Technology

কে রাশ টানবে, কী ভাবে

মূলধারার অর্থনীতিতে অবশ্য বলা হয়, নতুন প্রযুক্তির ফলে নতুন জিনিস বাজারে এলে ও পুরনো জিনিসের দাম কমলে এত চাহিদা বাড়বে যে, অনেক বেশি লোক কাজ পাবেন।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৪ ০৮:২৯
Share:

—প্রতীকী ছবি।

নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন যুগে যুগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে অর্থনৈতিক পরিসরে নতুন প্রযুক্তির ভূমিকা বাহ্যত একটাই, মানুষকে যাতে কম কষ্ট করতে হয়, কায়িক-মানসিক শ্রমের প্রয়োজন কমে। অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস জুনিয়র তাঁর লেকচার্স অন ইকনমিক গ্রোথ বইয়ে বিদ্যুৎ ও স্টিম ইঞ্জিনের মতো প্রযুক্তির সঙ্গে কম্পিউটারচালিত প্রযুক্তি বিপ্লবের তুলনা করেছিলেন। তবে কম্পিউটার থেকে যথাযথ সুবিধা পেতে শিক্ষার প্রয়োজন। বাড়িতে কম্পিউটার সাজিয়ে রাখলেই উপকার মেলে না, সুইচ টিপে চালু রাখলেই হয় না। যে প্রযুক্তি শিক্ষিত মানুষের অনেকটা সুবিধা করে দেয়, স্বভাবতই তা আয়ের বৈষম্যও বাড়িয়ে তোলে, কারণ সবার পক্ষে তেমন শিক্ষিত হওয়া সম্ভব হয় না।

Advertisement

মূলধারার অর্থনীতিতে অবশ্য বলা হয়, নতুন প্রযুক্তির ফলে নতুন জিনিস বাজারে এলে ও পুরনো জিনিসের দাম কমলে এত চাহিদা বাড়বে যে, অনেক বেশি লোক কাজ পাবেন। আরও বলা হয়, মেশিন ও মানুষ যে-হেতু খানিক অদল-বদল করা যায়, তাই মানুষের দাম কমে গেলে বেশি মানুষ কাজ পাবেন, তাতে উৎপাদন ব্যয়ের সুরাহা হবে। তবু আজ অনেকেই মেনে নিয়েছেন, এগুলো খানিক মনগড়া রূপকথা। ভারত তার অন্যতম উদাহরণ। এখানে মানুষের শ্রমের, বিশেষত কায়িক শ্রমের দাম অনেক দেশের তুলনায় ভয়ানক কম হলেও, মুনাফার লোভে উদ্যোগপতিরা হালের এমন প্রযুক্তি আমদানি করেন যাতে মানুষের প্রয়োজন সবচেয়ে কম।

নতুন প্রযুক্তি মানেই মানুষের দাম আরও খানিক কমে যাওয়া। চাকরি লোপ, সম্পর্কিত পেশার অপমৃত্যু। অবশ্যই তার পরিবর্তে মুনাফা বাড়ে, তবে বর্ধিত মুনাফার কোনও অংশই অতিরিক্ত মানুষ ব্যবহারকারী, প্রযুক্তিনিবিড় ব্যবসায় নিয়োজিত হয় না। কারণ, নতুন নতুন প্রযুক্তি হয় অপেক্ষাকৃত কম-শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন খুব কমিয়ে দেয়, বা নতুন যন্ত্রের উদ্ভাবনের আনন্দে মানুষকেই ক্রমাগত ব্রাত্য করতে থাকে। নতুন প্রযুক্তির এই নিরন্তর মানুষ-উপেক্ষার গল্প সুপরিচিত হলেও, কৃত্রিম বুদ্ধির যন্ত্র আজ ইতিহাসে এমন অধ্যায় জুড়ছে যাতে আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।

Advertisement

এত দিন যাঁরা যে প্রযুক্তিই উদ্ভাবন করুন, উদ্ভাবিত হওয়ার পর সেই প্রযুক্তি নিজের বুদ্ধি খরচ করতে পারত না। সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ লক্ষ তথ্য বিশ্লেষণ করে ফলাফল জানিয়ে দিতে পারে, এমন মেশিনের খোঁজে এখন তাবড় সংস্থা কোটি কোটি ডলার খরচ করছে, কারণ তার চেয়েও অনেক বেশি কোটি ডলার তারা রোজগার করবে। কিন্তু এই ক্ষিপ্রতার সাহায্যে যন্ত্র বা যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা অন্য অনেক শ্রমের বাজারে মহামারির সৃষ্টি করবে নিজে নিজেই। কম্পিউটারের এ-যাবৎ যে তথ্য সঞ্চিত, তার ব্যবহারে অনেক পেশার নিমেষে অবলুপ্তি ঘটানোর ক্ষমতা তার আছে। সিগারেট কোম্পানি নতুন প্যাকেটের উপর লিখছে, ‘এআই-এর সাহায্যে তৈরি প্রথম প্যাকেট’ গোছের কিছু, মানে নতুন ফ্যাশনের জিনিস ডিজ়াইন, নতুন বিষয় সম্পর্কে লিখে রোজগার, বিখ্যাত শিল্পীর কাজের দক্ষ নকল তৈরি, যন্ত্র এ সব সেকেন্ডের মধ্যে করছে।

নতুন প্রযুক্তি এলে পুরনো কারিগর, শ্রমিক ও দক্ষ পেশাদারের চাহিদা যে কমে যাবে, এ নতুন কথা নয়। কিন্তু সে যে অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পেশায় মহামারি সৃষ্টি করবে, জানা ছিল না। ফলে যাঁরা এই নতুন এআই বা এমএল প্রযুক্তির ধারক বাহক, তাঁরাই একত্র হয়ে বিশ্বের দরবারে তাঁদের অবাধ্য সন্তানের নিয়ন্ত্রণ চাইছেন। বলা বাহুল্য, কর্মহীনতা বা পেশালুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভুল তথ্য বা ভুয়ো খবর তৈরিতে এর জুড়ি নেই। ভুল তথ্য বা সংবাদ ধরে ফেলার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, হয়তো সেখানে এআই-ও ব্যবহৃত হচ্ছে। তবু লাগামছাড়া এই প্রযুক্তির দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণের যে প্রস্তাব উঠে আসছে তা অভূতপূর্ব।

প্রশ্ন হল, একে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কী ভাবে। যাঁরা এই প্রযুক্তি রোজ খরতর করার চেষ্টা করছেন, বৃহত্তর মানবসমাজের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁদের যায় আসে না। তেমনই যাঁরা এটা ব্যবহার করে তাঁদের বাজার বাড়াবেন, তাঁরা যত নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াবেন, তত এর থেকে মুনাফা হয়তো কম হবে, ফলে তাঁরা বেশি পয়সা দিয়ে নতুন প্রযুক্তি কিনতে পারবেন না। বেশি মুনাফা না হলে তাঁরা প্রযুক্তির মগজাস্ত্র আরও শাণিত করতে দু’বার ভাববেন। কোনও দেশের সরকার বা বিশ্বের সরকার একত্র হয়ে প্রযুক্তির কর্মক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এত দিনে নতুন প্রযুক্তির ক্ষতি করার ক্ষমতা বেশ বেড়ে গেছে। আর যাতে তেমন ক্ষতি না হয়, সে জন্য এক দিকে ওই ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির পিছনে বিনিয়োগে প্রথম সারির উদ্ভাবক সংস্থাদের খানিক বাধ্য করা যায়। সে উপায় যে একদম নেই তা নয়। কিন্তু যেখানে বিপুল অর্থ জড়িত সেখানে বড় সংস্থারা আগে ক্ষতি করে পরে শাস্তিবাবদ বিশাল জরিমানা দেয়।

কেউ কেউ প্রস্তাব করবেন দাওয়াই: এআই প্রযুক্তিতে পেটেন্ট ব্যবস্থা তুলে দেওয়া। যদি সবাই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নকল করে ব্যবহার করতে পারে তা হলে এ ক্ষেত্রে কম বিনিয়োগ হতে বাধ্য, অন্তত অর্থনীতির মানুষ এ কথা বলবেন। যাঁরা এ ধরনের প্রযুক্তি আরও তুখোড় করার প্রচেষ্টায় যুক্ত, তাঁদের উপর থেকে পেটেন্টের ছাতা খানিক সরিয়ে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি এক সঙ্গে অনেক ব্যবহারকারী সংস্থাকে বিক্রি বা ব্যবহার করতে দেওয়ার নীতি কার্যকর করলে, এ সব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে লাগাম টানা যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement