ভাষা, সংস্কৃতি, রূপের একতন্ত্রে পাল্টে যাচ্ছে অতীতের কাশী
varanasi

লক্ষ্মীর দেশ, না কুবেরের?

নদী আর রাজপথ, এ দুইয়ের মাঝখানে কাশীর বিখ্যাত অলিগলি। সে গলিতেই বহুবিচিত্রের সমাবেশ। নির্ভয়ে বহু দিন গলাগলি করে আছে।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৪৭
Share:

অতীত: কাশীর গলি, আশির দশকে। আজ পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছুই।

কাশীর পুরনো নদী আর ভেঙে গড়া নব্য রাজপথকে অবস্থানের নিরিখে মোটের উপর সমান্তরাল বলাই চলে। যদিও কাশীর গঙ্গায় চড়া পড়ছে, তবু তার প্রসার এখনও নয়-নয় করেও টের পাওয়া যায়। আর রাজপথ? মদনপুরা থেকে পায়ে পায়ে গোধূলিয়া মোড় হয়ে বিশ্বনাথের মন্দিরের সামনে এসে যদি দাঁড়ান, তা হলে বুঝতে পারবেন রাস্তা চওড়া হয়েছে। পুরনো পথ বদলে গিয়েছে। পথের নাম এখন করিডর। দু’দিকের পুরনো চিহ্ন ভেঙে যে ঝকঝকে চকচকে নতুন পণ্যবিপণি ও ধর্মবিপণির জন্ম, তার শরীরে বলবান একমাত্রিকতা। এমনকি সাবেক বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণার মন্দির এই রাজপথে দাঁড়ালে এখন পুরোপুরি কেন, অর্ধেকও দেখা যাবে না। দেখা যাবে তাদের চূড়ার কিছুটা, আর ঝান্ডা। কাশীর চিরকেলে বাঁদরগুলো অবশ্য মাঝে-মাঝে সেখানে বসে, হয়তো অবাক হয়ে দেখে বিশ্বনাথের মন্দিরের পুরনো-নতুন চূড়া। পুরনো শরীরের উপর নতুনের মোড়ক, অনেকটাই ঢাকা পড়েছে সোনালি আবরণে। স্ক্রু আর ফ্রেম দিয়ে সেই পাত বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দূর থেকে দেখলে সোনার মন্দির বলে ভ্রম হতে পারে। তবে রামায়ণের স্মৃতি বলে, সোনার হরিণ তো আর সোনার নয়, তা মায়ামৃগ; ইংরেজি প্রবাদ বলে, চকচক করলেই সোনা হয় না।

Advertisement

অন্নপূর্ণা আর বিশ্বনাথের মন্দিরের চার পাশে উঠেছে নতুন কাঠামো: নতুন পিনাক ভবন, লকার রুম, অন্য আয়োজন ও বন্দুকধারীদের নিরাপত্তাবেষ্টনী। সে সবের দাপটে টিনের বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া জ্ঞানবাপী মসজিদ চোখেও পড়বে না। সত্যজিতের জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় মগনলাল ফেলুদাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “জ্ঞানবাপী চিনেন?” ফেলুদার উত্তর, “চিনি।” সে তো সত্তরের দশকের শেষ। পরের চল্লিশ বছরে গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়েছে! মগনলাল মেঘরাজ, হিন্দু ধর্মের আবরণে দেশের পুরাকীর্তি বিদেশে পাচার করা স্মাগলার মেঘরাজ, এখন ফেলুদাকে বলবেন, “আপনি যে জ্ঞানবাপী চিনতেন সে জ্ঞানবাপী ঢাকা পড়ে গেছে। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা।” ফেলুদা সব দেখেশুনে তোপসেকে বলবে, “ব্যাপারটা কেমন জানিস? দুই তরফের বাড়ি পাশাপাশি ছিল। এক জন হঠাৎ কী করে যেন মস্ত বড়লোক হয়ে উঠল। তার বাড়ির চার পাশে এমন সব জাঁকজমক সাজসজ্জা গড়ে তোলা হল, অন্য তরফের অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন। তার মনে ভয়— ঢাকা পড়ে যাওয়ার, বেদখল হয়ে যাওয়ার।”

মদনপুরা থেকে গোধূলিয়া মোড় অবধি যাওয়ার পথে দু’পাশে সিল্কের শাড়ির সাবেক দোকান, পুরনো বাড়ি। রাস্তা চওড়া হয়েছে, কিন্তু ইসলামি স্থাপত্যের চিহ্নবাহী বাড়ি ও নকশা ঢাকা পড়ে যায়নি। ইউসুফ ভাইদের ‘ন্যাশনাল ফ্যাব্রিকস’ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার বছরে তৈরি হয়েছিল তাঁদের সিল্কের কারখানা। যে কার্ড ধরিয়ে দিলেন হাতে, তার পিছনে ইংরেজি, বাংলা, উর্দু আর কোনও এক দক্ষিণ ভারতীয় লিপিতে জানান দেওয়া হয়েছে ‘নেশনল ফেব্রিক্স সিল্ক কারখানা’। কার্ডে বা সাইনবোর্ডে কোন হরফ থাকছে বা থাকছে না, তা এখনকার কাশীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাশীতেই বা কেন? গোটা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতেই তো বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এক ও একতার নামে কোনও একটি ভাষা বা সংস্কৃতিকে যখন গুরুতর করে তোলার কেন্দ্রীয় প্রয়াস মাথা তুলছে, তখন বহুভাষার, বহুধর্মের, বহুসংস্কৃতির দেশে অন্যদের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-জিজ্ঞাসা তো অনিবার্য।

Advertisement

নদী আর রাজপথ, এ দুইয়ের মাঝখানে কাশীর বিখ্যাত অলিগলি। সে গলিতেই বহুবিচিত্রের সমাবেশ। নির্ভয়ে বহু দিন গলাগলি করে আছে। তবে সেখানেও একটা টানাপড়েন চলছে। ‘বাঙ্গালীর প্রাচীন প্রতিষ্ঠান’ ‘প্রসিদ্ধ ক্ষীরের প্যাঁড়া বিক্রেতা’ কালিকা মিষ্টান্ন ভান্ডার। এখন দোকান চালান দীনবন্ধু রক্ষিত। তিনি কার্ডে জানিয়েছেন, ‘দোকানের বোর্ড ও নাম দেখে আমাদের স্পেশাল প্যাঁড়া এবং স্বাদিষ্ট মিষ্টি কিনুন।’ বাঙালি কানে ‘স্বাদিষ্ট’ শব্দটি খট করে লাগে। আর বাঙালির চোখ অবাক হয়ে দেখে ‘অন্নপূর্ণা সুইটস’ কথাটি দেবনাগরীতে লেখা, তার নীচে পুনশ্চ দেবনাগরী: ‘বংগালী মিঠাইয়োঁ কা প্রাচীন প্রতিষ্ঠান’। সত্যজিতের অপরাজিত ছবির যে অংশ কাশীকে বহন করছে, সে অংশে বালক অপুর কথায় হিন্দির টান লাগে। একই বাড়িতে পাশাপাশি থাকা অবাঙালি মেয়েটি সর্বজয়াকে ভাঙা বাংলায় গঙ্গাস্নানে যাবে কি না জিজ্ঞেস করে। পাশাপাশি থাকতে থাকতে এক ভাষায় অপরের রং লাগা স্বাভাবিক, কিন্তু একের নামে অন্যকে বিপন্ন করে গিলে ফেলা সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া, সে প্রক্রিয়া এক দিনের নয়— ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটি চালানো হয়, চালানো হয় অন্য পক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।

১৯২৭-এ স্থাপিত শ্রীশ্রীসিদ্ধিকালী মাতা আশ্রম, খালিসপুরা, দশাশ্বমেধের গলির পাশেই বকুল বস্ত্রালয়, ভট্টাচার্যবাবুর দোকান। দেখলেই কিনতে হয় না। চট্টগ্রাম থেকে দেশভাগের আগেই চলে আসা পরিবারটি এখানে পরিশ্রম করে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। বললেন, কাশীর বাঙালির দুই ধরন। পূর্ববঙ্গীয়রা পরিশ্রম করে দাঁড়িয়েছেন। আর পশ্চিমবঙ্গীয়দের বড় বড় বাড়ি হাতবদল হয়েছে তাঁদেরই দুর্বলতায়। সুরা-সঙ্গীতে ডুবে থাকা বিত্তশালী পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের বাড়িগুলি তাঁদেরই আলস্যে হাতছাড়া— লক্ষ্মী তো চপলাই। লক্ষ্মী শুধু চপলা নন, তাঁর দুই রূপ। এক রূপে তিনি ‘শ্রীময়ী’, অন্য রূপে ‘ভয়ঙ্করী’। শ্রীময়ী লক্ষ্মীর বিত্তে অসামঞ্জস্যের দেখনদারিত্ব থাকে না, ভয়ঙ্করী লক্ষ্মীর সম্পদে দেখনদারিত্বের বাহার, অন্যের সম্পদকে দখল করে নেওয়ার দাপট। তখন তাঁকে লক্ষ্মী বলতে ইচ্ছে করে না। রবীন্দ্রনাথ বলতেনও না। ধনসম্পদের সেই গিলে খাওয়া কদর্য-বৃহৎ দানবীয় রূপকে তিনি কুবেরের ধন বলে চিহ্নিত করতেন। এ কালে অবশ্য কুবেরপন্থীরা তাঁকে লক্ষ্মী বলেই চালাতে চান।

কুবেরপন্থা কেবল টাকাপয়সার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় তা নয়, ধর্মের ক্ষেত্রেও তার অনুসরণ চোখে পড়ে। তখন ধর্মের সঙ্গে পুঁজির যোগাযোগ ঘটে। অশিল্পিত উৎকট দেখনদারিত্ব, উচ্চনাদ ঘোষণা, অন্যদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে নিজের একমাত্রিকতাকে জাহির করা বা নিজের উন্নতির স্বার্থে, ক্ষমতা-পুঁজির অধিকারী হওয়ার লোভে অন্যদের বিনষ্ট করা এই মার্গের বৈশিষ্ট্য। এই পথে হিন্দু-মুসলমান শাসকদের কেউ-কেউ যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, আধুনিক রাষ্ট্রশক্তিও ভাবে। যখনই এই অধর্মী কুবেরপন্থার অভ্যুত্থান হয়, তখনই এ দেশের বহুত্ব বিপন্ন হয়।

এই কুবেরপন্থী বাস্তবতা টের পাওয়া যায় গলি দিয়ে গঙ্গায় পড়লে। গলি দিয়ে রাজপথে পড়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছাকাছি গেলেও দেখা মেলে সেই মার্গের। এমনিতে কাশীর ঘাটের সাবেক নামগুলি হিন্দুধর্মের বহুমাত্রিকতার পরিচয়বাহী। সাবেক ঘাটকর্মের নানা রূপ, নানা বর্ণ। গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে আর ঘাটে অবিরত নানাক্রিয়া— সে ক্রিয়াকলাপের মধ্যে অত্বরভাব। নিষাদরাজ ঘাট, রবিদাস ঘাট, এই নামগুলি তো কেবল নাম নয়। বেদ আর উচ্চবর্ণের আধিপত্যকে অস্বীকার করে মানবধর্মের অন্য রূপের পরিচয় বহন করছে তারা। কাছেই সারনাথ। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি জৈন সংস্কৃতিরও এ তীর্থক্ষেত্র। কেউ যদি মনে করাতে চান কুতুবুদ্দিন আইবকের মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস, তা হলে তার পাল্টা পরবর্তী ইতিহাসেরও উল্লেখ করতে হবে। আকবরের সময় নির্মিত হয়েছিল হিন্দু মন্দির। ভাঙা নয়, বহুত্বকে বজায় রাখাই নদীলগ্ন এই শহরের চরিত্র। এখন কাকভোরে সশব্দ মোটরচালিত ছইহীন ও ছইওয়ালা নৌকাগুলি যখন যাত্রী নিয়ে অসিঘাটের দিকে ছোটে, তখন বহুত্বের সুর বেতালা। সকালবেলার আরতি যা উচ্চনাদী এক ‘স্পেকট্যাকল’, যা গমগমে মাইকবাহিত মন্ত্রে বলিষ্ঠ ঐশ্বর্যময় দেখনদারিত্বে হিন্দুধর্মের বিশেষ এক ব্র্যান্ডের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা বলতে চায়— এটাই হিন্দুধর্মের একক সত্য। রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষণার মাধ্যমে তা-ই বলাতে চায়, ধর্মের ও টাকার কুবেরকে নতুন লক্ষ্মী বলে মানুষকে ভোলাতে চায়।

এই রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বের রাজপথে ভারত কি তবে ঢাকা পড়ে যাবে? এই রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বই কি তবে কাশীর ঘাটগুলিতে ধ্বজা তুলে দাঁড়িয়ে গঙ্গাকে, চড়া পড়ে যাওয়া গঙ্গাকে, তার অনুবর্তী করে তুলবে? মোটরবোটের শব্দ আর মাইক-বাহিত সংস্কৃত মন্ত্রের তলায় কি তবে ক্রমশই মুছে যাবেন সন্ত রবিদাস? মুছে যাবে আকবরি আমলের কথা? উত্তর মেলে না। তবে আশাও মরে না। এ দেশ রাজপথের নয়। এ দেশ অজস্র গলির। সে গলিগুলি পরস্পরের সঙ্গে নিজের নিয়মে যুক্ত। রাজপথের একমাত্রিক সরলরেখার যোগের থেকে সেই বৈচিত্রময় গলির যোগের ইতিকথা ভিন্ন। কাশীর রাজপথকে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজপথকে, ভারতের অজস্র গলি তাদের ধর্ম-কর্ম-সমাজ-অর্থনীতির বিভিন্নতা নিয়ে কী ভাবে রুখে দিতে পারে, বা পারে না, তার উপরেই কিন্তু নির্ভর করছে এ দেশের ভবিষ্যৎ। গলিতে লক্ষ্মীর শাঁখ বাজে— রাজপথে কুবেরের ভয়ঙ্কর উচ্চনাদ।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement