মায়াবিহারী: আসিয়ান মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও অন্যান্য দেশনেতা, সিঙ্গাপুর, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
পুকুরে একটি ঢিল পড়েছে। ভোটবাজারের এই উত্তপ্ত প্রহরে সেই ঢিলজনিত আলোড়ন, হয় সে ভাবে প্রত্যক্ষগোচর হয়নি, নয়তো যাঁরা দেখার তাঁরা দেখেও তা আড়াল করতে যত্নবান। বিশ্বগুরু প্রকল্পকে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার মাখনমসৃণ প্রক্রিয়ায় কোনও চোনা পড়তে দিতে চান না তাঁরা।
ঢিলটি পড়েছে বসন্তের গোড়ায়, যখন ভারতে পুরোদস্তুর নির্বাচনের মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছে। আসিয়ানভুক্ত (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস) রাষ্ট্রগুলির সর্বাধিক মান্য চিন্তনকেন্দ্র সিঙ্গাপুরের ‘দ্য স্টেট অব সাউথইস্ট এশিয়া’-র ২০২৪ সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিবেশী বলয়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তা কমছে ভারতের। বলা হয়েছে, আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলির অংশীদার হিসাবে চিহ্নিত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব সবচেয়ে নগণ্য। পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হচ্ছে, সমীক্ষাজাত মতামতের মাত্র ০.৬ শতাংশ মনে করেন ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। যেখানে চিন সম্পর্কে এই ধারণা ৫৯.৫ শতাংশ মানুষের। জাপানের ক্ষেত্রে তা ৩.৭ শতাংশ।
এ তো গেল অর্থনীতির বিচার। রাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রভাবের বিচারে সমীক্ষাজাত ০.৪ শতাংশ মানুষ মোদী সরকারকে সবার উপরে রেখেছেন। এখানেও তালিকার শীর্ষে চিন, শতকরা ৪৩.৯ শতাংশ জনমতে। আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি এবং প্রশাসনের বিচারে মোদী সরকারের উপর আস্থা রাখছেন সমীক্ষাজাত মাত্র দেড় শতাংশ মানুষ। অবিশ্বাসের গড় ৪৪.৭ শতাংশ। আর ৪০.৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা অথবা সামর্থ্য ভারতের নেই।
এমন একটি অঞ্চল থেকে এই জনমত উঠে এসেছে যা প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় বিচরণভূমি। নরেন্দ্র মোদীর দাবি, এখানেই অধিকতর সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়ে থাকে তাঁর দেশ। গত বছর জাকার্তায় আসিয়ান দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে মোদী এমনটাও বলেছিলেন, ভারতের প্রতিবেশী নীতির কেন্দ্রীয় স্তম্ভ আসিয়ান। ১৯৯২ সালে কংগ্রেস সরকারের প্রবর্তিত ‘লুক ইস্ট’ বা ‘পুবে তাকাও’ নীতিকে কিছুটা বদলে নিয়ে ক্ষমতায় এসে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করেছিলেন তিনি। যার সাড়ম্বর নামকরণ হয় ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসি। ২০১৮ সালে একটি বক্তৃতায় তাঁর সগর্ব দাবি ছিল, ভারতের শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বলয়।
বিদেশনীতির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বহু সগর্ব দাবি কূটনৈতিক প্রাঙ্গণে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে এর আগেও। মণিপুরের হিংসা নিয়ে ওয়াশিংটনের তীব্র রিপোর্ট, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পর বার বার আমেরিকার সতর্কীকরণ, আর যা-ই হোক বিশ্বমিত্র ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না। এই সমীক্ষাটিও ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মোদী সরকারের গত পাঁচ বছরের দাবি এবং বাস্তবের মধ্যে ফারাক আসলে কতটা।
আসিয়ানের বর্ধিত প্রতিবেশী অঞ্চল ছেড়ে উঁকি মারা যাক পড়শিমুলুকে। লোকসভা ভোট শুরুর ঠিক মুখে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দাবি করেছেন, মোদী জমানায় গত পাঁচ বছরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ‘তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি’ হয়েছে। সঙ্গে ‘ইতি গজ’-র মতো জানিয়েছেন, এই হিসাবে চিন এবং পাকিস্তান বাদ! পাকিস্তান নাহয় বাদই থাক আপাতত। তারা স্বখাত সলিলে, এতটাই আধমরা যে ভারতের নির্বাচনের আগে উগ্র জাতীয়তাবাদ তৈরির মলম হিসাবেও ইসলামাবাদকে কাজে লাগাতে পারেননি সরকারি প্রচারযন্ত্রের ম্যানেজাররা। ছায়াকুস্তি লড়ার যোগ্যতাতেও নেই ইসলামাবাদ। কিন্তু একটি কক্ষে বিশালাকায় ড্রাগন ঘুরে ঘুরে আগুনে নিঃশ্বাস ফেলছে, আর সেখানে বসেও তাকে দেখতে পাচ্ছি না, এটা কি ‘চোখ বুজে থাকলেই ভয় চলে যাওয়া’র মতো মূর্খামি নয়?
দীর্ঘতম সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া ওপার বাংলার দিকে তাকিয়ে কী দেখছি? মলদ্বীপে ‘ভারতকে তাড়াও’ প্রচার এবং বাংলাদেশের একটি অংশে ভারত-বিরোধিতায় গলা ফাটানোর শব্দ এই বছরের গোড়া থেকেই। সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ নিয়ে বার বার বিভিন্ন মঞ্চে সরব হয়েছেন ভারতীয় (এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা) কূটনৈতিক কর্তারা, কিন্তু ভারত-বিদ্বেষ কমাতে কোনও পদক্ষেপ করা যায়নি। বরং কয়েক মাস আগেই ঢাকার পান্থপথ অঞ্চলের দোকানগুলি ভারতীয় পণ্যের টাটকা জোগান নিতে অস্বীকার করে। অথচ সাধারণত সেখানে ভারতীয় পণ্যই বেশি রাখা হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অনেক দোকানদার এবং কর্মীরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতের তৈরি রান্নার তেল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্রসাধনের সরঞ্জাম এবং জামাকাপড়ের মতো পণ্যের বিক্রি কমেছে। বিএনপি-র সমর্থকরা অনলাইনে ভারত-বিরোধী প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন বলে খবর। ভারত-বিরোধী পোস্টগুলির কিছু হলেও প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মানুষের মনে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহ পরেই এই পোস্টগুলি বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের অফিসের সামনে ভারত-বিরোধী বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিএনপি এবং জামাতের কর্মী-সমর্থকরা। এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের জবাব, তাঁরা নজর রাখছেন। বিএনপি-পন্থী, বাংলাদেশের সমাজের ঐতিহ্যগত ভাবেই মৌলবাদী অংশ মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর ‘ভারত তাড়াও’ প্রচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে এমনটাও মনে করা হচ্ছে।
কিছু দিন আগেও যা ছিল ভারতীয় পর্যটকদের স্বপ্নরাজ্য, সেই মলদ্বীপে উত্তাল বইছে ভারত-বিরোধিতার হাওয়া। মুইজ্জু প্রকাশ্যেই চিনপন্থী এবং ভারত-বিরোধী হিসাবে পরিচিত। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছিল মুইজ্জুর তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তার পর ভারতের সমাজমাধ্যমে মলদ্বীপ বয়কটের ডাক ওঠে। ইতিমধ্যে চিনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন মুইজ্জু। মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরিয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও সাউথ ব্লক যা ঠেকাতে পারেনি।
নেপালেও চিনপন্থার জয়জয়কার। হালে ফেব্রুয়ারিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড জোট ভেঙে দিলেন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে। ভারতবন্ধু বলে পরিচিত নেপালি কংগ্রেসের পরিবর্তে প্রচণ্ড নতুন জোটসঙ্গী করলেন কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালকে। ওলির চিন-প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার আগেও, অর্থাৎ গত কয়েক বছর ধরে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ক্রমশ। এ বার পুষ্পকমল দহল এবং ওলি যখন সরকার গড়লেন ভারতের নাম না করে বাঁকা মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল ওলিকে। স্পষ্টতই তিনি যে চিনের হাতে তামাক খেতে বেশি আগ্রহী সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় দু’টি বিষয়ে। প্রথমত, তিনি বলেন, কিছু পদক্ষেপ বাইরে থেকে করা হচ্ছে যাতে নেপালের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়। ইঙ্গিত স্পষ্ট, ভারতকে গোড়াতেই কড়া বার্তা দিয়ে নতুন ইনিংস শুরু করতে চাইলেন তিনি। দ্বিতীয়ত, জোট সরকারের যে ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচি তৈরি হল, আমরা দেখলাম তাতে ভারতকে নিশানা করে চিনকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বেআইনি ভাবে দখল করে রাখা নেপালের ভূভাগ (লিম্পিয়াধুরা, লিপুলেখ গিরিপথ এবং কালাপানি অঞ্চলকে নেপালের অংশ হিসেবে নেপাল সংসদে প্রস্তাব পাশ করিয়েছিল ওলির সরকার) ফেরানোর জন্য আলোচনা শুরু করা হবে নয়াদিল্লির সঙ্গে। চিন-নেপাল সীমান্ত বিতর্কের কোনও উল্লেখই সেখানে নেই।
সুখের সূচকে শীর্ষে থাকা ভুটান নিয়েও নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়ার কর্তাদের সুখ নেইকো মনে! ভারত এবং চিনের মধ্যে ‘বাফার’ রাষ্ট্র হিসাবে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের প্রভাব সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভুটান হচ্ছে ‘শেষ বাধাসমূহের অন্যতম’, যা খুব দ্রুত দূর করবেই বেজিং। এখনই স্যাটেলাইট-চিত্র দেখাচ্ছে ভুটানের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে চিনের ‘অননুমোদিত নির্মাণ কাজ’-এর নিদর্শন। এই ভূখণ্ড স্থায়ী ভাবে চিনের হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা গভীর। পাশাপাশি থমকে থাকা চিন-ভুটান সীমান্ত চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের পথে। ভুটানের উত্তরাঞ্চলে সীমান্ত চিহ্নিত করে চুক্তি হয়ে গেলে ভুটানের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে চিনের দৃষ্টি যাবেই, যেখানে ডোকলাম মালভূমি-সহ কিছু এলাকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যে মালভূমি দক্ষিণে ‘চিকেন নেক’ বা সরু লম্বালম্বি ভূখণ্ড দিয়ে ভারতের মূল অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর যোগাযোগ, সেখানে চিনের মৌরসিপাট্টা কায়েম হলে ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হবে। সব মিলিয়ে এ বার যে সরকারই আসুক না কেন, গত পাঁচ বছর ধরে জমে ওঠা প্রতিবেশী-কণ্টক হজম করেই তাকে কূটনীতির ময়দানে নামতে হবে।