‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ হয়ে উঠতে পারে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কর্মসূচি
Congress

যার শক্তি যেখানে

‘ইন্ডিয়া’ জোটের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, সেই আলোচনায় এই হিসাব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কয়েকটা কথা মনে রাখা ভাল। প্রথমত, বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন লোকসভায় ঘটবে, তেমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৭
Share:

জোয়ার: কাশ্মীরে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় সকন্যা মেহবুবা মুফতির সঙ্গে রাহুল গান্ধী। ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

২০২৩ কি তবে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অকাল মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করে দিল? জোটের বড় শরিক হওয়ার আশা ছিল যার, সেই কংগ্রেসের হাতছাড়া হল রাজস্থান আর ছত্তীসগঢ়; মধ্যপ্রদেশ নাগালের বাইরেই থেকে গেল। তেলঙ্গানায় দল জিতল বটে, কিন্তু সে জয় বিজেপির বিরুদ্ধে নয়, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্র সমিতির বিরুদ্ধে। ভারতীয় রাজনীতির বিশ্লেষকরা দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছলেন যে, দলকে সম্পূর্ণ দিশাহারা দেখাচ্ছে— অশোক গহলৌত আর সচিন পাইলটের অন্তঃকলহ, কমল নাথের কার্যত দলের সব নেতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, ভূপেশ বাঘেলের কাঁচা হিন্দুত্ব, কোনও কিছুই সামলানোর উপায় যেন জানা নেই হাই কম্যান্ডের। বছরের গোড়ায় ভারত জোড়ো যাত্রায় যে অভাবনীয় সাড়া মিলেছিল, সে কথাও মনে পড়া কঠিন হল বছরের শেষে পৌঁছে।

Advertisement

কংগ্রেস বিপন্ন হলেই ইন্ডিয়া জোটও বিপন্ন হয় কি না, সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে বরং একটা অন্য প্রশ্ন করা যাক— কংগ্রেস কি আদৌ বিপন্ন? অন্তত, বছর শুরুর সময় যে জায়গায় ছিল, বছরের শেষে তার চেয়ে মন্দ অবস্থায় আছে? দুই রাজ্যে সরকার হাতছাড়া হয়েছে বটে, কিন্তু ভোটপ্রাপ্তির অনুপাত হিসাব কষা হলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উপসংহার নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। গত বছর মোট ন’টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হল। তার মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের চারটি রাজ্য বাদে বাকি পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে একটা মস্ত মিল আছে— প্রতিটি রাজ্যেই রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে যে দু’টি রাজ্যে কংগ্রেস জিতল, সেখানে তো বটেই, হেরে যাওয়া রাজস্থানেও কংগ্রেসের পক্ষে ভোটের অনুপাত গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এ দফায় বেড়েছে। ভোট কমেছে ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশে— কিন্তু, সেই কমার পরিমাণ এক শতাংশ-বিন্দুর চেয়েও কম, যথাক্রমে ০.৮১ ও ০.৪৯ শতাংশ-বিন্দু।

এটুকু পরিসংখ্যান থেকে অন্তত দু’টি কথা বলা যায়। এক, যে রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস এখনও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উপস্থিত, সেখানে কংগ্রেসের ‘কোর ভোটব্যাঙ্ক’ কম-বেশি অটুট রয়েছে। অর্থাৎ, কংগ্রেস সমর্থকরা দলের পাশ থেকে সরে গিয়েছেন, অন্তত এই রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে সে কথা বলার উপায় নেই। দুই, কর্নাটক বাদে বাকি চারটে রাজ্যেই বিজেপির পক্ষে ভোটের সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি হারে— শতাংশ-বিন্দুর হিসাবে ছত্তীসগঢ়ে ১৩.৩, মধ্যপ্রদেশে ৭.৫৩, তেলঙ্গানায় (জনসেনা পার্টির সঙ্গে জোটে) ৭.১৭ এবং রাজস্থানে ৩.৬১। কংগ্রেসের ভোট তেমন কমেনি, অথচ বিজেপির ভোট বিপুল পরিমাণে বেড়েছে, অর্থাৎ কংগ্রেস বাদে বাকি বিরোধী পরিসরটুকু বিজেপি দখল করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।

Advertisement

‘ইন্ডিয়া’ জোটের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, সেই আলোচনায় এই হিসাব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কয়েকটা কথা মনে রাখা ভাল। প্রথমত, বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন লোকসভায় ঘটবে, তেমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং, ২০১৯-এর অভিজ্ঞতা বলছে যে, লোকসভার ক্ষেত্রে ‘মোদী ফ্যাক্টর’ অনেক হিসাব উল্টে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের গুরুত্ব নেই, ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক দলের আধিপত্য রয়েছে, সেই রাজ্যগুলির অবস্থা স্বভাবতই এই হিসাব থেকে বোঝা মুশকিল। ২০২২-এর নির্বাচনে অবশ্য উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এবং পঞ্জাবে আম আদমি পার্টির ভোটপ্রাপ্তির হার বেড়েছিল তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে।

এই সব ত্রৈরাশিক-ভগ্নাংশের কথা মাথায় রাখলে ২০২৪-এ ‘ইন্ডিয়া’ জোট সম্বন্ধে কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, আসন বিভাজনের যে সূত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন— অর্থাৎ যে রাজ্যে যে দল প্রধান, তার নির্দেশ অনুসারেই রাজ্যে জোটের আসন বণ্টন করতে হবে— সেই সূত্রটিই মান্য। ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনের ভোটপ্রাপ্তির হিসাব বলছে, যে কোনও নির্বাচনই এখন বিজেপির পক্ষে-বিপক্ষে গণভোটে পরিণত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে, বিজেপি-বিরোধী পরিসরটি যত ভেঙে যাবে, সেই পরিসরে থাকা তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ দলের ভোট বিজেপির ঝুলিতে যাবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। সে সম্ভাবনার মূলোচ্ছেদ করতে গেলে বিরোধী পরিসরকে যত দূর সম্ভব ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। তবে, একই সঙ্গে মেনে নিতে হবে যে, ‘ইন্ডিয়া’-র সাফল্য-ব্যর্থতার কৃতিত্ব বা দায় কংগ্রেসের যতখানি, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর তার চেয়ে বেশি। নিজেদের রাজ্যে তারা কতখানি জমি ধরে রাখতে পারে, সেটা বড় প্রশ্ন হবে।

এই সূত্রটি মেনে নেওয়ার অর্থ, কংগ্রেসকে তার সর্বভারতীয় বড়দাসুলভ ভঙ্গিটি ছেড়ে দিয়ে মেনে নিতে হবে, দেশে গোটাদশেক রাজ্যে দলের তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে অস্তিত্ব আছে, বাকি দেশে সাইনবোর্ডটুকু সম্বল। যে রাজ্যগুলিতে দলের শক্তি আছে, এবং যেখানে দলের ভোটব্যাঙ্ক এখনও কম-বেশি অক্ষত, সেই রাজ্যগুলিতে মনোনিবেশ করা হাই কম্যান্ডের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বিকল্প হওয়ার কথা, কারণ সে ক্ষেত্রে সর্বশক্তি দিয়ে জোরের জায়গায় লড়াই করা যাবে— কিন্তু, তাতে নিঃসন্দেহে আপত্তি থাকবে তুলনায় শক্তিহীন রাজ্যগুলির প্রাদেশিক নেতাদের। সর্বভারতীয় স্তরে দলের ফলাফল কেমন হল, তার চেয়ে সেই নেতাদের কাছে স্বভাবতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, রাজ্য রাজনীতিতে তাঁদের কতটুকু প্রভাব থাকল। রাজ্যে শক্তির অনুপাতে আসন ভাগাভাগির সূত্রটি তাঁদের সেই হিসাবের সঙ্গে মেলে না। ফলে, প্রাদেশিক নেতাদের সর্বভারতীয় স্বার্থ মানতে রাজি করানোর কঠিন কাজটি রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গেকে করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে জোট নিয়ে সিপিএম-এর আপত্তিকেও এই মাপকাঠিতে দেখা উচিত।

তৃতীয় কথা হল, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই। ২০২২ সালে, রাহুল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু করার আগে, যে বিধানসভা নির্বাচনগুলি হয়েছিল, তার মধ্যে বড় রাজ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত ও পঞ্জাব। এই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট কমেছিল যথাক্রমে ৩.৯২, ১৪.১৬ এবং ১৫.৫২ শতাংশ-বিন্দু। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস অকিঞ্চিৎকর রাজনৈতিক শক্তি, পেয়েছিল মাত্র ২.৩৩ শতাংশ ভোট। কিন্তু বাকি দু’টি রাজ্যে কংগ্রেস অন্যতম প্রধান দল— পঞ্জাবে ক্ষমতায় ছিল ২০২২ অবধি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বহু দূর অবধি রাজ্য নেতৃত্বের চালচলনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু, ২০২২-এর ধসের সঙ্গে ২০২৩-এর অটুট ভোটব্যাঙ্কের তুলনা করলে যদি একটি কারণের কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়, তা সম্ভবত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-ই। তার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতে ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এ মাসের মাঝামাঝি যাত্রা আরম্ভ করার কথা বলেছেন রাহুল। এই কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিতেই হবে।

প্রশ্ন হল, শুধু কি কংগ্রেসই গুরুত্ব দেবে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র দ্বিতীয় পর্যায়কে? না কি, ‘ইন্ডিয়া’-র শরিক অন্যান্য দলও যোগ দেবে তাতে? যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই যদি আসন বণ্টনের হিসাব পাকা হয়ে যায়, তা হলে অনুমান করা চলে যে, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলের যাত্রার শরিক হতে দ্বিধা কমবে। এ দফার যাত্রাকে শুধু কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে না দেখে তাকে জোটের কর্মসূচি করে তোলা যায়। সহজ কথা হল, জোট তৈরি হওয়ার পর গত ছ’মাসে এমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি যা দেখে মনে হতে পারে যে, দলগুলো এক সঙ্গে লড়তে চায়। বরং উল্টো প্রবণতা দেখা গিয়েছে। শরদ পওয়ারের ‘আছি না আছি’ অবস্থান, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকট কংগ্রেস-বিরোধিতা, আম আদমি পার্টির রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, সিপিএমের শূন্য ভোটব্যাঙ্ক নিয়েও তুমুল নৈতিক উচ্চাবস্থান— কোনওটিই দেশের বিজেপি-বিরোধী নাগরিকদের আশ্বস্ত করার মতো নয়। দলগুলো যে একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়তে প্রস্তুত, এ বার সেই বার্তা দেওয়া দরকার।

২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে যদি ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সফল হতে হয়, তা হলে এই নির্বাচনকে দেখতে হবে সর্বভারতীয় যুদ্ধে রাজ্যওয়ারি লড়াই হিসাবে। কোন কোন প্রশ্নে লড়াই হবে, তা-ও বাছতে হবে এই সর্বভারতীয় ও রাজ্যওয়ারি দ্বৈত চরিত্রের কথা মাথায় রেখেই। তবে, গত কয়েক বছরে বিরোধী রাজনীতি বারে বারে যে ভুলটি করে এসেছে, তাকে এড়িয়ে যেতে হবে— নরম হিন্দুত্বের অস্ত্র দিয়ে যে বিজেপির সঙ্গে লড়া যায় না, তা মেনে নিতেই হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement