Kashmir

আপেল বাগিচায় সেনাশিবির

কিছু দিন সাংবাদিকতার সুবাদে জানা আছে, শীত পড়ার ঠিক আগে সন্ত্রাসবাদীরা একটা মরিয়া চেষ্টা করে আক্রমণের। এক বার শীত এসে গেলে তুষারের তলায় ডুবে যায় বড় বড় গাছ।

Advertisement

অরূপ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:১১
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীরা গুলি করে মেরেছে এক পরিযায়ী শ্রমিককে। মুকেশ কুমার উত্তরপ্রদেশের ভাটপুরা থেকে কাজ করতে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে, গুলিতে প্রাণ দিলেন। এই হত্যার এক দিন আগে এক সন্ত্রাসীর গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন পুলিশকর্মী মাসরুর আহমেদ ওয়ানি। বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিলেন, সেই অবস্থায় গুলি লাগে তাঁর।

Advertisement

কিছু দিন সাংবাদিকতার সুবাদে জানা আছে, শীত পড়ার ঠিক আগে সন্ত্রাসবাদীরা একটা মরিয়া চেষ্টা করে আক্রমণের। এক বার শীত এসে গেলে তুষারের তলায় ডুবে যায় বড় বড় গাছ। সীমান্তের ও-পারে অস্ত্র, যোদ্ধা পাঠানো তখন অসম্ভব।

তবে শীত পড়ুক আর না পড়ুক, কাশ্মীরের উপরে সব সময়ে যেন এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে এখন। শ্রীনগরে শিকারায় নৌ-ভ্রমণে বা গুলমার্গে গন্ডোলা-বিহারে, এই জমাট শীতলতার বোধ কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। অথচ, প্রতি দিনই আগের দিনের থেকে বেশি সুন্দর, প্রতি মুহূর্ত আগের মুহূর্তের থেকে জাদুময়, রহস্যাবৃত। ডাল লেকের উপর সন্ধ্যা নেমে আসে, চিনার গাছের সারির ও-পার থেকে ভেসে-আসা আজানের সুরে। পহেলগাঁও যাওয়ার পথে অজস্র আপেল বাগিচা, চোখ যেন গুনে শেষ করতে পারে না। হাতের মুঠোয় তুষার ধরা, যা বাঙালির কাছে প্রায় অলৌকিক এক অনুভূতি। চোখের সামনে বৃষ্টিপাত হয়ে যায় তুষারপাত, আস্তে আস্তে সাদা চাদর বিছিয়ে দেয় গোটা উপত্যকায়। সঙ্গীহীন টাট্টু ঘোড়া কাদা-বরফ ঠেলে হেঁটে যায় বাড়ি। সারা দিগন্ত অধিকার করে দাঁড়িয়ে থাকে পিরপঞ্জল পর্বতশ্রেণি। কলকল করে বয়ে চলে পাহাড়ি নদী। কাশ্মীরের প্রকৃতি ইন্দ্রিয়কে অবশ করে, সত্তায় জাগে সুন্দরের বেদনা।

Advertisement

এই জন্যেই আরও বেশি করে আহত লাগে কাঁটাতার দেখে। আর মনে হয়, কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত যে টানাপড়েন চলছে— কাশ্মীর আসলে যা, আর কাশ্মীর যা হওয়ার ভান করে চলেছে— তা সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আসল কথাটা এই যে, কাশ্মীর এক এমন রাজ্য (সরকারি পরিভাষায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল), যা গৃহবন্দি, বা ‘হাউস অ্যারেস্ট’-এ রয়েছে। মনে হয় যেন আমরা বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি, এক দল কারাবন্দি কেমন করে তাদের প্রতি দিনের নির্দিষ্ট কাজগুলি করে চলেছে। ভয়ঙ্কর এক দমনের নীচে যাঁরা বেঁচে, সেই কাশ্মীরিরাই নিরন্তর হাসিমুখে, অতি অমায়িক ব্যবহার করে চলেছেন পর্যটকদের সঙ্গে। কতটা মানসিক জোর লাগে এর জন্য, তা অকল্পনীয়।

কাশ্মীরে লেক আছে, কাঁটাতারও আছে। আপেল বাগিচা আছে, তার পাশেই রয়েছে সেনা শিবির। উপত্যকার রাস্তা যেন ছবি, তাতে কয়েক কিলোমিটার অন্তর চেকপোস্ট। আর সর্বত্র মোতায়েন সৈন্যরা, বন্দুক হাতে নিয়ে। ধু ধু মাঠের মাঝখানে শূন্যের দিকে চেয়ে রয়েছে সৈন্যরা। ওরা হয়তো ভাবছে, কী করছে ওরা এখানে দাঁড়িয়ে, কী করে কাটাবে অসহ্য শীত। যখন নিজেরই নাগরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে একটা দেশ, তখন এমনই হয়। সকলেই হারে, জেতে শুধু বন্দুক বিক্রেতা, আর যে বিক্রি থেকে কমিশন পায়।

ডাল লেকে শিকারার চালককে প্রশ্ন করলাম, লেকের জলে এত প্লাস্টিকের বোতল কেন? তিনি বললেন পশ্চিম ভারতের এক রাজ্য থেকে আগত এক পর্যটকের কথা। তাঁকে যখন শিকারা-চালক প্রশ্ন করেছিলেন কেন তিনি একের পর এক প্লাস্টিকের বোতল লেকের জল ছুড়ে ফেলছেন, তিনি সগর্বে উত্তর দিয়েছিলেন, “কারণ এটা আমার দেশ।”

ছোটখাটো উপহার কেনার সময়ে দোকানের মালিককে দামে কিছু ছাড়ের জন্য অনুরোধ করলে তিনি এক কথায় ‘না’ বলে দিলেন। বলেছিলাম, আপনি তো দরদস্তুরের সব দরজাই বন্ধ করে দিলেন। তাঁর উত্তরটা এখনও মনে আছে— “দরদস্তুর করতে হলে দু’জনেরই জেতার সুযোগ থাকতে হবে। আমি সব সময়েই হারব, আপনি সব সময়েই জিতবেন, এমন হলে হবে না।”

কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্য যেন তার ট্র্যাজেডিকে আরও অসহনীয় করে তোলে।

কাশ্মীর থেকে ফেরার পর কিছু দিন কেটেছে। আখরোট প্রায় শেষ, সব উপহার বিলি হয়ে গিয়েছে। কাগজের মণ্ডে তৈরি একটা ছোট শিকারা কাচের আলমারিতে জায়গা পেয়েছে অতীতের নানা ভ্রমণের স্মারকের পাশে। আমাদের জামা থেকে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ প্রায় মুছে গিয়েছে। কিন্তু মাথা থেকে এখনও বেরোয়নি সেই সব কাঁটাতারের ছবি। জমির উপর, আর মানুষের মনের উপর, খোদাই করা বিভেদরেখা— এ কি সহজে মুছে যাওয়ার?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement