দুরন্ত গতি ও ব্যাপ্তি ডিজিটাল বিবর্তনের। ফাইল চিত্র।
মাত্র একটা দশকের ব্যবধান, তাতেই দুরন্ত গতি ও ব্যাপ্তি ডিজিটাল বিবর্তনের। মোবাইল-ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তার জন্মমুহূর্তে কে ভেবেছিল, এর মধ্যেই কত যন্ত্রকে ঠেলে সরিয়ে অভূতপূর্ব আধিপত্য জাহির করবে ছোট্ট এই স্ক্রিন! ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া মেটানো থেকে খাজনা জমা, বিয়ের সম্বন্ধ থেকে ডেকরেটরের সন্ধান, ঋণের আবেদন থেকে শোধের ফাঁকফোকর— আরও কত কী কেন্দ্রীভূত হবে এই যন্ত্রে! ব্যক্তির কাজকর্ম, অভিব্যক্তি, প্রত্যাশা, অভিযোগ, সব কিছুর ধারাবিবরণী পাচ্ছি ডিজিটাল মধ্যস্থতায়। দৃশ্য, শব্দ, অক্ষরের মাধ্যমে অক্লান্ত আপডেটে আমরা আজ এতই অভ্যস্ত যে, মোবাইল ও ইন্টারনেটহীন জীবন কল্পনা করতে পারি না।
পৃথিবীর এ প্রান্তের কেউ অন্য প্রান্তের মানুষের সরাসরি সম্প্রসারণ দেখতে পারবে, এমনটা ছিল সাধারণের স্বপ্নাতীত। সে রকম সংযোগ-ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব ছিল না। আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় তথ্য, দৃশ্য, মন্তব্যের অবিরত নির্মাণ, বিনিময় ও প্রচার চলছে, আবার সব নিমেষে মুছেও যাচ্ছে— এ ছিল কল্পনারও বাইরে। গতিময় এই বিবর্তনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র স্বতশ্চলীকরণ। তার ব্যবহারও এখন সহজ, সুলভ। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও প্যানোরামা তুলতে গেলে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে আলাদা আলাদা ছবি তুলতে হত, সমান্তরাল বজায় রেখে। পরে প্রযুক্তিতে ফেলে, অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাদের জুড়তে হত। তা ছিল সময়সাপেক্ষ। আজ মোবাইল ক্যামেরার এক ছোঁয়াতেই এ জিনিস সম্ভব, ফলাফলও তৎক্ষণাৎ। যে ছবি তোলার জন্য হরেক যন্ত্রপাতি ও লেন্সের বোঝা বইতে হত, আজ তা সমবেত ও সঙ্কুচিত হয়ে সেঁধিয়েছে মোবাইলের মধ্যেই।
মাত্র দু’-তিন দশক আগেও সিনেমা সংরক্ষিত হত প্রমাণ আয়তনের কৌটো বা ক্যান-এ। ক্যানপিছু কুড়ি হাজার ফিট রিল, সিনেমা-প্রতি ছয় থেকে আট ক্যান। এ বার তাকে গুণ করুন ক’টা প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখানো হচ্ছে সেই সংখ্যা দিয়ে। সেই হিসাবে, শাহরুখ খানের জনপ্রিয় ছবিগুলির যত প্রিন্ট হয়েছে, তা সংরক্ষণ করতে গেলে নায়কের বিশাল বাড়ি উপচে পড়ার কথা। আশির দশকে ভিসিআর এসে সিনেমার ক্যানকে এনে ফেলল একটা দু’শো পাতার বইয়ের আয়তনে। নব্বই দশকের শেষ দিকে ভিসিডি/ডিভিডি আসাতে একটা চলচ্চিত্রের দৈহিক আয়তন এমন হল, তাকে প্রায় পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়। তারও এক দশকের মধ্যে শীর্ণকায়তার মানদণ্ড এক লাফে পৌঁছল অন্য স্তরে। পছন্দের কয়েকশো ছবি সহজেই ঢুকে গেল একশো গ্রাম ওজনের, ইঞ্চি ছয়েকের এক্সটার্নাল হার্ড-ডিস্কে। গুচ্ছ-গুচ্ছ ক্যাসেট, বই, ডিভিডি কিনে তাক ভরানোর দিন ফুরোল।
পরের এক দশকে তারও আর প্রয়োজন রইল না। বাজারে এল অদৃশ্য স্পেস বা ‘ড্রাইভ’, যা শরীরের, বাড়ির বা ব্যাগের নামমাত্র জায়গা নিয়ে যাবতীয় ‘ডেটা’ সংরক্ষণ করছে। ইন্টারনেট-মারফত সেই ডেটা কাজে লাগানো যাচ্ছে, চাইলেই লিঙ্ক পাঠিয়ে শেয়ার করা যাচ্ছে কাজ বা বিনোদনের উপকরণ। কয়েক বছর আগেও পেনড্রাইভে পছন্দের শিল্পীর গান পুরে ঘুরে বেড়িয়েছি, আজ সেই ক্ষুদ্রকায় বস্তুটিও সেকেলে। কোটি কোটি কনটেন্ট সবই উপরে কোথাও একটা আছে, শুধু অ্যাপ খুলে বা লিঙ্ক খুঁজে তাকে ছুঁতে যতটুকু সময় বা ইন্টারনেট প্রয়োজন। হাত থেকে পড়ে ভাঙার ভয় নেই, জলে ভেজার চিন্তা নেই। মানুষের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু তার তৈরি বা রক্ষিত ডেটা অমর।
দৃশ্য, শব্দ, অক্ষর, লিঙ্ক— মোবাইলে যুক্ত হওয়ার দরুন প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে এমন বিস্ময়কর প্রযুক্তিগত বিবর্তন, তা শুধু আমরা প্রত্যক্ষই করিনি, তাতে শামিল হয়েছি পুরোদমে। গান, চলচ্চিত্র, নিজের তোলা ছবি, পারিবারিক ছবি বা ভিডিয়ো, স্বরচিত লেখা, হাজার হাজার ই-বই আমরা ডিজিটালি ভোগ ও উপভোগ করছি, ভাগ করে নিচ্ছি, জমাচ্ছি। অদৃশ্য এই সংগ্রহশালায় জমা করার জায়গার অভাব নেই। তা ওজনশূন্য, আয়তনশূন্য, অথচ অস্তিত্ববান, সুরক্ষিত।
এই পাওয়া, বা এত বেশি করে পাওয়ার পুরোটাই তাৎক্ষণিক। অপেক্ষার অবসান হয়েছে, প্রবেশাধিকার এখন লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি-দেশ নির্বিশেষে উন্মুক্ত। সকলেই সর্ব ক্ষণ সংযুক্ত, এই সংযুক্ত অবস্থাতেই মানুষ সব সময় তার পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্বে ব্যস্ত, মেতে আছে আপডেট আর আপলোড-এর খেলায়। নতুনের ধাক্কায় দ্রুত আড়ালে চলে যাচ্ছে আগের দৃশ্য, শব্দ, বাক্য, বিজ্ঞপ্তি। ‘টাইমলাইন’-এ প্রচুর স্মৃতি গচ্ছিত হলেও, ফিরে দেখারও যেন সময় নেই। যদিও কারণে অকারণে, নিজের অজানতেই হাত-চোখ-মন চলে যাচ্ছে মোবাইল-পানে।