উত্তরহীন প্রশ্নের পৃথিবীতে উত্তরের আশা করে না কেউ।
১৮১৯ সালের ১৪ মে একটি চিঠিতে জন কিটস লিখেছিলেন, “দো আ কোয়ারল ইন দ্য স্ট্রিটস ইজ় আ থিং টু বি হেটেড, দি এনার্জিস ডিসপ্লেড ইন ইট আর ফাইন, দ্য কমনেস্ট ম্যান শোজ় আ গ্রেস ইন হিজ় কোয়ারল।”
একেবারে সাধারণ মানুষ যে ঝগড়ার ভিতরেও মাধুর্যের প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম, এমন আমরা হামেশাই দেখি। ফুটপাতে বসা এক আনাজ বিক্রেতা দম্পতির প্রবল কলহের ভিতরে গিয়ে পড়ে পিঠটান দেওয়ার সময় এক খরিদ্দার তাই শুনতে পান, “এ আমাদের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আর পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ঝগড়া। আপনি গ্রাহক, আপনি চলে যাবেন কেন?” কিন্তু রিমোটের কৃপায় টিভির এই চ্যানেল থেকে ওই চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়, পুরনো দিন না-ই বা ফিরল, পুরনো লাবণ্যও কি ফিরবে না কোনও দিন?
বিনয় ঘোষের বাংলার বিদ্বৎসমাজ বইতে দেখি যে, বিদ্যাসাগরকে এক জন প্রশ্ন করছেন, “যে ছেলেটি সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে সেও যা লেখে, যে এন্ট্র্যান্স পাশ করে সেও তাই লেখে, যারা বিএ এমএ পাশ করে তারাও তাই লেখে। কেন এমন হয় বলতে পারেন?” বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন, “আমাদের যে সব ছেলে আছে তাদের কাছ থেকে আমরা মাইনে নিই, পাঙ্খা-ফি নিই, পরীক্ষার ফি নিই। সব রকমের ফি নিয়ে… কলের ভিতরে ফেলে দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দিই। কল ঘুরতে থাকে, আর তার কোনও মুখ দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস, কোনও মুখ দিয়ে এলএ, বিএ, এমএ বেরোতে থাকে। কিন্তু টেস্ট করে দেখ সকলেরই এক রকম তার। এক পাকের তৈরি কিনা!”
বঙ্গীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো (সর্বভারতীয় চ্যানেলও আলাদা কিছু নয়) দেখলে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কথার যাথার্থ্য প্রমাণ হয় বটে। অভিনেতা থেকে অভিযাত্রী, ফুলেশ্বরী থেকে ফাটাকেষ্ট, একই লাভাস্রোত বইতে থাকে সকল মুখ থেকে। স্রোত, না কি সুনামি? যে সুনামির একমাত্র প্রতিপাদ্য— কবি শঙ্খ ঘোষের পঙ্ক্তিই আবার বলতে ইচ্ছে করে, ‘…অন্য সবাই দুষ্ট বটে/ নিজে তো কেউ দুষ্ট না!’
এ বার কথা হল, প্রতিটি চ্যানেলই বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর নির্ভরশীল, আর বিজ্ঞাপনদাতা মানেই ছোট-বড় কর্পোরেট। অতএব, একটি মাঠ বেআইনি ভাবে দখল হয়ে গেলে সেটা নিয়ে খবর হবে, বস্তিতে আগুন লাগলেও সম্প্রচার হবে। কিন্তু পূর্বতন খেলার মাঠে কর্পোরেটের শপিং মল যখন স্থাপিত হয়ে যাবে, কিংবা সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক নেতা এবং স্থানীয় মস্তানের ত্রিবেণীসঙ্গমে যখন অন্য কোনও কর্পোরেটের বিশ-বাইশতলা অ্যাপার্টমেন্ট উঠবে ওই পুড়ে যাওয়া বস্তিতে, তখন অনন্ত নীরবতা নেমে আসবে চরাচরে। আর তার পরও ওরা খারাপ হতেই পারে, কিন্তু আমরা ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’— এই অস্ত্রের ঝনঝনানি চলতেই থাকবে।
মানুষ খারাপ হতেই পারে, কিন্তু ‘দল’ কখনও খারাপ হতে পারে না— এই তত্ত্বের গা-জোয়ারিতে প্রতিনিয়ত যেন এক লজ্জা এক্সপ্রেস ছুটতে শুরু করে স্টুডিয়ো থেকে স্টুডিয়োয়, আর সেই স্টুডিয়ো বিস্তার লাভ করে স্কুল-কলেজের টিচার্স-রুমে, অফিসের ক্যান্টিনে, ক্লাবের চাতালে, রেশন দোকানের লাইনে, ফ্ল্যাটের বসার ঘরেও। ছোট থেকে বাচ্চারা এই দেখতে দেখতে বড় হয় যে, ‘নাম কী?’ জিজ্ঞেস করলেও নাম বলে দিতে নেই, বরং বলতে হয়, “ওকে জিজ্ঞেস করেছ যে আমায় করছ?”
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের সম্পত্তি কেন এত গুণ বাড়ল, তার উত্তর এটা নয় যে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে কী ভাবে কয়েকশো কোটির মালিক হলেন। রাজ্যের সদ্য-প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের বাড়িতে কেন কোটি-কোটি টাকা; কেন তাঁর সঙ্গে নৈকট্যকে হাতিয়ার করে ইন্টারভিউ থেকে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার করা হল; দেশের তো বটেই, বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পিএইচ ডি করিয়ে দেওয়ার নামে লুট করা হল কেন— তার উত্তর এই সর্ষের ভিতরেই খুঁজতে হবে, ভূত দেখলে চলবে না। আগের আমলে কে কার ঘরের বাইরে পাতা টুলে বসে থাকতেন, তার ভিতরে এই জ্বলন্ত সমস্যার উত্তর নেই। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনোত্তর হিংসায় গৌরব, অভিজিতের মতো অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছে বলেই হাই কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে— লখিমপুরে গাড়ি চাপা দিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলেছে যে অকালকুষ্মাণ্ড মন্ত্রী-পুত্র, তার উদাহরণ দিয়ে বাংলার খুনিরা রেহাই পাবে কী করে? আবার এখানকার ভোটপরবর্তী হিংসায় অনেক ধর্ষণের ঘটনার এফআইআর হয়নি, বুক ফুলিয়ে ঘুরছে অপরাধীরা, সেই যুক্তিতে গুজরাতে বিলকিস বানো মামলায় কয়েক বছর মেয়াদ খাটা খুনি ধর্ষকদের নিষ্কৃতি পাওয়াকে মিষ্টি খেয়ে ও খাইয়ে উদ্যাপন করার সীমাহীন নির্লজ্জতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়? পশ্চিমবঙ্গে কোনও শিক্ষিকার অন্যায় বদলি নিয়ে স্টুডিয়োতে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেওয়া ব্যক্তি রাজস্থানে শিক্ষিকাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চুপ করে থাকতে বাধ্য কেন ?
ক্যামেরা যখন বন্ধ থাকে, তখন পরস্পরবিরোধী দলের প্রতিনিধিদের মধ্যেকার সৌহার্দ দেখার সুযোগ যাঁদের হয়েছে, তাঁরা অবশ্যই বুঝতে পারেন যে, ‘হুইপ’ মেনে ঝগড়া করাটাও একটা ক্লান্তির ব্যাপার। কিন্তু দলের বাইরেও আছে দল। সেখানে দুই দলে থাকা দুই উচ্চশিক্ষিত ভাই একই ভাবে ‘সিক্স পাশ’, ‘এইট পাশ’ বলে গালি দেন লোককে। যিনি সিক্স পাশ, তাঁকে তো তাঁর জীবন ভাষার অধিকার দেয়নি— কিন্তু যিনি নামের আগে ‘ডক্টর’ লিখতে পারেন, যাবতীয় সিক্স-পাশকে মাধ্যমিক অবধি পড়ানো কি তাঁরও দায়িত্ব নয়?
জবাব না মিললেও এলিটের জবরদস্তি ঝলসে ওঠে হামেশাই। একটি বিতর্কসভার পর দলনির্বিশেষে কয়েক জন নেতাকে আলোচনা করতে শোনা গিয়েছিল, জনৈক নেতার মা তাঁদেরই কার বাড়িতে কবে বাসন মাজতেন, তাই নিয়ে। সুকান্ত থাকলে হয়তো বলতেন, “আমার মা তোমার বাড়ি বাসন মাজে, সে কি কেবল আমারই অপমান?” কিংবা কে জানে কিছু বলতেন কি না, যখন দেখতেন যে, আমেরিকার পানীয় যেমন ভারতের গ্রামেও চলে আসে, তেমন ভাবেই নেতারা চলে যাচ্ছেন রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে অনশনকারী চাকরিপ্রার্থীদের মঞ্চে, কিন্তু অনশনরত প্রার্থীরা কেউ নেতাদের বাড়ি যেতে পারছেন না।
এখানেই বিভিন্ন দলের মধ্যেকার ফারাক গুলিয়ে যায়, কারণ সব বিতর্কের শেষে গাড়ি চড়ে আসা লোকেদের থেকে আলাদা হয়ে যায় গাড়ি না চড়ে আসা লোক। ডানপন্থী অভিনেতা বা উকিলের চকমিলানো বাড়িতে যেমন তাঁর দলের পুরুলিয়া বা নদিয়া থেকে আসা কোনও টোটোচালক কর্মী এক গেলাস জল খেতে যেতে পারেন না, বামপন্থী অভিনেতা বা উকিলের চোখ-ধাঁধানো বাড়িতেও তাঁর দলের কোনও দিনমজুর কর্মী বাথরুম করতে ঢুকতে পারেন না। যেখানে যে কোনও দলের সমর্থকদের (নেতাদের কথা বাদ দিলাম) মধ্যে দেখাসাক্ষাতের মঞ্চ হল রাস্তা, ধনী সমর্থকের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসার অধিকার নেই দরিদ্র সমর্থকের, সেখানে ‘ওরা’ এই দল আর ‘তারা’ সেই দল বলে দাগিয়ে দেওয়া হাস্যকর নয়? টিভির পর্দায় কেবল কাজিয়াই নয়, চমকপ্রদ অনেক জিনিসও দেখায়। একটি ক্যাথিড্রালের সোভিয়েট আমলে মিউজ়িয়াম হয়ে যাওয়া আর সোভিয়েট ভেঙে যাওয়ার পর আবারও ক্যাথিড্রাল হয়ে যাওয়ার ভিতরে লুকিয়ে ছিল এক অভাবনীয় তথ্য— রূপান্তরের আগে মিউজ়িয়ামের ট্রাস্টি বোর্ডে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ক্যাথিড্রালের ট্রাস্টিও হয়েছিলেন পরে!
কিটস যা-ই লিখে থাকুন চিঠিতে, রাজনীতি আর ভুলভুলাইয়া যখন সমার্থকপ্রায়, তখন ঝগড়ার কদর্যতা যে রকম বানানো, ঝগড়ার লাবণ্যও তাই। মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেলে, মুখোশের দরকার কী? যে ছাত্র-প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ছে, সে জানেও না যে, তারই কোনও নেতা নিজের সন্তানের জন্য সেই প্রশ্ন কিনে নিয়েছেন কি না ডিসকাউন্টে।
অঙ্কিতার জায়গায় ববিতা চাকরি পেয়েছেন, ন্যায়বিচার হয়েছে অন্তত একটি ক্ষেত্রে, সবাই বলাবলি করছেন। কিন্তু অঙ্কিতার যে ছাত্রীরা, তারা কি বি এস ম্যাডাম আসার আগে এ এ ম্যাডামের ক্লাস করত? তাদের মধ্যে এক জনেরও যদি অঙ্কিতার পড়ানো ভাল লেগে গিয়ে থাকে? কী করবে সে? কাকে গিয়ে বলবে? কাউকে না বলে বুকে চেপে রাখবে? ভাল লাগার কারণে অপরাধবোধে ভুগবে?
উত্তরহীন প্রশ্নের পৃথিবীতে উত্তরের আশা করে না কেউ। তাই আবারও একটি প্রশ্নই উঠে আসে, এত অল্প বয়সে ‘শিক্ষক’ শব্দের মানে এত যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে জানল যে, এই অন্তর্হিত সুষমার পৃথিবীতে, সে কি আর বড় হয়ে শিক্ষকদের ‘দলে’ ফেলতে চাইবে নিজেকে?