—প্রতীকী চিত্র।
পঞ্চাশ থেকে ষাটটি পরিবারের একটি করে শৌচালয়ের জায়গা। পাশেই নোংরা আবর্জনার স্তূপ। ড্রেন দিয়ে নোংরা কালো জল উপচে উঠছে মিল মহল্লার দু’-পাশের রাস্তা জুড়ে। দুর্গন্ধে জীবন হাঁসফাঁস মিলের শ্রমিকদের। এখানেই তাঁদের বসবাস। পুরসভা থেকে লেবার অফিস, বহু দৌড়াদৌড়ি করেও লাভ হয়নি। কেবল কয়েক দফা ছবি তোলাতুলি হয়েছে। তার পরে আবার বৃষ্টির মরসুম চলে এসেছে— রাস্তার জল ড্রেনের পচা কালো জলে মিশে গিয়ে উঠবে ঘরের দুয়ারে। শ্রমিকদের ঘরগুলির টালির চালেও বড় বড় ফুটো, সবাই সেগুলি মেরামত করতে ব্যস্ত। নইলে বর্ষায় ঘর ভেসে যেতে পারে!
এমনই অবস্থা জুটমিল শ্রমিকদের বাসস্থানের। একেই জুন-জুলাই মাস বছর শেষের মাস পাটশিল্পে। অনেক শ্রমিক এই সময় গ্রামে যান চাষাবাদের কাজে হাত লাগাতে। এটাই আবার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মাস— কখনও পাট না থাকার অজুহাতে, আবার কখনও ‘মালের অর্ডার’ না থাকার কারণ দেখিয়ে। কাজের শিফ্টও কমিয়ে দেওয়া হয়। নতুন বছরে মিল যখন চালু হয়, তখন দেখা যায় ‘ভাউচার’ শ্রমিকের ভিড়। এঁদের নাম-নম্বর মিল-শ্রমিকদের তালিকায় ওঠে না, দৈনিক মজুরিই কেবল পান, যার অঙ্ক (২০১৯ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী) ৩৬০-৩৭০ টাকা। প্রধানত পাটের ফড়েদের হাত ধরে এই মজুররা গ্রাম থেকে শহরে আসেন, দালাল চক্রের হাত ধরে পৌঁছন মিল ম্যানেজমেন্টের দুয়ারে। মিল-কর্তারা এঁদের দিনে ১০-১২ ঘণ্টাও খাটিয়ে নেন।
তবে ‘নম্বর’-পাওয়া শ্রমিকদের অবস্থাও তথৈবচ। প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল, তাঁদের বেতন প্রায় কিছুই বাড়েনি। বিভিন্ন বিভাগ অনুসারে তাঁদের মজুরি ৩৭০-৪২০ টাকা, ৪২০-৪৭০ টাকা অথবা ৪৭০-৫২০ টাকা। অর্থাৎ দক্ষতম শ্রমিকেরও মজুরি কেরল-কর্নাটকের রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের চেয়ে কম। উল্টে বেড়েছে খাটুনি, এবং দৈনিক মজুরির উপরে কোপ পড়ার ভয়। মিলের ভিতরে ‘চিনা মেশিন’ ঢোকার ফলে, আগে যে শ্রমিক দুটো কি তিনটে মেশিন চালাতেন, এখন তাঁকে চারটে থেকে ছ’টা মেশিন চালাতে হয়। এই মেশিনে ‘মিটার সিস্টেম’ রয়েছে, এক বার মিটার পড়ে গেলে পুরো উৎপাদন পড়ে যায়, আবার নতুন করে শ্রমিকদের কাজ শুরু করতে হয়। টাকা কেটে নেন মালিকরা। শ্রমিকেরা বাথরুমেও যেতে পারেন না ভয়ে। যদি মিটার পড়ে যায়, কী হবে? টাকা কাটা যাওয়া নিয়ে আপত্তি করলে ‘বাউন্সার’ আচ্ছা করে কিল-চড় ঠুসে দেয় শ্রমিকদের গালে পিঠে। আর একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করলে? মিল বন্ধ, নয়তো দেদার ছাঁটাই। বর্তমানে মিলের ভিতরে যে চারটি বিভাগে মিল-শ্রমিকরা কাজ করেন, সবার জন্যেই এটি প্রযোজ্য।
রাজ্য জুড়ে যখন সরকারি কর্মীদের ডিএ বৃদ্ধির আন্দোলন চলছে, তখন এ বছরে মিল-শ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি এবং মে— দু’মাসেই ডিএ বাবদ দৈনিক মজুরিতে কোপ পড়েছে। মাস গেলে তিনশো-চারশো টাকা মাথাপিছু কম মিলছে, অভিযোগ করছেন শ্রমিকরা। অধিকাংশ শ্রমিক ফ্যাক্টরি আইন (১৯৪৮) অনুযায়ী সবেতন ছুটিও পান না। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা পিএফ-গ্র্যাচুইটি পান না।
পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশার চেয়ে, ঝুঁকিই বাড়ছে বেশি। পাট ও পলিথিন মিশিয়ে বস্তা উৎপাদন করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে জুট কমিশনারের নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে কেন্দ্রের নির্দেশে। মিশ্র উৎপাদনের উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় সে প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে চটকল মালিকদের সংগঠন আইজেএমএ। সংগঠনের আশঙ্কা, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে চটকলগুলিতে পাটের সুতো ছাড়ানোর বিভাগ বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত বিভাগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ রাজ্যের প্রায় আড়াই লক্ষ চটকল শ্রমিকদের কাজ বিপন্ন হবে।
পাটশিল্পের বিপন্নতা আজকের নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক সহজলভ্য হওয়ায় পাটের চাহিদা কমতে থাকে। এর পর শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের ফলে ১৯৮৭ সালে ‘জুট প্যাকেজিং আইন’ চালু হয়। যা ধরেই চট ও চটজাত বস্তা থলের ব্যবহার বাধ্যতামলূক করা হয়; খাদ্যশস্য ও চিনির ক্ষেত্রে একশো শতাংশ এবং সিমেন্ট ও সারের ক্ষেত্রে সত্তর শতাংশ ও পঞ্চাশ শতাংশ। বর্তমানে একশো শতাংশ খাদ্যশস্য, এবং কুড়ি শতাংশ চিনির জন্য চটের বস্তা বাধ্যতামূলক। কেন্দ্রই রাজ্যের থেকে চটের বস্তা কেনে। আক্ষেপ, সেই বস্তাও সরবরাহ করতে পারে না রাজ্যের চটকলগুলি। এমনই অপেশাদারিত্বের সঙ্গে সেগুলি পরিচালিত হয়।
কেন পাটশিল্পের হাল ফেরে না, চটকল শ্রমিকের দুর্দশা ঘোচে না, সে বিষয়ে কথাবার্তার জন্য মালিকপক্ষের নাগাল খুব একটা বেশি পান না শ্রমিকরা। প্রায় প্রতিটি মিলে মালিক অনবরত পরিবর্তন হতে থাকে। আন্দোলনে মিল অচল না হলে মালিকরা শ্রমিকদের মুখোমুখি বসেন না। বরং শ্রমিকেরাই বহু বছর ধরে স্বল্প মজুরিতে শ্রম দিয়ে মিলগুলি বাঁচিয়ে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তাঁরা কৌতুক করে বলেন, মালিক আর সরকারের কাছে ‘ওয়ার্কার’ মানে ‘জোকার’।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিক বর্জনীয়, চাই পাট। অর্থনীতির দৃষ্টিতে, চটকলগুলোই পশ্চিমবঙ্গের সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে প্রধান শ্রমনিবিড় উৎপাদন ক্ষেত্র। এর ভবিষ্যৎ কী? কী হবে এই শিল্পের শ্রমিক, ও তাঁদের পরিবারের? আজও একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠল না এটা।