Politicians

নামে তারকা, কিন্তু কাজে?

‘ইন্ডিয়াস্পেন্ড’ নামে তথ্য-চালিত, জনস্বার্থমূলক এক সংস্থা সপ্তদশ লোকসভার অধিবেশনগুলিতে তারকা সাংসদদের উপস্থিতি, বিল উত্থাপন ও বিতর্কে অংশগ্রহণের সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে একগুচ্ছ চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ ০৭:১৫
Share:

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষের পথে। এ বারেও শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া-সহ নানা ক্ষেত্রে প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তিত্ব নানা রাজনৈতিক দলের প্রতীকে লড়ছেন। ব্যক্তিবিশেষের কৃতিত্ব, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে এমন মানুষদের প্রার্থী করা হয়েছে, রাজনীতির সঙ্গে অতীতে যাঁদের ক্ষীণতম যোগও নেই। পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজনীতিতে ‘অনপঢ়’ এই তারকা প্রার্থীদের বেশির ভাগ আগে নির্বাচনে জয়ীও হয়েছেন। কিন্তু তার পর দু’-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এঁদের অধিকাংশকে জনসেবামূলক কাজে বা সাংসদ হিসাবে আইনসভায় নিজ দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে দেখা যায়নি।

Advertisement

অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনও বিধিনিষেধ নেই। অনেকের মত, নানা অভিযোগে বিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চেয়ে সমাজের নানা পরিসরের কৃতী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ যদি সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন ও আইনসভায় পৌঁছতে পারেন, তা দেশ ও দশের মঙ্গলদায়ক। এই ধারণা কি সর্বাংশে সত্যি?

‘ইন্ডিয়াস্পেন্ড’ নামে তথ্য-চালিত, জনস্বার্থমূলক এক সংস্থা সপ্তদশ লোকসভার অধিবেশনগুলিতে তারকা সাংসদদের উপস্থিতি, বিল উত্থাপন ও বিতর্কে অংশগ্রহণের সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে একগুচ্ছ চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে। নির্বাচনী হলফনামায় ঘোষিত পেশার ভিত্তিতে ১৯ জন সাংসদকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, ছিলেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-অভিনেতা, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, পরিচালক, লোকগায়ক-সহ নানা পেশাজীবী। এঁদের মধ্যে বিজেপির ১০ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৫ জন; বাকিরা অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতীকে জয়ী। পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সপ্তদশ লোকসভার কার্যকালে মোট ২৭৪টি বৈঠক হয়েছে। এগুলিতে সাংসদদের উপস্থিতির গড় হার যেখানে ৭৯%, তারকা সাংসদদের উপস্থিতির গড় হার মাত্র ৫৬.৭%। উপস্থিতির নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে ভোজপুরি অভিনেতা দীনেশ লাল যাদব, উপস্থিতি হার ৯০%। ৮৮% উপস্থিতি বাঙালি অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের। সাংসদদের গড় হাজিরার চাইতে বেশি উপস্থিতি ছিল আরও দুই তারকার, অভিনেতা মনোজ তিওয়ারি (৮৫%) এবং অলিম্পিক পদকজয়ী রাজ্যবর্ধন রাঠৌর (৮০%)। লোকসভা-উপস্থিতির তালিকায় শেষের দিক থেকে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে তিন বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী, উপস্থিতির হার যথাক্রমে ১২%, ২১% ও ৩৯%।

Advertisement

একই গবেষণায় গত লোকসভায় তারকা সাংসদদের ‘পারফরম্যান্স’ সম্পর্কেও নানা তথ্য উঠে এসেছে। তারকা সাংসদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কে যোগ দিয়েছেন ওড়িয়া অভিনেতা অনুভব মোহান্তি (৮২), দ্বিতীয় ভোজপুরি অভিনেতা রবি কিশন (৮১)। বাংলার একমাত্র দীপক অধিকারী, অংশগ্রহণ করেছিলেন একটি বিতর্কে। বিগত লোকসভায় সাংসদরা গড়ে ২১০টি প্রশ্ন করলেও ১৯ জন তারকা সাংসদের মধ্যে মাত্র চার জন জাতীয় গড়ের চাইতে বেশি প্রশ্ন করেছেন: রবি কিশন (৪৮০টি ), মনোজ তিওয়ারি (৩৯৫), লকেট চট্টোপাধ্যায় (২৯৫) এবং সুমালতা অম্বরীশ (২১০)। প্রাইভেট বিল পেশ করেছেন মাত্র চার জন তারকা সাংসদ: রবি কিশন ১০টি, অনুভব মোহান্তি ৩টি, লকেট চট্টোপাধ্যায় ২টি, গৌতম গম্ভীর ১টি।

ভারতীয় সাংসদরা যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, সে দিকে তাকালে সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। এক জন সাংসদ প্রতি মাসে মোটা বেতনের সঙ্গে সংসদের বৈঠকে বা বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য বৈঠকের আগে-পরে তিন দিন এবং কমিটি মিটিংয়ের আগে-পরে দু’দিন-সহ বৈঠক বা মিটিংয়ের দিনে দৈনিক ভাতা পান। ভারতের যে কোনও জায়গায় যে কোনও সময় ভ্রমণের জন্য রেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণি/এগজ়িকিউটিভ শ্রেণির হস্তান্তর-অযোগ্য পাস এবং ‘অ্যাটেনডেন্ট’-এর জন্য এসি টু-টিয়ার হস্তান্তর-অযোগ্য পাস তাঁদের জন্য বরাদ্দ; কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। তাঁরা সম্পূর্ণ নিখরচায় বছরে মোট ৩৪ বার বিমানভ্রমণ করতে পারেন, এর মধ্যে সাংসদের স্ত্রী/স্বামীর বছরে ৮ বার নিঃশুল্ক বিমানযাত্রা অন্তর্ভুক্ত। আছে চিকিৎসার খরচ, অফিস বাবদ খরচ, বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস, টেলিফোন, গাড়ি, লাইসেন্স ফি-মুক্ত আবাসন-সহ আরও অজস্র সুবিধা।

এক জন সরকারি কর্মচারী যেখানে অন্যূন কুড়ি বছর ‘ছেদহীন সন্তোষজনক সেবা’ দানের পর পেনশনের যোগ্য হন, সেখানে সাংসদেরা এক বার নির্বাচিত হলেই আজীবন পেনশন ভোগ করেন, যা তাঁর কার্যকালের মেয়াদের সঙ্গে সম্পর্করহিত। একাধিক বার নির্বাচিত সাংসদদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যে বরাদ্দ উক্ত পেনশনের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রতি বছরের জন্য নির্দিষ্ট হারে পেনশন বৃদ্ধির সংস্থান রয়েছে, পারিবারিক পেনশনও।

তারকারা-সহ ভারতীয় সাংসদদের একাংশ তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে উদাসীন বা অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণের করের টাকায় এত সুযোগ-সুবিধা ভোগে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। আশ্চর্যের বিষয়, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কর্তব্যে গাফিলতির জন্য নানা শাস্তির বিধান থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে নেই। সংসদে বৈঠকের জন্য প্রতি মিনিটে খরচ হয় প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। সেখানে গরহাজির থেকে, বা সংসদীয় গণতন্ত্রে সামান্যতম অবদান ছাড়াই আজীবন এই বিপুল সুযোগ-সুবিধা আত্মসাৎ কি অপরাধের শামিল নয়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement