কোনও রাষ্ট্রের শক্তির কথা ভাবলে আমরা সচরাচর শক্তিশালী সরকারের কথা ভাবি, মনে পড়ে সুপ্রশিক্ষিত শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনাবাহিনীর কথা, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের কথা। আজকের বহুস্তরীয় জটিল দুনিয়ায় কোনও সরকারের পক্ষে কার্যকর হতে গেলে এই বস্তুগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, আরও এক রকম শক্তি আছে, যার কথা তুলনায় অনেক কম আলোচিত হয়, কিন্তু গুরুত্ব যার তিলমাত্র কম নয়। একে বলা হয় ‘সফট পাওয়ার’ বা ‘নরম শক্তি’— এটি এমন এক শক্তি, যা অর্জিত হয় শিক্ষা, বিজ্ঞানের দ্বারা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির দ্বারা। কোনও দেশকে যদি ধারাবাহিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করতে হয়, তবে এই নরম শক্তির দিকে নজর না দিয়ে উপায় নেই।
উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তি নিয়ে কারও সংশয় নেই। কিন্তু, তাদের অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া— সুস্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক দিয়ে, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার মানের নিরিখে। তা সম্ভব হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার নরম শক্তির কল্যাণে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু, আজ সে দেশ যেখানে পৌঁছেছে, তা সম্ভব হয়েছে এই কারণেই যে, তারা নরম শক্তি গড়ে তোলার পিছনে প্রভূত বিনিয়োগ করেছে— উৎকৃষ্ট বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে, বিভিন্ন বিষয় শেখার কেন্দ্র তৈরি করেছে, শিল্প এবং সঙ্গীতকে গুরুত্ব দিয়েছে।
আজ থেকে একশো বছরের কিছু বেশি আগের দুনিয়ার খোঁজ করলে দেখব, সে সময় আর্জেন্টিনা বিশ্বের ধনীতম দশটি দেশের মধ্যে একটি ছিল। তার আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছিল অত্যন্ত দ্রুত হারে। সে সময় অনেকেরই ধারণা ছিল, আর্জেন্টিনা টপকে যাবে আমেরিকাকে। ১৯৩০-এর দশক থেকে ছবিটি পাল্টে গেল— আর্জেন্টিনার অর্থব্যবস্থা ধাক্কা খেতে আরম্ভ করল; আমেরিকা হয়ে উঠল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে কোনও ঘটনার কারণ সম্বন্ধে কখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে, আর্জেন্টিনার আর্থিক গতিভঙ্গের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ১৯৩০ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসে ফেলিক্স উরিবুরু সে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই সেখানে দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ক্যাথলিক মৌলবাদের উত্থান ঘটতে থাকে। আমদানি কর বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্যের পথে বাধা তৈরি করা হয়, অভিবাসন বন্ধ করা হয়, এবং শুরু হয় বিদেশিদের প্রতি প্রকাশ্য ঘৃণাভাষণ।
অন্য দিকে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র খুলে দেয় তাদের দরজা-জানলা। আমেরিকা সবচেয়ে বেশি জোর দেয় সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে পুষ্ট করে তোলার কাজে। এখন গোটা দুনিয়ায় তার তুল্য শিক্ষাব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নরম শক্তিতে এই বিনিয়োগ নিয়ে যতখানি আলোচনা হওয়া উচিত, তা হয় না। আমার মতে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘স্ট্রং পাওয়ার’ বা রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির অপব্যবহার করেছে বিভিন্ন বৈশ্বিক ঘটনায়। কিন্তু তাদের সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে, এবং দেশকে অগ্রসর করেছে নরম শক্তিতে তাদের বিপুল বিনিয়োগ।
আমি এখন এই কথাগুলো লিখছি, তার একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। ভারতের অবস্থার দিকে নজর রাখতে গিয়ে, এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মীরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে আমার সংশয় হয় যে, ভারত নিজের নরম শক্তিকে অবহেলা করার ভুলটি করছে। আশঙ্কা যে, ইতিহাস বইয়ের যে পাতায় ভারতের নাম লেখা হবে, সেটি আমাদের কাম্য নয়। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা টলমল। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি প্রভূত চাপে রয়েছে— আর্থিক টানাটানি যেমন আছে, তেমনই উপর থেকে ক্রমাগত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিষ্ঠানগুলির অভ্যন্তরে বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার পরিসর নষ্ট করে দিচ্ছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভাল ভাবে চলছে বটে, কিন্তু ভারতের মতো বিপুল দেশে সেটুকু যথেষ্ট নয়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ।
সত্যিই যদি তা ঘটে, তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। কারণ, ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ের গোড়ার দিকের সাফল্যের চালিকাশক্তি ছিল উচ্চশিক্ষা। গোটা দুনিয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভারতীয়দের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখেও তা আঁচ করা সম্ভব। বিশ্বের বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির মধ্যে অনেকগুলির শীর্ষে অধিষ্ঠিত ভারতীয়রা; আমেরিকা-সহ ইংরেজি-ভাষী দুনিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সবচেয়ে খ্যাতনামা ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষক ও অধ্যাপকদের মধ্যেও ভারতীয়দের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের এই সাফল্য স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের সুফল।
স্বাধীনতার সময়েই কলকাতা গণিত, বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার এক অতি উজ্জ্বল কেন্দ্র ছিল— ভারতীয় নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় এই শহর চিরকালই অগ্রণী: রামমোহন রায় থেকে জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সি ভি রামন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেড় শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে কলকাতা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের কর্মস্থল ছিল। মাদ্রাজ, বম্বে, এলাহাবাদ-সহ অন্য কিছু শহরও ছিল বেশ কিছু অতি প্রতিভাবান মানুষের কর্মস্থল; এবং সেই শহরগুলিতেও গড়ে উঠেছিল উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার এই অনুকূল পরিবেশ দিব্য খাপ খেয়েছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নরম শক্তিতে বিনিয়োগ করার স্বাভাবিক প্রবণতার সঙ্গে। তাঁর সমসময়ে গোটা দুনিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হিসাবে নেহরু ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, বিক্রম সারাভাইয়ের মতো অগ্রণী চিন্তক ও বিজ্ঞানীদের নেহরু যুক্ত করেছিলেন তাঁর কর্মসূচির সঙ্গে, দেশগঠনের প্রকল্পে। স্বাধীনতা অর্জনের চার বছরের মধ্যেই খড়্গপুরে প্রতিষ্ঠিত হল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি; একে একে তৈরি হল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স, প্রভূত গুরুত্ব বাড়ল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের। এই সময়েই ডালপালা বিস্তার করল বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ।
আজ যখন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্বভারতীর মতো বহু প্রতিষ্ঠান অবহেলায় দীর্ণ, প্রতিষ্ঠানগুলির অভ্যন্তরে বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার পরিসর সঙ্কুচিত, প্রতিষ্ঠানগুলি আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত, তখন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পাশে তাকে এক চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি বলে মনে হয়। ভারত যে নিজের নরম শক্তির গুরুত্ব ভুলেছে, তাকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তা বিভিন্ন ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, অমর্ত্য সেনের মতো বৈশ্বিক খ্যাতিমান ভারতীয় চিন্তকদের হয়রান করতেও রাষ্ট্রশক্তি আর দ্বিধা করে না।
অথচ, কিছু দিন আগেও দেশটা অন্য রকম ছিল। ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে সেখানকার ছাত্ররা তাঁর আর্থিক নীতির বিরোধিতা করতে তাঁকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদী ছাত্রদের নোটিস পাঠান। খবর পেয়ে হস্তক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং— ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মানা করেন তিনি। বলেন, প্রতিবাদ করা ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সে দিন মনমোহন সিংহ ক্যাম্পাসে ছাত্রদের বিক্ষোভের মধ্যেই নিজের বক্তৃতা শুরু করেন ফরাসি দার্শনিক ভল্তেয়ারের কথা উদ্ধৃত করে: “তোমরা যা বলছ আমি তার সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমার জীবন দিয়ে তোমাদের সে কথা বলার অধিকার রক্ষা করব।”
১৯৩০-এর দশকে আর্জেন্টিনা আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যেমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিল, ভারত এখন তেমনই এক সন্ধিক্ষণে উপনীত। এখন একটাই আশা: দেশের মানুষ ঠিক বিকল্পটি বেছে নেওয়ার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা দেখাবেন।