্তু আমেরিকান ঋণপত্রের উপর প্রদেয় সুদের হার কমতে কমতে শূন্যতে ঠেকেছিল, আর সুদের হার কমা সম্ভব ছিল না। আমেরিকান ঋণপত্রের উদ্বৃত্ত চাহিদা মিটছিল আমেরিকার সরকারের ঋণবৃদ্ধি, অর্থাৎ আমেরিকান ঋণপত্রের জোগান বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে। ২০০০ সালে আমেরিকান দেশের ঋণ-আয়ের অনুপাত ছিল ৬%, বর্তমানে সেটা ১৩৭% ছাড়িয়ে গেছে। বর্ধিত ঋণপত্রের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিনেছে উদীয়মান দেশগুলি।
দু’টি সাম্প্রতিক ঘটনা কিন্তু আমেরিকান ঋণপত্রের বাজারে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যটা নাড়িয়ে দিয়েছে। এক, মূল্যবৃদ্ধি কমানোর জন্য আমেরিকায় সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ফলে আমেরিকান ঋণপত্র আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। দুই, ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিকটবর্তী দেশ ফ্রান্স এবং জার্মানির ঋণপত্রগুলিকে আর ততটা নিরাপদ মনে করা হচ্ছে না, কারণ এই দেশগুলি তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়া এবং গমের জন্য ইউক্রেনের উপর অংশত নির্ভরশীল। বাজারের এই মেজাজ পরিবর্তনের ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির ঋণপত্রগুলির চাহিদা কমেছে, এবং আমেরিকান ঋণপত্রের চাহিদা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমেরিকান ঋণপত্রের জন্যে আবার একটা উদ্বৃত্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে।
আমেরিকান সরকার তাদের ঋণ আর বাড়াতে চায় না। ফলে আমেরিকান ঋণপত্রের জোগান বেড়ে গিয়ে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য রক্ষা করাটা সম্ভব হচ্ছে না। এ দিকে আমেরিকান ঋণপত্র কেনার জন্য বাজারে আমেরিকান ডলারের চাহিদা বাড়ছে। অন্য সব মুদ্রা বিক্রি করে দিয়ে ক্রেতারা আমেরিকান ডলার কেনার চেষ্টা করছেন। ফলে অন্য মুদ্রাগুলির নিরিখে আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। এই দাম বাড়ার শেষ কোথায়? আশা করা যায়, আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির ও সুদের হার এক দিন কমবে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। ডলারের দাম কমার জন্য সম্ভবত তত দিন অবধি অপেক্ষা করতে হবে।