শিক্ষক দিবস অতীত, বিদ্যাসাগরের জন্মদিনও তথা এব চ
Education system

নিজের জোরে চলার শিক্ষা

এ রাজ্যে এখনও ৮০ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে। অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনুপাতটা যথেষ্ট বেশি। এর নানা কারণ থাকতে পারে।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:৫১
Share:

আপনজন: যাঁরা পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছেন, তাঁদের সম্মান জানাতে সমবেত শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীরা। বাগনান, হাওড়া। ১০ সেপ্টেম্বর —নিজস্ব চিত্র।

এ বছরের মতো শিক্ষক দিবস এসেছে এবং চলে গিয়েছে। স্কুলকলেজে এবং অন্যত্র নানা অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা, সমাজমাধ্যমে শিক্ষক-বন্দনা, অধুনা প্রচলিত রাধাকৃষ্ণন-লীলার চর্বিতচর্বণ, সবই এত দিনে অতীত এবং বিস্মৃত। বিস্মরণ সচরাচর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। কিন্তু সমুদ্রমন্থনে যেমন অমৃতভান্ডটি, অনেক কথা ও ছবির ভিড়ে তেমনই আজও, এই আকালেও, দু’একখানি অবিস্মরণীয়ের সন্ধান মেলে। সে-রকমই একটি মনে-রাখার-মতো সংবাদ প্রতিবেদন গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল দ্য টেলিগ্রাফ-এ। তার আগের দিন হাওড়া জেলার বাগনান এলাকায় কিছু ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষকশিক্ষিকাদের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তারা বিভিন্ন সরকারি স্কুলে পড়ে। তবে ওই শিক্ষকরা স্কুলে পড়ান না, তাঁরা একটি স্থানীয় শিক্ষাকেন্দ্রে আসেন, ওরা সেখানে তাঁদের কাছে পড়া বুঝে নেয়, তার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সুখদুঃখের কথা বলে। দুঃখের কথাই হয়তো বেশি। সে-কথা ওই শিক্ষকরা খুব ভাল বুঝতে পারেন, কারণ তাঁদের জীবনও দুঃখেই গড়া। মাত্র কয়েক বছর আগে তাঁরা স্কুলের পড়া শেষ করেছেন কঠিন অবস্থার মধ্যে, অনেকেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে। বেশির ভাগই নিজেরাও এখনও কলেজের পড়াশোনা করছেন। সে-সব সামলে তাঁরা এলাকার ভাইবোনদের পড়ানোর কাজে মন দিয়েছেন, নিয়মিত অনেকটা সময়ও দিচ্ছেন, কারণ তাঁরা মনে করেন এটা তাঁদের একটা দায়িত্ব। এই শিক্ষাকেন্দ্রের যিনি প্রধান উদ্যোগী, তাঁর বক্তব্য: যারা এখানে লেখাপড়ায় সাহায্য পাচ্ছে, তারা যদি পরে আবার এখানে এসে ছোটদের হাত ধরে, তাদের পাশে দাঁড়ায়, তা হলে ‘এই শিক্ষাকেন্দ্র নিজের জোরেই চলবে।’ নিজের জোরে চলাটা খুব জরুরি, কারণ পাশে দাঁড়ানোর এই উদ্যোগ— এই ধরনের অনেক অনেক উদ্যোগ— এখন পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এমন সাহায্য না পেলে তাদের একটা বড় অংশের লেখাপড়ায় প্রচণ্ড রকমের ক্ষতি হবে।

Advertisement

ক্ষতি তো অনেক দিন ধরেই হয়ে চলেছে, তবে অতিমারির কাল থেকে তার মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়েছে। রাজ্য জুড়ে এমন বহু ছেলেমেয়ের খোঁজ মিলছে, যাদের নাম স্কুলের খাতায় লেখা থাকে, কিন্তু তারা নিয়মিত স্কুলে যায় না, অনেকে কার্যত যায়ই না। যারা যায়, তাদের অনেকেই কিচ্ছু শেখে না— ক্লাস সেভেনে পড়ছে কিন্তু ক্লাস ওয়ানের বই পড়তে শেখেনি, যোগবিয়োগ করতে পারে না, এমন ছাত্রছাত্রী এ-রাজ্যে বিস্তর। এ-সবই আমাদের জানা, কিন্তু জানা বলেই, বহুচর্চিত বলেই, দ্বিগুণ ভয়ানক। চরম সর্বনাশের তথ্য-পরিসংখ্যানও যখন সমাজের চোখে বাসি খবর হয়ে যায়, সংবাদপত্রের পাঠক হাই তুলে পাতা উল্টে যত রাজ্যের দাদাদিদিদের কয়েক সহস্র রজনী অতিক্রান্ত বস্তাপচা কুনাট্যরঙ্গে মনোনিবেশ করেন, তার চেয়ে বেশি ভয়ানক আর কী হতে পারে? আর ঠিক সেই কারণেই, স্কুলশিক্ষার হালভাঙা পালছেঁড়া অনির্দেশ যাত্রাপথে কিছু কিছু এলাকায় সামাজিক উদ্যোগের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নজিরগুলি মহামূল্যবান। এই সব উদ্যোগ এবং তাদের পিছনে থাকা সহনাগরিকদের পরিশ্রমী শুভেচ্ছা কেবল ভরসাই দেয় না, এমন আরও বহু উদ্যোগের প্রত্যাশা তৈরি করে। প্রত্যাশা চরিতার্থ হলে এখনও খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনা যদি এখনও অপূর্ণ থেকে যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ ঘনতমসাবৃত খাদের অতলে তলিয়ে যেতে চলেছে। কথাটা ভয়-দেখানো অত্যুক্তি নয়, ভয়ঙ্কর সত্য।

যাঁরা সরকার চালান তাঁরা নিজেদের ন্যূনতম কর্তব্যগুলি সম্পাদন করতে চাইলে সত্যের মূর্তি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কারণ ছিল না। শিক্ষা, বিশেষত স্কুল স্তরের শিক্ষা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দেশের আইন-আদালতের বিচারেও সে-কথা স্বীকৃত হয়েছে অনেক কাল আগে। স্কুলবাড়ি তৈরি করে দিলে আর স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়ে রাখলেই সেই দায়িত্ব পালিত হয় না, শিশুদের লেখাপড়াটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। অনেক রাজ্যেই বহু সরকারি স্কুলে এ ব্যাপারে বিরাট ঘাটতি। কার সঙ্গে তুলনা করলে পশ্চিমবঙ্গের হাল একটু ভাল দেখায়, সেই অসার আত্মপ্রশস্তির উপকরণ সংগ্রহে ব্যস্ত না থেকে শিক্ষা দফতরের কর্তারা সমস্ত সরকারি স্কুলের হাল ফেরানোর জন্য একটা সত্যিকারের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লে আজ আমরা অন্য ছবি দেখতাম।

Advertisement

এ-কথা বলার একটি বিশেষ হেতু আছে। এ রাজ্যে এখনও ৮০ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে। অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনুপাতটা যথেষ্ট বেশি। এর নানা কারণ থাকতে পারে। অনেক অভিভাবক চাইলেও হয়তো সামর্থ্যের অভাবে সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে পারেন না, আবার বেসরকারি স্কুল মানেই ভাল— খামোকা এমনটা ধরে না নিয়ে অনেকে হয়তো নিজের সঙ্গতিটুকু গৃহশিক্ষক বা টিউটোরিয়ালের পিছনে খরচ করছেন। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, অধিকাংশ ছেলেমেয়ে যে এখনও সরকারি স্কুলে পড়ছে, সেটা অবশ্যই একটা বিরাট সুযোগ। হাল ফেরানোর সুযোগ। বস্তুত, সরকারি স্কুলের হাল ফিরলে সেখানে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত আরও বেশি হত এবং অপটু বেসরকারি স্কুলগুলিও নিজেদের গুণমান উন্নত করতে বাধ্য হত। সুতরাং, সদিচ্ছা থাকলে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্তারা গোটা স্কুলশিক্ষার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। এখনও পারেন।

কিন্তু তেমন সদিচ্ছার কোনও লক্ষণ আমরা দেখিনি, দেখছি না। অতিমারির আগেও দেখিনি, তার পরেও শিক্ষার ব্যাপারে অবিচল ঔদাসীন্যের ঐতিহ্যই বহাল থেকেছে। সংক্রমণের ভয় কেটে যাওয়ার পরে কালবিলম্ব না করে ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ জরুরি ছিল, অবকাশ ছিল সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তরিত করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারে একটা যথার্থ যুদ্ধকালীন অভিযানের (সেই অভিযানকে ‘দুয়ারে শিক্ষা’ নামে ডাকলেও সত্যজিৎ রায় ধরণি দ্বিধা হত না), প্রয়োজন ছিল স্কুলগুলিতে বাড়তি সময় পড়াশোনার ব্যবস্থা করার, তার বদলে আপন বেগে পাগলপারা ছুটির জোয়ারে স্বাভাবিক পঠনপাঠনের নির্ঘণ্টটিও ভেসে গেল, তার সঙ্গে যুক্ত হল মহান পঞ্চায়েত নির্বাচনের মহাপ্লাবন। পৃথিবীর সমস্ত ব্যাপারে এবং অব্যাপারে এ রাজ্যের ভাগ্যবিধাতাদের উৎসাহের শেষ নেই, কিন্তু স্কুলশিক্ষা নিয়ে তাঁদের এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করার ইচ্ছা আমরা দেখিনি। দুর্নীতি, মামলা, শিক্ষক নিয়োগে ব্যাঘাত, উৎসশ্রী— যাবতীয় কীর্তিকলাপের দায় শাসক হিসাবে তাঁদের উপরেই বর্তায়, কিন্তু ঔদাসীন্যের দায় তাদের কোনওটির চেয়ে এক বিন্দু কম নয়।

এটাই যখন বাস্তব, তখন সরকার নিজে থেকে কী করবে তার ভরসায় বসে থাকার কোনও যুক্তিই থাকতে পারে না। আপাতত উপায় একটাই। যে যেখানে সম্ভব, স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় সাহায্য করার কাজে নামা। স্কুলে সে-কাজ অবশ্যই শিক্ষকদের। তাঁদের একটি অংশ সমস্ত অভাব, অসুবিধা, বাধাবিপত্তি, সমস্যার জোয়াল ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে নানা বয়সের সন্তানসন্ততিরা, কেউ পিছিয়ে পড়লে তার পাশে দাঁড়িয়ে ঘাটতি পূরণ করছেন, এক সময় সে-ও অন্যদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। সম্প্রতি মফস্‌সলের কয়েকটি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়ার সূত্রে এমন কয়েক জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল। সেই অভিজ্ঞতা ভরসা দেয়। বড় ভরসা।

জানি, সব শিক্ষক সমান নন, অনেকের সামর্থ্যের ঘাটতি আছে, আরও অনেকের তার চেয়ে বহুগুণ ঘাটতি আছে সদিচ্ছার, যে ঘাটতি সহজে মেটার নয়। এবং, অবশ্যই, বহু স্কুলে শিক্ষকের অভাব প্রচণ্ড, দশচক্রের মহিমায় আপাতত সে অভাব মেটার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অতএব স্কুলের সমস্যার সমাধান কেবল স্কুল দিয়ে হবে না। দরকার সত্যিকারের সামাজিক উদ্যোগের। কোনও একটি উদ্যোগ নয়, বিভিন্ন এলাকায়, একই এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বহু উদ্যোগের। বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োজন আলাদা, সামর্থ্য আলাদা, সমস্যা আলাদা, তাই পথও আলাদা হতেই পারে। মিল চাই কেবল ওই একটা জায়গায়: পরিশ্রমী সদিচ্ছা। যেখানে সেই শর্তটি পূর্ণ হবে, সেখানেই পথ খুলে যেতে বাধ্য। বাগনানের ওই ছাত্র-শিক্ষকরা তার একটি নজির। এমন অসংখ্য নজির তৈরি হতে পারে গোটা রাজ্য জুড়ে। তার জন্য— নিঃসঙ্কোচে পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি— শিক্ষক, শিক্ষাব্রতী, স্বেচ্ছাসেবী, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, সবাই মিলে একে অন্যকে মাঠে নামানোর উদ্যোগ করতে হবে, মিশন মোড-এ। যদি তা করা যায়, তবে অন্তত এক জন শিক্ষকের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ আমরা পাব। তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement