Durga Puja 2023

প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন

শীলবাড়ির চারশো মিটারের মধ্যেই গোপালচন্দ্র লেনে বদনচন্দ্র রায় এস্টেটের দুর্গা পুজো এ বছর পড়ল ১৬৮তম বর্ষে।

Advertisement

সাবির আহমেদ

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৫৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

বেশ কয়েক বছর ধরে রমজান মাসে ইফতারকে কেন্দ্র করে কলুটোলা-জ়াকারিয়া স্ট্রিট জমজমাট হয়ে ওঠে। কলুটোলা বললে গড়পড়তা কলকাতাবাসীর মনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, তা এক মুসলমান-প্রধান অঞ্চলেরই, যে পাড়া ইদের আগে সেজে ওঠে। দুর্গাপুজোর আনন্দে কি তবে এই অঞ্চলের ভাগ নেই?

Advertisement

দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিবিন্যাসের পরিবর্তন কলুটোলা-জ়াকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলকে সত্যিই মুসলমান-প্রধান করেছে বটে, কিন্তু তাতে এই অঞ্চলের প্রাচীন ‘কসমোপলিটান’ চেহারাটি ঢাকা পড়েনি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে কলুটোলা স্ট্রিট, কবিরাজ রো, গোপালচন্দ্র সেন লেন বা দেবেন্দ্র মল্লিক রোড ধরে ঢুকলেই দেখা যাবে অতীতে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বাঙালিদের বড় বাড়ি, ঠাকুরদালান, মন্দির, অজস্র স্মৃতি। কলুটোলা স্ট্রিটে প্রবেশের মুখেই মতিলাল শীলের বাড়ি— তাঁর আস্তাবল এখন পেল্লায় বাড়ি ও পোস্ট অফিস। গোপালচন্দ্র লেন ধরে এগোলে বদনচাঁদ রায় এস্টেট, সাগর দত্তের বাড়ি, মল্লিক বাড়ি, কবিরাজ সত্যেন সেনের বাড়ি, পাইন ও দত্তের বাড়ি ও রাধাগোবিন্দের মন্দিরে এই অঞ্চলের বিপুল বৈচিত্রের ইতিহাস ধরা।

মতিলাল শীলের নামটা কলকাতাবাসীর চেনা ঠেকতে পারে, কিন্তু তার সম্ভাব্য কারণ হল ধর্মতলায় সাবেক মেট্রো সিনেমার পাশেই তাঁর নামাঙ্কিত গলি, এবং সেখানে একটি খ্যাতনামা পানশালার অস্তিত্ব। নামের মালিক বিস্মৃত। ১৭৯২ সালে এক সুবর্ণবণিক পরিবারে জন্ম মতিলাল শীলের। ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত মতিলাল সফল ব্যবসায়ী। বাঙালির শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নতির জন্য দু’হাতে খরচ করেছেন— মেডিক্যাল কলেজের জন্য জমি দান, অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। পুজোকে কেন্দ্র করে নারায়ণ সেবার জন্য মতিলাল সে যুগে বেশ খ্যাতি লাভ করেন। কলুটোলা স্ট্রিটে শীলবাড়ির পুজো দুই শতাব্দী প্রাচীন। পরিবারের প্রবীণতম সদস্য, ৯১ বছরের অমরেন্দ্রনাথ মল্লিক বললেন, এখনও পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় উল্টোরথের দিন থেকে। এ দিন কাঠামো পুজো হয়।

Advertisement

এলাকার পুরনো মানুষদের স্মৃতিতে এখনও রয়েছে ১৯৪৬-এর দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক অশান্তির আগুন যখন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলেছে, কলুটোলাতেও তার আঁচ এসে পড়েছিল। তবে মতিলাল শীলের বাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে যায়নি। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ছ’জন সশস্ত্র পুলিশকর্মী নিয়োগ করা হয়। পুজো নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হয়। তবে ছেচল্লিশের পর থেকে পায়ে হেঁটে, কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ হয়ে যায়। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, দাঙ্গার আঁচেও কিন্তু প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। বহু বছর ধরেই এই বাড়ির ভাড়াটিয়ারা মুর্শিদাবাদের মুসলমান। ফি বছর আমের ঝুড়ি পৌঁছে যায়, অন্য সব সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’বাড়ির আমন্ত্রণ ও দাওয়াত থাকে।

শীলবাড়ির চারশো মিটারের মধ্যেই গোপালচন্দ্র লেনে বদনচন্দ্র রায় এস্টেটের দুর্গা পুজো এ বছর পড়ল ১৬৮তম বর্ষে। মতিলাল শীলের পরিবারের মতোই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরির পিছনে এই পরিবারের অবদান আছে। পরিবারের ছোট ছেলে বদনচন্দ্র রায় ঠাকুরদালান-সহ বর্তমান বাড়িটা কিনে বসবাস শুরু করেন। এখানে ১৮৫৭ সালে আবার নতুন করে দুর্গা পুজো সূচনা হয়। এ বাড়ির স্মৃতিতেও রয়েছে ১৯৪৬।

কলুটোলার মিশ্র সংস্কৃতির পাড়ায় সে সময় এক চাপা উত্তেজনা। বদনচন্দ্র রায় এস্টেটের সংলগ্ন ফিয়ার্স লেন, কবিরাজ রো প্রভৃতি রাস্তায় হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের বসবাস। এঁদের বেশির ভাগ ‘দিল্লিওয়ালা’ বা ‘বোম্বাইওয়ালা’ উর্দুভাষী মুসলমান, নানা রকম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে রায় পরিবারের সৌহার্দমূলক সম্পর্ক ছিল। অথচ গুজব রটে গেলে বাংলার বাইরে থেকে দাঙ্গাবাজরা শহরে ঢুকে পড়ে।

এই কঠিন সময়ে প্রতিবেশী দুই মুসলমানের কথা পরিবারের বর্তমান কর্তা পশুপতিবাবু আজও মনে করেন। আলাতফ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পরিবারের সুরক্ষার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। আর এক প্রতিবেশী সামসুদ্দিনের কথাও ভোলেননি তাঁরা। ১৯৪৬-এ এ বাড়ির পুজো হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কাছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। পরের বছর দেশ স্বাধীন হলে পুজো ফিরে আসে পুরনো ঠিকানায়। পুজোকে কেন্দ্র করে কোনও রকম অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়নি, বরং প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় এ বাড়ির পুজো চলতে থাকে। পুজোর ক’টা দিন বরাবরই এই বাড়ির দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেই সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত। এ বাড়ির দুর্গাপুজোর দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ব্রেবোর্ন রোডের চার্চের ফাদার, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ ও প্রতিবেশী মুসলমানরা।

কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তকমা পেয়েছে। সেই সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের প্রতিবেশীদের মধ্যে সহৃদয় আদানপ্রদানের ঐতিহ্য। কলকাতার দুর্গাপুজো প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন— এ উৎসব সবার। কঠিনতম সময়েও কলকাতা এই কথাটি প্রমাণ করেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement