আমেরিকার সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্রে খুব কম সুদ দেয় মাত্র ০.২৫%। ফাইল ছবি।
আমেরিকার অর্থনীতিতে এক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে— সরকারের ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে ঋণগ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা ৩১.৪ লক্ষ কোটি ডলারে। আপাতত জুনের গোড়া অবধি সময় পাওয়া গিয়েছে— তার মধ্যে সমাধানসূত্র না মিললে আমেরিকার অর্থব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। রাজনৈতিক কারণে কর বাড়ানো অসম্ভব। এ দিকে কোভিডের সময়ে দেদার অনুদান আর বর্তমানে প্রচুর উন্নয়নমূলক খাতে টাকা লগ্নি করে বাইডেন সরকারের অবস্থা কাহিল। ব্যয় কমানোও সহজ নয়। কর না বাড়িয়ে, ব্যয় না কমিয়ে ঋণসীমার নির্দেশিকা কী ভাবে মানা সম্ভব? এই ধরনের কট্টর ঋণসীমার কি কোনও যৌক্তিকতা আছে?
আমেরিকার সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্রে খুব কম সুদ দেয় (মাত্র ০.২৫%)। লোকে তাও এই ঋণপত্র কেনে, কারণ এই বিনিয়োগে ঝুঁকি কম, এবং যখন খুশি বেচে দেওয়া যায়। ঝুঁকি কম, কারণ মানুষের বিশ্বাস যে, সরকার কখনও দেউলিয়া হবে না। কিন্তু সরকার এই ঋণসীমা অমান্য করলে সেই সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমেরিকান ঋণপত্র শুধুমাত্র সে দেশের নাগরিকরাই কেনেন না, অধিকাংশ দেশের শীর্ষব্যাঙ্কের কাছে এটি একটি নিরাপদ সম্পদ। সরকার যদি ঋণপত্রধারীদের টাকা দিতে অপারগ হয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। এই অবস্থায়, নতুন ঋণপত্র বাজারে ছেড়ে, যে ঋণপত্রগুলির মেয়াদ শেষ হচ্ছে সেগুলির সুদ আর আসল মিটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, এই পদ্ধতি বেশি দিন চলতে পারে না, কারণ এতে মানুষ সরকারের ঋণশোধের ক্ষমতায় বিশ্বাস হারাতে পারেন।
২০১১ সালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখন ঋণসীমা লঙ্ঘন না করে সরকারি ব্যয় চালানোর এক অভিনব পদ্ধতি প্রস্তাব করেছিলেন বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ। আমেরিকার কোষাগারের মুদ্রা তৈরি করার আইনগত ক্ষমতা আছে। নিয়ম, পঞ্চাশ ডলারের অধিক মূল্যের সোনা বা রুপোর মুদ্রা বানানো যাবে না। কিন্তু প্ল্যাটিনাম মুদ্রার উপরে এ রকম কোনও বিধিনিষেধ নেই। কোষাগার চাইলে লক্ষ কোটি ডলারের প্ল্যাটিনাম মুদ্রা বানাতে পারে, সেই মুদ্রা দেশের শীর্ষব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়াৰ্ভে বন্ধক রেখে টাকা ধার করে সরকার খরচ চালাতে পারে। এই প্ল্যাটিনাম মুদ্রাগুলি শীর্ষব্যাঙ্কের ব্যালান্সশিটে সম্পদ হিসাবে ধরা হবে। অন্য দিকে, শীর্ষব্যাঙ্ক টাকা ছাপালে সেই টাকা হল ব্যাঙ্কের দায়। যত ডলারের সম্পদ জমা পড়বে, তত ডলারের নোট ছাপানো যাবে। এই পদ্ধতিতে, কংগ্রেসের ঋণসীমা অমান্য না করেও সরকারের খরচ চালানো সম্ভব হবে।
প্রশ্ন হল, এ পদ্ধতির ফলে কি মূল্যবৃদ্ধি হবে? মূল্যবৃদ্ধি তখনই হয়, যখন কোনও কারণ ছাড়াই নাগরিকের হাতে টাকা এসে পৌঁছয়, যার ফলে পণ্যের চাহিদা বাড়ে জোগানের সঙ্গে সাযুজ্য না রেখে। সরকারি ঋণের প্ল্যাটিনাম মুদ্রায়ণ হলে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি না হওয়ারই সম্ভাবনা, যদি সরকার টাকা নাগরিকদের মধ্যে বিলি না করে উৎপাদনশীল প্রকল্পে ব্যয় করে।
সরকারি দেনার এই প্ল্যাটিনামকরণ সুষ্ঠু ভাবে চলতে পারে, যদি শীর্ষব্যাঙ্ক এই প্রস্তাবে রাজি থাকে। মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার শীর্ষব্যাঙ্ক একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারের অনুরোধ না শোনার অধিকার তার আছে। এই প্ল্যাটিনাম মুদ্রায়ণের মানে হল, শীর্ষব্যাঙ্ক ডেমোক্র্যাট সরকারের উদার ব্যয়নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এ সব ভেবেই ট্রেজ়ারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইলেন ঋণের প্ল্যাটিনামকরণের প্রস্তাবটি সম্প্রতি খারিজ করে দিয়েছেন। ২০১১ সালে বারাক ওবামাও প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে এই প্রস্তাবটির মধ্যে অনেক চিন্তাভাবনার খোরাক আছে, যা অন্য দেশগুলির ঋণ নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগতে পারে।
যেমন, ভারতের অভ্যন্তরীণ সরকারি দেনা এখন প্রায় দেড়শো লক্ষ কোটি টাকা। আমেরিকার মতো ভারতে কোনও ঘোষিত ঋণসীমা নেই। তবে কেন্দ্রীয় সরকার, ভারতের প্রদেশগুলির ঋণের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে, যা অনেক সময়ই রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার টাঁকশালে টাকা এবং মুদ্রা তৈরি হয়। সরকার চাইলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে দেড়শো লক্ষ কোটি টাকার ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে। এই ঋণপত্রগুলি প্ল্যাটিনাম মুদ্রার মতোই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিটে সম্পদ হিসাবে পরিগণিত হবে। পরিবর্তে ব্যাঙ্ক টাকা ছাপাবে, যেটি ব্যাঙ্কের দায় হিসেবে গণ্য হবে। এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় সরকারি ঋণের মনিটাইজ়েশন। এর ফলে যদিও টাকার জোগান বাড়বে, মূল্যবৃদ্ধি ততটা হবে না যদি সরকার এই টাকা উৎপাদনশীল প্রকল্পে ব্যয় করে। অন্য দিকে, যদি সরকার এই ঋণপত্রগুলি আমজনতাকে বিক্রি করে, তা হলে ঋণের বাজারে সরকার চাহিদা বাড়িয়ে সুদের হার বাড়িয়ে দেবে, যার ফলে অনেক বিনিয়োগ, যা ঋণের উপর নির্ভরশীল, ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকারি ঋণ বাড়া কি দেশের পক্ষে অকল্যাণকর? প্রধান সমস্যা সরকারি দেনার পরিমাণ নয়, সরকারি দেনার সঙ্গে জাতীয় আয়ের অনুপাত। এই অনুপাতটি ক্রমশই বেড়ে লাগামছাড়া হয়ে গেলে মুশকিল। সামান্য হিসাব কষলেই বোঝা যাবে যে, সুদের হার থেকে মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে যে প্রকৃত সুদের হার পাওয়া যায়, তা যদি জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারের থেকে কম হয়, এই অনুপাতটি স্থির থাকবে। সরকার বড় দেনা ঘাড়ে নিয়ে অনেক দূরের পথ পরিক্রমা করতে পারবে, যদি সরকারি ব্যয় উৎপাদনশীল হয় আর তা দেশে সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। সুতরাং সরকারি ব্যয়ের উৎপাদনশীলতা না বিচার করে একটি ঋণসীমা বেঁধে দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। আমেরিকাতে সম্প্রতি জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ২.৯% হয়েছে। ভারতে বৃদ্ধির হার এখনও বিশ্বের কাছে ঈর্ষণীয়। অন্য দিকে, মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রকৃত সুদের হার বৃদ্ধির হারের থেকে অনেক কম। ভারতের সরকারি দেনা জাতীয় আয়ের ৮৯ শতাংশ, যা আমেরিকার ১২৯ শতাংশ থেকে অনেক কম। এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে সরকারি ঋণ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার আপাতত তেমন কারণ নেই।