অসন্তোষ: নিট ২০২৪ পরীক্ষার ফলাফলে গরমিলের কারণে ভারতীয় যুব কংগ্রেসের প্রতিবাদ। নয়াদিল্লি, ৯ জুন। পিটিআই।
এ বারের নির্বাচনের গণরায় নিয়ে বিশ্লেষণ ও বিতর্কের আসর সরগরম। বিজেপি বা মোদী শিবিরের কট্টর সমর্থকদের চোখে মোটের উপর এই রায় সরকারের পক্ষে। পরিবর্তনটা নিছক কিছু সংখ্যা হ্রাসের মধ্যেই সীমিত। বিপরীতে যাঁরা ১৯৭৭ বা ২০০৪-এর মতো সরকার পরিবর্তনের একটা সুস্পষ্ট নিটোল ছবি আশা করেছিলেন, তাঁরা খানিকটা আশাহত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সরকার যে থেকেই গেল। কিন্তু এই সংখ্যাতত্ত্বের বাইরে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব ও বর্তমান পরিস্থিতিকে মাথায় রাখলে ২০২৪-এর এই গণরায় আজকের এই সন্ধিক্ষণে ভারতের গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক।
সাতাত্তরে জরুরি অবস্থার অবসান নির্বাচনের আগেই ঘটে গিয়েছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল খোলা হাওয়ায়, এ বারের মতো দমবন্ধ করা পরিবেশে নয়। সে সময়ের নির্বাচন কমিশন, সংবাদমাধ্যম এবং গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজকের মতো একপেশে আদৌ ছিল না। কুড়ি বছর আগের ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ প্রচারের বাজপেয়ী-আডবাণী জমানাতেও দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মাত্রা ছিল যথেষ্ট অন্য রকম। গুজরাত গণহত্যা ও লক্ষ লক্ষ কৃষকের ‘আত্মহত্যা’ দেশ মেনে নিতে পারেনি। তখনও কংগ্রেস ও বামপন্থী শিবিরের সাংগঠনিক ও সংসদীয় শক্তি বিজেপির তুলনায় আজকের মতো এত দুর্বল ছিল না। সাতাত্তর বা দু’হাজার চারের সঙ্গে তুলনা করলে আজকের অবস্থা রীতিমতো অন্য রকম। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত শাসক হিসেবে তুলে ধরবেন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য ধর্মভীরু জনগণের ভোট চাইবেন, এই অভাবনীয় দৃশ্যকল্প আজকের নির্মম বাস্তব।
এক দিকে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী শাসক দল বিজেপি ও তার অকল্পনীয় ধনবল, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রহসনে পরিণত করা নির্বাচন কমিশন, দরবারি প্রচারতন্ত্রে অধঃপতিত মুখ্যধারার সংবাদমাধ্যম, ওপিনিয়ন পোল ও এক্সিট পোলের কান ঝালাপালা করা ঢক্কানিনাদ আর অন্য দিকে সদ্য গড়ে ওঠা একটি দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী জোট, এটাই ছিল নির্বাচনের তথাকথিত ভারসাম্য। এমন একটি অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দেশের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে এক বিরাট গণজাগরণে পরিণত করেছেন ভারতের জনগণ, ‘উই, দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’। রাজনৈতিক দলের অসম্পূর্ণ আসন সমঝোতাকে ছাপিয়ে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারতের নাগরিক সমাজ এবং ডিজিটাল মাধ্যমের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান বাহিনী। এ বারের নির্বাচনী ফলাফল এই বিরাট কর্মযজ্ঞ ও গণজাগরণের ঘাম ঝরানো আশা জাগানো ফসল।
এই গণজাগরণের ঝটিকাকেন্দ্র বুলডোজ়ার রাজের ল্যাবরেটরি এবং মোদী-শাহ-যোগীর ত্রিবেণীসঙ্গমের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। যেখান থেকে স্লোগান উঠেছিল ‘যো রামকো লায়ে হ্যায় হম উনকো লায়েঙ্গে’, সেই অযোধ্যা (লোকসভাতে এই আসনের নাম আজও ফৈজ়াবাদ) থেকেই দড়ি ধরে টান মেরে রাজাকে প্রায় খান খান করে ছেড়েছে এ বার ভারতের এই বৃহত্তম রাজ্য। বিজেপি-বিরোধী ঢেউ ভাসিয়ে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি বা নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির মতো দাপুটে নেতাদের। ধস নেমেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভোট এবং জয়ের ব্যবধানে। ফৈজ়াবাদের অসংরক্ষিত আসন থেকে সংবিধান পরিবর্তনের ওকালতি করা বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে জিতেছেন পোড়খাওয়া দলিত নেতা অবধেশ প্রসাদ। আইপিএলের দলের নাম সামান্য বদলে দিয়ে বলা যায় লখনউ জায়ান্ট কিলার্স টিমের হাতে পরাজিত গুজরাত টাইটানস।
নির্বাচনের ফলাফলে দ্বিতীয় বড় অবদান মহারাষ্ট্রের। বড় অবদান আরও এক বার পশ্চিমবঙ্গের। রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো কৃষক আন্দোলনে মুখরিত অঞ্চল, দীর্ঘ দিনের সামাজিক পরিবর্তনের আলোড়ন কেন্দ্র দক্ষিণ বিহার বা জল-জঙ্গল-জমি ও জনজাতি সম্মানের লড়াইয়ের কেন্দ্র ঝাড়খণ্ডের জনজাতি সংরক্ষিত আসন থেকেও উঠে এসেছে সুস্পষ্ট পরিবর্তনকামী গণরায়। বিজেপির ভোট বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি আসন বাড়লেও আবার বিজেপির শাসন ও রাজনীতিকে বড় আকারে প্রত্যাখ্যান করেছে দক্ষিণ ভারত, বিশেষ করে তামিলনাড়ু ও কেরল।
কোথাও সংগ্রামী কৃষক, কোথাও মোদীর ধারাবাহিক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ও বেকারত্বে জর্জরিত পরিবর্তনকামী যুব শক্তি, কোথাও পাঁচ কেজি রেশনের বশ্যতার জাল ভেঙে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দলিত-বহুজন সমাজ, কোথাও অধিকার আন্দোলনে সংগঠিত নারীশক্তি, আর গোটা দেশ জুড়ে চরম অপমান ও অত্যাচার সহ্য করে মাটি কামড়ে লড়ে যাওয়া মুসলিম জনগণ, এ বারের নির্বাচনী প্রতিরোধ আন্দোলনের মানচিত্র জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমন লক্ষ লক্ষ মুখ। ওড়িশা এবং অন্ধ্র থেকে নতুন লটারি না লাগলে, বিএসপি-র দৌলতে উত্তরপ্রদেশে ভোট ভাগাভাগির সুবিধে না পেলে (যার ফলে বিজেপি অন্তত পনেরোটি আসন ধরে রাখতে পেরেছে) এবং নীতীশ কুমারের সৌজন্যে বিহারে আসন হ্রাসের মাত্রা কমাতে না পারলে তৃতীয় দফায় বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা প্রকৃতই অসম্ভব হয়ে উঠতে পারত।
কথায় বলে ব্যতিক্রম দিয়েই নিয়মের পরিচয়। ব্যতিক্রমী কিছু রাজ্যকে বাদ দিলে গোটা দেশ জুড়ে ছবিটা মোটামুটি একই রকম। বিজেপির প্রচুর ভোট কমেছে, আসনও কমেছে নব্বইয়ের বেশি। অন্য কিছু রাজ্য ও এলাকায় ভোট বৃদ্ধি এবং নতুন আসন লাভের বলে আসন হ্রাসের মাত্রা কমে হয়েছে দু’শো চল্লিশ। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ত্রিশ কম, ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ৩৭০ থেকে একশো ত্রিশটি আসন পিছিয়ে। গণরায়ের সর্বভারতীয় চরিত্র এবং সাধারণ অভিমুখ নিয়ে তাই বিতর্কের তেমন কোনও অবকাশ নেই। গদি ধরে রাখতে ‘একাই একশো’ নরেন্দ্র মোদীকে এ বার জোটের পথে হাঁটতে হবে। একেই বোধ হয় বলে ইতিহাসের মুচকি হাসি বা প্রতিনিধির জন্য পরমাত্মার অমোঘ নির্দেশ!
রাজনীতি বিজ্ঞানীরা এই গণরায়ের মধ্যে ধারা পরিবর্তনের স্পষ্ট সঙ্কেত না দেখলেও ভারসাম্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা অবশ্যই দেখছেন। কংগ্রেসমুক্ত ভারতের স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দিয়ে কংগ্রেস আবার তিন অঙ্কের দোরগোড়ায় ফিরে এসেছে। বিরোধীমুক্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের ষড়যন্ত্রকে চূর্ণ করে দু’শোর বেশি আসন নিয়ে জোরালো ভাবে উঠে এসেছে ইন্ডিয়া জোট। শাহজাদার বয়সের থেকে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কম থাকবে দাবি করা উদ্ধত শাসক এখনও অহঙ্কারের অঙ্ক কষে চলেছে, গত তিন নির্বাচনে কংগ্রেসের পাওয়া মোট আসন থেকে বিজেপির আসন সংখ্যা এ বারও বেশি অথবা পুরো ইন্ডিয়া জোটের থেকে বিজেপি একাই বেশি আসন পেয়েছে ইত্যাদি।
এই মুহূর্তে সরকার না বদলালেও দেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। গণতন্ত্র পেয়েছে রুখে দাঁড়ানোর জায়গা ও সময়। ভারতের সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত অংশের অনেকের জন্যই গণতন্ত্র হয়তো একটা অলঙ্কারের থেকে বেশি কিছু নয়। প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ যাদের আছে তারা অনেকেই সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপক ভারতীয় জনগণের জন্য গণতন্ত্রের খোলা হাওয়া হল বেঁচে থাকার অক্সিজেন। এই অক্সিজেন হারিয়ে দমবন্ধ পরিবেশে রাজার কৃপার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা অসহায় প্রজার অবস্থায় ফিরে যেতে দেশের সাধারণ মানুষ মোটেই রাজি নন।
সংবিধানের প্রস্তাবনা ও জাতীয় পতাকা হাতে শাহিন বাগের সংগ্রামী মা-বোনেরা যে নাগরিকত্ব রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, এ বারের নির্বাচনে সেই সংবিধান উঠে এসেছে ব্যাপক জনগণের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন বা লড়াইয়ের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে। এ বারের নির্বাচনের এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। জোট সরকার চালাতে অনভ্যস্ত অহঙ্কারী মোদী সরকার হয়তো তার নিজের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনেই এক সময় ভেঙে পড়বে। ক্ষমতার অলিন্দের এই ঝগড়া ও আপসের হিসেবের উপর দেশ অবশ্যই চোখ রাখবে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের কাজ গণরায়ের ভিত্তিতে নতুন সরকারের উপর গণচাপ সৃষ্টি করা। এক্সিট পোলের আড়ালে শেয়ার বাজারে ত্রিশ লক্ষ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি বা নিট পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ব্যাপক ছাত্র অসন্তোষ। যে কোনও প্রশ্নেই এ বার যেন সরকার সহজে পালাবার পথ না পায়।