Women

ভারতে মেয়েরা কেমন আছেন

বর্তমান ভারতে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের বিষয়টি হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক বিষয়, যার মূল্যায়ন হয় বার্ষিক রিপোর্টে কেবলমাত্র সাংখ্যমানের উন্নতির ভিত্তিতে।

Advertisement

প্রহেলী ধর চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ০৭:৫৩
Share:

—প্রতীকী ছবি।

গত ন’বছরে ‘মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ঘটনা’-র হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬%। নরেন্দ্র মোদীর আমলে ভারতে মেয়েরা কেমন আছেন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্যই তা বলে দেয়। এ দেশে মেয়েরা নিজের পরিবারের হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত— নির্যাতনের ঘটনার গড়পড়তা চল্লিশ শতাংশই গার্হস্থ হিংসাকেন্দ্রিক। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গার্হস্থ হিংসার জনসংখ্যা সমাযোজিত হার বেড়েছে ১৬%, অথচ তা থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার হারে কোনও উন্নতিই হয়নি। ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে সরকারি হেফাজতে থাকাকালীন মেয়েদের যৌন লাঞ্ছনা এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৮৩টি, যার ৬৫ শতাংশই ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে।

Advertisement

রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০২২-এর প্রতিবেদন ‘নারী নির্যাতন হ্রাসের দশটি উপায়’ বলছে, প্রথম পদক্ষেপ হল মুখ বুজে সহ্য না করে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কিন্তু কেন করেন না মেয়েরা প্রতিবাদ? কেন মুখ খোলেন না অন্যায়ের বিরুদ্ধে? কারণ মূলত দু’টি— একটি অর্থনৈতিক, অপরটি সামাজিক। অর্থনৈতিক কারণটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মেয়েদের অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, যা এ দেশের মেয়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পথে প্রধান অন্তরায়— যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান জোগায়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কঠিন। মেয়েদের এই পরনির্ভরশীলতা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত নয়; এ-এক সামাজিক পাঠ, যা সমাজ মেয়েদের শিখিয়েছে, অভ্যস্ত করিয়েছে ঐতিহ্যের মোড়কে মুড়ে।

এ দেশের মেয়েদের কাজের বাজারে যোগদানের হিসাব দেখা যাক। ২০১৪-২০১৯ সালের মধ্যে এ দেশের মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার বেড়েছিল এক শতাংশেরও কম। এমনকি তার আগের দীর্ঘ ১৬ বছরেও (১৯৯১-২০১৮) তা বেড়েছিল এক শতাংশের কম হারে। যদিও এর বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে এ তথ্য বর্তমানে বহুল প্রচার পাচ্ছে যে, গত তিন বছরে (২০২০-২০২৩) মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার ব্যাপক ভাবে বেড়েছে। ২০২০ সালে প্রতি ১০০ জন শ্রমিকে মহিলা-শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৫, ২০২৩-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯। তিন বছরে ১৬% বৃদ্ধি মুখের কথা নয়। কিন্তু শঙ্কা জাগে, এই বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হবে না। প্রথমত, বিশ্বের সর্বত্র যখনই আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, সাময়িক ভাবে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান বেড়েছে। যেমন, প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ির ছেলেরা যুদ্ধে গেলে, জীবনযাত্রার প্রয়োজনে মহিলারা দলে দলে কাজে যোগ দেন ও মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার ঊর্ধ্বমুখী হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষের কয়েক বছরের মধ্যেই তা আবার হয়ে যায় যে কে সেই। ভারতের এই বৃদ্ধিও কি কোভিড অতিমারির ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কারণে? ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের ২০২০-২০২৩ সালের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট বলছে, গত তিন বছরে শুধু ভারতে নয়, কার্যত গোটা দুনিয়াতেই মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান বেড়েছে। মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের বিচারে ভারতের ক্রম-অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি। ২০২০ সালে ছিল গোটা বিশ্বে শেষ থেকে পঞ্চম স্থানে, ২০২৩-এও তা-ই।

Advertisement

বর্তমান ভারতে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের বিষয়টি হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক বিষয়, যার মূল্যায়ন হয় বার্ষিক রিপোর্টে কেবলমাত্র সাংখ্যমানের উন্নতির ভিত্তিতে। মেয়েরা যে ধরনের কাজে যোগ দিচ্ছেন, তা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী কি না, তা দেখাই হয় না। বর্তমানে ভারতের কর্মরত মহিলাদের একটা বড় অংশ বেতনহীন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীশ্রম বিষয়ে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্মরত মহিলাদের মাত্র ১৬% নিয়মিত ও নিশ্চিত বেতন বা মজুরিযুক্ত কাজে নিযুক্ত। ২২% অস্থায়ী কর্মী, ২৫% স্বনিযুক্ত কর্মী আর ৩৭% সম্পূর্ণ বেতনহীন পারিবারিক শ্রমে যুক্ত। অর্থাৎ, তাঁরা শ্রমের বাজারের অংশ হলেও উপার্জনহীন।

উপার্জনের গুরুত্ব বাড়িয়ে বলা মুশকিল। নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় ধাপ সেটাই। তা ছাড়াও, সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন যে, সংসারে মহিলাদের হাতে অর্থ এলে পারিবারিক কল্যাণকর কাজে ব্যয় বৃদ্ধি হয়। গোটা পরিবারেরই অপ্রয়োজনীয় খরচ কমে। মহিলাদের নিজস্ব ও সন্তানদেরও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।

এ দেশের মেয়েদের স্বাস্থ্যখাতে দুর্দশার ছবিটি কেমন? পঞ্চম জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ সালের মধ্যে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার, মা-প্রতি শিশু জন্মহার, কুমারীমাতৃত্ব বা নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসের মতো বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও, উল্লিখিত জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট থেকে জানতে পারি যে, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের নিরিখে ২০২৩ সালেও ভারতের অবস্থান বিশ্বের শেষ পাঁচে। এর একটি কারণ অবশ্যই বিশ্বের বাকি দেশগুলির মহিলাদের চেয়ে ভারতীয় মহিলাদের তূলনামূলক খারাপ অবস্থা। অপর কারণটি হল, স্বাস্থ্যকে কেবলমাত্র কয়েকটি সূচক দিয়ে মাপা যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্য বলতে আমরা সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমৃদ্ধিকে বুঝব। ফলত, যে দেশে নারী নির্যাতনের হার এত বেশি, তাঁদের স্বাধীন উপার্জন ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা এত কম, সামাজিক নীতি ও শৃঙ্খলার বাঁধন যে দেশের নারীর জন্য এত কঠিন ও একপেশে, সে দেশের মেয়েরা যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন না, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন রাখে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement