বড় দাবি, বড় স্লোগান, কিন্তু জি-২০ বৈঠকের চ্যালেঞ্জ বিরাট
G20 Meet

কমল এবং কণ্টক

প্রায় এক বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় জি-২০’র দায়িত্বভার নিয়ে মোদী প্রথম আমদানি করেছিলেন গণতন্ত্রের জননীবাদ।

Advertisement

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৩ ০৫:২৮
Share:

ভজনা: প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী, হায়দরাবাদ হাউস, দিল্লি, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪। —ফাইল চিত্র।

বিশ্বগুরু যোজনার চরম পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এক বছর ধরে গোটা দেশের শহর জেলা মহকুমা মুখ ঢেকে দিয়েছে যে মহাযজ্ঞের বিজ্ঞাপন, সেই জি-২০ জাগ্রত দ্বারে। নির্বাচনী মরসুমে যে আন্তর্জাতিক সিলমোহর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্য আশু প্রয়োজন, তা তাঁকে দিতে পারে ভারত মণ্ডপমের মঞ্চে সমাসীন বিশ্বের উনিশটি শক্তিশালী দেশের শীর্ষ নেতার প্রশংসাবাক্য। শুধু দেশকে নয়, গোটা বিশ্বকে যে তিনি বাতি দেখাচ্ছেন, সে কথা সাম্প্রতিক বাদল অধিবেশনের লোকসভার অনাস্থা প্রস্তাবে মোদী গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন। এ কথাও বলতে বাকি রাখেননি যে, এই অমৃতকালখণ্ডে যে কাজ হচ্ছে তার প্রভাব থাকবে আগামী এক হাজার বছর। লাল কেল্লা থেকেও বার বার তাঁর ‘পরিবারজনের’ জন্য সহস্র বছরের আশ্বাস ভাসিয়ে দিয়েছেন শেষ শ্রাবণের বাতাসে। তিনিই তো বার বার বলেন, ছোট করে কিছু ভাবে মুর্খেরা, তিনি ভাবেন ‘বড় করে’। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিছক কল্পনাহীনদের কারবার, তাঁর সুদূর প্রসারিত কর্ণকবচে রয়েছে তার দুশো গুণ বেশি কালের যাত্রার ধ্বনি।

Advertisement

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী নিজে বললেই তো শুধু হবে না। জি-২০ ভুক্ত মহামহিম দেশগুলিকে নত হয়ে দিল্লির প্রগতি ময়দানে এ কথা বলতে হবে। যৌথ ঘোষণাপত্রে, কাগজে-কলমে ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি যাতে পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা যুগে যুগে প্রমাণিত, ভোটের বাজারে বিশ্বসেরা ব্র্যান্ড খুবই ভাল চলে। যে কুঁড়ে যত প্রদীপহীন, যে কৃষক যত জমিহীন, যে বসতি যত কুসংস্কারের বশ, সেখানে ধর্মের আফিমের কাছাকাছি মাদকতা এনে দিতে পারে উল্টো ঔপনিবেশিকতার এই পুরাণ। এক সময় যাদের গোলামি করেছে এই দেশ, আজ তারা ভারতের আত্মনির্ভরতা দেখে সেলাম ঠুকছে। ভারতের পাঠানো টিকা আর ওষুধে প্রথম বিশ্ব জয় করছে অতিমারি। ভারতের যোগকে মোদীই নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। এই প্রচারের কোনও মার নেই।

প্রায় এক বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় জি-২০’র দায়িত্বভার নিয়ে মোদী প্রথম আমদানি করেছিলেন গণতন্ত্রের জননীবাদ। বলেছিলেন, ‘‘আমাদের অতিথিরা ভারতের বিস্ময়কর বৈচিত্র, সুবিশাল ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে চমৎকার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। আমরা আশা করব ভারতে এই অনন্য উদ্‌যাপনে আপনারা সকলে উপস্থিত থাকবেন।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি প্রথম বার ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে উল্লেখ করেন। এই সে দিনও স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাতে তাঁর জননীবাদের পুনরাবৃত্তি শুনল দেশ।

Advertisement

অর্থশাস্ত্র, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, মহাভারতের রাজধর্ম পর্যায়ের সংস্কৃত নথি ঘেঁটে যদি দেখা যায় প্রাচীন ভারতে শাসনের মূল ধারা রাজতন্ত্রই ছিল, গণতন্ত্র নয়, তখন তা নিয়ে তর্ক বিস্তার এখানে প্রয়োজনীয় নয়। জি-২০’র প্রাক্কালে যেটা বোঝা বেশি প্রয়োজনীয় সেটা হল, নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকেই সুকৌশলে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছেন মোদী বিশ্বমাঝে এবং ক্রমশ সেখান থেকে তৈরি করছেন বিশ্বগুরুর তত্ত্ব।

কিন্তু জি-২০’র আগে বিজেপি এবং সরকারতন্ত্র যতই অস্বাভাবিক শক্তিশালী আলোর তলায় দাঁড় করাতে চান তাঁদের অধিনায়ককে, বিশ্ববিচারে কিন্তু সেই গুরুবাদ দুর্বলই দেখাচ্ছে এখনও পর্যন্ত। সওয়া দু’বছর হতে চলল চিনের কাঁটা গলা থেকে বেরোচ্ছে না। সুতোর উপর ঝুলছে সম্পর্ক। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলন গতকাল থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে নরেন্দ্র মোদীর এতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা ছিল। অনীহার কারণ স্পষ্ট: শি জ়িনপিংয়ের উপস্থিতি। আবারও মুখোমুখি হওয়া, আবারও অস্বস্তি, আবারও বিপক্ষের মুখ খোলার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সবিশেষ অনুরোধের পর যখন সেখানে যোগ দেওয়া মনস্থ করলেন মোদী, প্রবল চেষ্টা হচ্ছে জি-২০’র আগে চিনের সঙ্গে সমঝোতায় আসার। কোনও একটি সূত্র তাঁর চাই, যাতে অন্তত এটা মনে হয় পূর্ব লাদাখের বাকি অঞ্চলগুলি থেকে লালফৌজ পত্রপাঠ পিছু হটেছে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট মরিয়া দেখাচ্ছে সাউথ ব্লককে। ব্রিকস-এ শি জ়িনপিং-এর সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকে বসতে পারেন মোদী। দু’দেশের সীমান্ত জট কাটাতে সামরিক স্তরের লাগাতার ১৮টি বৈঠক হয়েছিল সওয়া দু’বছরে। সম্প্রতি ঊনবিংশতম সংস্করণটি চলল টানা দু’দিন। বৈঠকশেষে যৌথ বিবৃতিতে যত দ্রুত সম্ভব ভারত-চিন সীমান্ত সঙ্কট মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, যা এর আগে কখনও হয়নি এ ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য, চাপ এবং তাড়া ভারতের দিক থেকেই প্রবল। জি-২০’র আগে চৈনিক পাজ়ল সমাধান না করতে পারলে, দেশের মাটিতে হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দোলনায় দুলেছিলেন মোদী, মামল্লপুরমের ইতিহাস এবং উহান ঝিলের নিসর্গ ভাগ করে নিয়েছিলেন। ২০১৪ থেকে ২০২০-র জুনের গালওয়ান সংঘর্ষ পর্যন্ত শি জ়িনপিং-এর সঙ্গে শুধু দু’বার ঘরোয়া বৈঠকই নয়, আরও আঠারো বার শীর্ষবৈঠক করেছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু গত আড়াই বছরে একটিও নয়!

এ বারের ব্রিকস-এ যদি বরফ না গলে, চিনের প্রেসিডেন্ট আদৌ সেপ্টেম্বরের জি-২০’তে আসবেন কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি করছে কূটনৈতিক মহলের একাংশ। সম্প্রতি এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে একমাত্র ভারতই শি-এর ওবর প্রকল্পের বিরোধিতা করেছে। দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিন্সের চিন বিরোধী আইনি অবস্থানকে সমর্থন করেছে। ব্রিকস-এ চিনপন্থী দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। জুন মাসে আমেরিকান কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী চিনের নাম না করে সম্প্রসারণবাদের নিন্দাও করেছেন। এতে মোদীর তাৎক্ষণিক গ্যালারি (আমেরিকান কংগ্রেস) উদ্দীপিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ড্রাগনের নিঃশ্বাস তো এ বার সামলাতেই হবে।

তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক জোহানেসবার্গ-এর ব্রিকস সম্মেলনে জোড়াতালি দিয়ে হলেও লাদাখ আগ্রাসন প্রশ্নে কিছু প্রলেপ লাগাতে পারলেন দুই নেতা। কিন্তু তার পরেও যে বিষয়টি থেকে যাচ্ছে, তার সমাধান ‘বিশ্বগুরু’র হাতেও নেই আসলে। গত এক বছরে জি-২০’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বৈঠক ছিল বিদেশমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের। দু’টিতেই জল ঢেলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যৌথ বিবৃতিতে পৌঁছনো যায়নি। নতুন চেহারায় ফিরে আসা ব্লক রাজনীতি আড়াআড়ি ভাবে চিরে রেখেছে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে। সেখানে জি-২০’র সুর বেঠোফেনের সিম্ফনির মতো বাজবে, এই আশা করাটাই বাতুলতা।

কিন্তু তিনি আলাদিন নন। ক্রেমলিন এখনও স্পষ্ট করে জানাতে পারছে না জি-২০’তে যোগ দিতে সশরীরে ভ্লাদিমির পুতিন দিল্লি আসবেন কি না। বিষয়টি দোলাচলে রয়েছে। ইউক্রেন হামলার পর যে পশ্চিম তাঁকে একঘরে করতে তৎপর, সেই তাদেরই শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তিনি এক টেবিলে বসতে চাইবেন কি? তিনি আসুন বা না আসুন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে ভাবে ভূকৌশলগত পরিস্থিতি কার্যত থমথমে হয়ে রয়েছে, তা ভারত মণ্ডপমের মঞ্চে প্রতিফলিত হবে। সে ক্ষেত্রে খাদ্য, জ্বালানি সারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে আবার পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বিশ্বের জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয়গুলিতে কুড়িটি দেশের একজোট হওয়া সম্ভব হবে কি? প্রধানমন্ত্রী যদিও বলেছেন ভূকৌশলগত ভাষা বদলাচ্ছে, গোটা বিশ্ব ভারতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সঙ্কটমোচনের জন্য। ‘এক বিশ্ব এক পরিবার এক ভবিষ্যৎ’-এর স্লোগানটিও তিনি জি-২০’র জন্য আগে থেকেই গেয়ে রেখেছেন, যা শুনতে অতীব মুখরোচক, কিন্তু হাস্যকর রকমের অবাস্তব। পাঠক, আপনি স্বপ্নেও ভাবতে পারছেন চিন রাশিয়া আমেরিকা জার্মানি জাপান এক সঙ্গে এই স্লোগানটি উচ্চারণ করছে বাধ্য বালকের মতো?

ফলে গোটা বিশ্বের চোখে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্ননীল যে বেলুনটি ওড়ানো হয়েছিল, জি-২০’র আসন্ন উত্তাপ তাকে ভেসে থাকতে দেবে কি না, তা নিয়ে ত্রাস রয়েছে খাস সাউথ ব্লকের অন্দরমহলেই। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি যখন একে অন্যের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার দেয়, তখন তাকে বালকের কলহ বলা যায় না। সেই আয়োজনের অতিথিকে তখন ‘যেন কিছুই হয়নি’ এমন হাসিমুখ করে থাকতে হয় ঠিকই, কিন্তু মনে মনে সে প্রমাদ গোনে।

ফলে কমল ফুটুক না ফুটুক, জি-২০’র আগে বিবিধ আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে বর্তমান সরকারের স্বঘোষিত বিশ্বগুরু যোজনা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement