ভারতে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর জেলবন্দির সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ চুয়ান্ন হাজার। প্রতীকী ছবি।
ভারতের কারাগারে বন্দিদের সম্পর্কে ভারত সরকারের সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর জেলবন্দির সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ চুয়ান্ন হাজার। এর মধ্যে চার লক্ষ সাতাশ হাজার ব্যক্তির বিচার এখনও চলছে। আর অপরাধী প্রমাণিত হয়ে জেল খাটছেন, এ রকম সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা এক লক্ষ বাইশ হাজার, অর্থাৎ মোট বন্দির মাত্র ২২ শতাংশ। আইন কমিশন ১৯৭৯ সালে ভারত সরকারকে মনে করিয়েছিল, জেল প্রধানত সাজাপ্রাপ্তদের বন্দি রাখার জন্য, বিচারাধীনদের রাখার জন্য নয়। তখন জেলগুলোতে বিচারাধীন বন্দি ছিল ৫৬ শতাংশ (১৯৭৫), এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭ শতাংশ (২০২১)। সরকারি তথ্য অনুসারে, এ দেশে জেলগুলিতে জায়গা রয়েছে চার লক্ষ পঁচিশ হাজার বন্দির। বাস্তবে বহু জেলের বহু ওয়ার্ড সংস্কারের অভাবে বন্দি থাকার অনুপযুক্ত হয়ে উঠেছে। ঠাসাঠাসি করে, দমবন্ধ অবস্থায় বেঁচে আছেন জেলবন্দিরা।
এত বিচারাধীন বন্দি কেন? একটা কারণ, আদালতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। সারা দেশে আদালতগুলিতে বকেয়া মামলার সংখ্যা এখন পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, যার মধ্যে ৮৫ শতাংশই নিম্ন আদালতগুলোতে ঝুলে আছে। দেড় লক্ষেরও বেশি মামলা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। ২০১৮ সালে নীতি আয়োগ বলেছিল বর্তমান হারে মামলার মীমাংসা হলে এ দেশের আদালতগুলোতে জমে থাকা বকেয়া মামলার মীমাংসা করতে ৩২৪ বছর সময় লাগবে। এর একটা বড় কারণ আদালতগুলিতে বিচারকের অপ্রতুলতা। নিম্ন আদালতগুলোতে কমবেশি ৫৫০০ পদ শূন্য, হাই কোর্টেও সারা বছর ২০ শতাংশ বিচারপতি পদ শূন্যই থাকে।
আর একটি কারণও সামনে এনেছেন বিচারপতিরা। গত নভেম্বরে বার কাউন্সিল আয়োজিত একটি সভায় ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে জামিন দিলে বিচারপতিকেই নিশানা হয়ে যেতে হবে, এই ভয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকরা জামিন দিতে চান না। এর ফলে জামিনের আবেদনের শুনানির চাপ এসে পড়ে উচ্চ আদালতে। সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এক সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার কেন আরও নতুন জেল বানানোর কথা ভাবছে? সরকারের উচিত ভর্তি হয়ে-থাকা জেলগুলি শূন্য করার উদ্যোগ করা, কারণ মামলা লড়ার টাকার অভাবে দরিদ্র অভিযুক্তরা জেলে পচে মরে।
জামিন প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টকে যথেষ্ট ভাবিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সঞ্জয় কৃশন কউল এবং এম এম সুন্দরেশ সংবিধান এবং বিভিন্ন আইনের নানা ধারা বিশ্লেষণ করে জামিন দেওয়ার বিষয়ে এক বিস্তারিত নির্দেশরেখা বা ‘গাইডলাইন’ তৈরি করে দিয়েছেন (১১ জুলাই, ২০২২)। তাঁরা এ-ও বলেছেন যে, জামিন দেওয়ার শর্তাবলি সুনির্দিষ্ট করে আলাদা জামিন আইন বা ‘বেল অ্যাক্ট’ তৈরির উদ্যোগ করা উচিত সরকারের। সমস্যা হল, সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টের বিচারপতিরা যতই মামলার ভার নিয়ে ক্ষোভ জানান, সমাধানের সূত্র দিন, সরকার সে সব নির্দেশ কার্যকর করায় আগ্রহ দেখায় না। কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ রাজ্যগুলি গুরুত্ব দেয় না, কেন্দ্রও রাজ্যকে পাঠানো নির্দেশের কপি আদালতে জমা দিয়ে দায় সারে। নির্দেশ পালিত হল কি না, দেখে না। জনসংখ্যা বাড়ে, বন্দি বাড়ে।
বিচারপতি কউল ও সুন্দরেশ মনে করিয়েছেন যে, বন্দিদের একটা বড় অংশের গ্রেফতার হওয়ারই কথা নয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪১ এবং ৪১এ ধারা অনুযায়ী, সাত বছরের কম সাজা হতে পারে এমন অভিযোগে অভিযুক্তদের বিশেষ কারণ ছাড়া গ্রেফতার না করেই বিচার করার কথা। অথচ যে কোনও জেলে এ ধরনের বন্দি সব থেকে বেশি। সুপ্রিম কোর্ট আগেও বার বার বলেছে, দশ বছরের কম সাজা হতে পারে, এমন ধারায় অভিযুক্তরা পাঁচ বছর জেল খাটলেই জামিনে মুক্তি দিয়ে বিচার চালাতে হবে। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও রাজ্যগুলোকে সে পরামর্শ দিয়েছিল। বল্গাহীন গ্রেফতারি একটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা, যা রাষ্ট্রকে পুলিশ-রাষ্ট্রে পরিণত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বলেছেন দুই বিচারপতির এক জন। কিন্তু শুনছে কে?
প্রশ্ন উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টের কথামতো নতুন জামিন আইন বানালেও কি সুরাহা হবে? ব্যক্তির অধিকারের সুরক্ষায় আইন তো এখনও আছে, তার প্রয়োগ কোথায়? ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৩৭ ধারায় বলা হয়েছে, বিচারকের যদি এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকে যে, অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অভিযুক্তের যাবজ্জীবন বা ফাঁসির সাজা হবে না, তবে বিচারক অভিযুক্তকে জামিন দিতেই পারেন, বিশেষত অভিযুক্ত যদি মহিলা বা নাবালক হয়। বস্তুত রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সন্ত্রাস, টাকা পাচার বা মাদক আইনের মতো কঠোর কিছু ধারা ছাড়া অধিকাংশ আইনেই বিচারকদের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন আদালতগুলি জামিন দেয় না?
নিশানা হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্বাধীন ভাবে বিচার করতে পারেন না বিচারকরা, এইটুকুই বলেছেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর কথার বিশদ ব্যাখ্যা করেননি। তবে পশ্চিমবঙ্গের হাই কোর্টে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটল তা থেকে একটা আন্দাজ মেলে, বিচারপতিদের নিশানা করার কাজ কী ভাবে সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম— নানা দিক থেকে চাপ তৈরি হয় বিচারব্যবস্থার উপরে। অথচ, বিচারকরা তাঁদের কাজের অনুকূল পরিবেশ না পেলে ক্ষতি সকলেরই। কোনও বিচারকের কাছে কখনও ঝুঁকি নেওয়া অত্যন্ত কঠিন মনে হলে, জামিন দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতার যথোপযুক্ত প্রয়োগ না করে হয়তো তিনি অভিযুক্তকে আরও কিছু দিন পুলিশ হেফাজত বা জেল হেফাজতে পাঠাতে পারেন। কারণ সেটাই তাঁর মনে হতে পারে ‘নিরাপদ’ বিকল্প। তাতে ক্ষতি হয় মানবাধিকার, নাগরিক অধিকারের। দরিদ্রের অধিকারের সুরক্ষার জন্যই বিচারের পরিবেশের সুরক্ষা প্রয়োজন।
বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে সমর্থন করে বম্বে হাই কোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত একটি বক্তৃতায় (২১ নভেম্বর, ২০২২) বলেন, জামিন দিলে নিশানা হতে হবে, এই ভয়ে যেন নিম্ন আদালতের বিচারকদের কাজ করতে না হয়। নিজের ঝুঁকির কারণে অভিযুক্তকে প্রাপ্য জামিন না দিলে সেটা বিচারের নামে প্রহসন। তবে হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাঁরা যেন জামিনের মামলা শোনার সময় নিম্ন আদালতের বিচারকদের রায় নিয়েই শুধু আলোচনা-সমালোচনা করেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের সমালোচনা যেন না করেন। বিচারপতি দত্ত নিম্ন আদালতের বিচারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু নির্ভয়ে বিচার করার শপথ নিয়ে বিচারক হয়েছেন।
আইন বলে, জামিন দেওয়াটাই হল নিয়ম, জেল হল ব্যতিক্রম। কিন্তু ভারতে জেলগুলির প্রকৃত পরিস্থিতি দেখলে সে কথা বিদ্রুপের মতো শোনায়। স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এর বছরেও সংবিধানের ২১নং ধারায় বিধৃত নাগরিকের জীবনের অধিকার, স্বাধীন ও মুক্ত থাকার মৌলিক অধিকার ভারতে ব্যাপক ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ বড়ই দুঃখের।