প্রার্থী: ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাছে নারীরা। কাংড়া চিত্রকৃতি। উইকিমিডিয়া কমনস। ফাইল চিত্র।
সাগরের মতো বিদ্যা, জ্ঞানগম্যি কিছু নেই, ‘বিদ্যাসাগর’ আসলে গুহাবাসী এক লম্পট সন্ন্যাসী। সারা ক্ষণ ষোলো রকম দর্শন-বিচার নিয়ে ধ্যান করে, যুদ্ধবাজ পৃথিবীতে কী ভাবে শান্তি আসতে পারে, প্রকৃত জ্ঞান বলে এই জগতে কিছু আছে কি না ভাবে। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়, তার পর অন্ধকারে গুহার অন্য দিকে হাতড়ায়। সেখানে শুয়ে পম্পা কাম্পানা নামে এক পিতৃহীন বালিকা, তার মা সম্প্রতি স্বেচ্ছায় জহরব্রতের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনাথা বালিকাকে সন্ন্যাসী তার গুহায় আশ্রয় দিয়েছে। বালিকা ক্রমে তরুণী, সেই প্রস্ফুটিত সৌন্দর্যের দিকে বিদ্যাসাগর হাত বাড়ায়। তরুণী সব জানে, কিন্তু ওই সময়টুকু জাদুবলে সে স্মৃতি থেকে মুছে দেয়। জাদু ও দৈবী শক্তিতে আচ্ছন্ন পম্পা কাম্পানা জানে, বেশির ভাগ পুরুষ এই রকমই। দার্শনিকতা, বিশ্ব শান্তি ইত্যাদি নিয়ে ভাবাভাবি করে, তার পর ঘুমন্ত অসহায় বালিকার শরীর হাতড়ায়।
মধ্য-দক্ষিণ ভারতের সন্ন্যাসী বিদ্যাসাগরের এই গুহাই পরে বিখ্যাত মণ্ডনমঠ হয়ে উঠবে, বিদ্যাসাগর হয়ে উঠবে রাজাদের পরামর্শদাতা। রামায়ণের আমলে পম্পা নদীর তীরে এখানে বিশাল সাম্রাজ্য ছিল, নাম কিষ্কিন্ধ্যা। সুগ্রীব ও হনুমানের সঙ্গে এখানেই রামায়ণের রাম-লক্ষ্মণের দেখা। সব সভ্যতা বিকশিত হতে হতে এক সময় স্বর্ণযুগে পৌঁছয়, সবাই ধন্য ধন্য করে, তার পর তা আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে ঢলে পড়ে। এখন কিষ্কিন্ধ্যাতেও তাই বালি, সুগ্রীব, হনুমান, রাম, লক্ষ্মণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। শুধু নিঃসঙ্গ নদীর ধারে বড় বড় পাথর। হুক্কা আর বুক্কা নামে দুই ক্লান্ত সৈনিক এক দিন সেখানে পৌঁছয়, তাদের সঙ্গে ঢেঁড়স, লাউ, কুমড়োর বিচি-ভর্তি বস্তা। দৈবপ্রাণিত পম্পা সেই বীজ ছড়িয়ে দেয়, বীজ থেকে জন্ম নেয় রাজপ্রাসাদ, মন্দির, বাজার, সেনাশিবির সমেত আস্ত সভ্যতা। মনুষ্যসভ্যতা আর কিছুই নয়, ঢেঁড়স, লাউ, কুমড়োর ক্ষুদ্র বীজে ঘটে-যাওয়া দৈবী দুর্ঘটনা।
এ ভাবেই শুরু হয়েছে সলমন রুশদির সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস ভিকট্রি সিটি। বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা, কোনও কিছু পাত্তা না-দেওয়া মেধাবী শয়তানি, সব মিলিয়ে রুশদির কলমে আর একটি চমৎকার নাগরদোলা। ভাগ্যিস গত অগস্টে নিউ ইয়র্ক শহরে উন্মাদ হামলাকারীর ছুরি চলার আগেই এই উপন্যাস ছাপতে চলে গিয়েছিল! নইলে পৃথিবী চমৎকার একটি লেখা থেকে বঞ্চিত হত, বাঙালিরা আরও বেশি! ‘ভিকট্রি সিটি’র অনুবাদ করলে একটি শব্দই আসে, বিজয়নগর। কর্নাটকের হাম্পি শহরে যে সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে ১৯৬৫ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস তুঙ্গভদ্রার তীরে। সেখানেই শেষ নয়। শরদিন্দু তাঁর উপন্যাসের সূত্রনির্দেশ করতে গিয়ে লিখছেন, “এই কাহিনীর ঐতিহাসিক পটভূমিকা রবার্ট সিওয়েলের ‘এ ফরগটেন এম্পায়ার’ এবং কয়েকটি সমসাময়িক পান্থলিপি হইতে সংগৃহীত।” একুশ শতকে রুশদির নতুন উপন্যাসের সূত্রনির্দেশেও ওই বই আ ফরগটন এম্পায়ার! ভাষা ও সময়ের বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় সাহিত্যে শরদিন্দু থেকে সলমন রুশদি, সবাই এক সুতোয় বাঁধা।
শুধু শরদিন্দু নন। ওই যে গেরুয়াধারী ভণ্ড সন্ন্যাসী বিদ্যাসাগর! নাম, স্মৃতি, ইতিহাস নিয়ে বহু কাল ধরেই টক-ঝাল চাটনি তৈরি করেন রুশদি। এই উপন্যাসে মণ্ডনমঠের সন্ন্যাসী যেমন! মজার ছলে এসে গিয়েছেন শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্গেরী মঠের প্রধান স্বামী বিদ্যারণ্য বা মাধবাচার্য। মাধবাচার্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্কের প্রধানমন্ত্রী। এক দিকে দার্শনিক, সংস্কৃত ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ, জীবন্মুক্তিবিবেক ইত্যাদি গ্রন্থের রচয়িতা। অন্য দিকে দুরন্ত যোদ্ধা। তৎকালীন গোমন্তক রাজ্য বা আজকের গোয়াকে বিজয়নগরের অধীনে এনেছিলেন। এই দার্শনিক, যোদ্ধা ও সন্ন্যাসীর বিখ্যাত গ্রন্থ সর্বদর্শনসংগ্রহ। কী ভাবে অন্যের ধর্মমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক করতে হয়, সন্ন্যাসীর বইটি তার অনন্য উদাহরণ। নাস্তিক চার্বাক থেকে বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, বৈষ্ণব সকলের কথাই রয়েছে সেখানে। মছলিখোর বাঙালি ‘প্রকৃত হিন্দু’ কি না, সে নিয়ে আজকাল হিন্দুত্ববাদীরা হরেক প্রশ্ন তোলেন। মধ্যযুগে বিজয়নগরের যোদ্ধা তথা সন্ন্যাসী কিন্তু লিখছেন, “মাছে আঁশ, কাঁটা দুই-ই থাকে। লোকে সে সব ত্যাগ করে সারভাগটুকুই খায়।”
ছাপাখানা আসার আগে কলকাতায় মাধবাচার্যের মাত্র দুটো পুঁথি ছিল। একটা সংস্কৃত কলেজে, আর একটা এশিয়াটিক সোসাইটিতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটিকে প্রথম পুস্তকাকারে ছাপার কথা ভাবেন। কিন্তু ভুলভ্রান্তি সমেত দু’টি মাত্র পুঁথি থেকে বই সম্পাদনা করা যায়? বারাণসীর সংস্কৃত কলেজে পাওয়া গেল আরও তিনটি পুঁথি। সব নিয়ে সম্পাদনায় নামলেন বিদ্যাসাগর, পাঁচ বছর পরিশ্রমের পর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ১৮৫৮ সালে ছেপে বেরোল সেই বই। মধ্যযুগের সন্ন্যাসীর যুক্তিপূর্ণ বিতর্কের মডেল প্রথম ছাপাখানার আলো দেখল বাংলার বিদ্যাসাগরের সৌজন্যেই। বাঙালি আজকাল বিদ্যাসাগর বলতে বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা, বর্ণপরিচয়, অনেক কিছু বোঝে। কিন্তু এই তন্নিষ্ঠ গ্রন্থ সম্পাদনার কথা বলে না। সেখানেই রুশদির মজাদার, ইতিহাসঋদ্ধ চাটনির জিত!
বস্তুত, বিদ্যাসাগর নামের মজাটাই ভ্রান্তিবিলাসে আচ্ছন্ন বাঙালিকে অনেক কিছু মনে পড়িয়ে দেয়। এশিয়াটিক সোসাইটি এই সংস্কৃত বই না ছাপলে ইংরেজি ভাষাতেও আসত না সর্বদর্শনসংগ্রহ। ১৮৫৮ সালে বই বেরোনোর পর ই বি কাওয়েল, এ ই গফ সাহেবের উদ্যোগে ইংরেজি অনুবাদ। বিদ্যাসাগর এই অনুবাদও দেখেছিলেন। ১৮৭৪ থেকে ’৭৮ অবধি টানা চার বছর বারাণসীর সংস্কৃত পত্রিকা পণ্ডিত-এ সেটি ছেপে বেরোত। বই হয় বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর, ১৮৯৪ সালে। সেটাই এখনও প্রামাণ্য অনুবাদ।
এই শহরের মেলায় কোটি কোটি টাকার বই কেনাবেচা হয়, কিন্তু বইয়ের ইতিহাস নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায় না। নইলে জানত, কলকাতায় তৈরি একটা বই কী ভাবে বারাণসী থেকে বৃহত্তর ইংরেজিভাষী দুনিয়াকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল।
মাধবাচার্য নামটিও যে রুশদির অজানা, এমন নয়। উপন্যাসে বিদ্যাসাগরের কয়েক প্রজন্ম পরে মণ্ডনমঠের ভার নিয়েছেন সন্ন্যাসী মাধব আচার্য। আবার, বাস্তবে শঙ্কর এবং রামানুজের দর্শন একেবারেই আলাদা। কিন্তু লেখক ইচ্ছাকৃত ভাবে ফারাকটা গুলিয়ে দিয়ে মজা করেন। মাধব আচার্যের কয়েক প্রজন্ম পরে মণ্ডনমঠের দায়িত্বে যে সন্ন্যাসী আসে, তার নাম রামানুজ। কেন এই গোলানোর খেলা? উপন্যাসের মূল বক্তব্য সেখানেই। রাজা-প্রজা, বৈদান্তিক-বৈষ্ণব, জয়ী-পরাজিত, সভ্য-অসভ্য কেউই পৃথিবীতে টিকে থাকে না। রয়ে যায় শুধু অক্ষরমালা। সেখানেই আমাদের অতীত-উদ্ধার।
আর অতীত বলে, শঙ্করাচার্য ও মাধবাচার্যের মতো উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালিও মূলত বৈদান্তিক। রাজা রামমোহন উপনিষদ অনুবাদ করেন, বঙ্কিম থেকে বিবেকানন্দ সকলে শাঙ্করদর্শনের পথিক। গাছপালা থেকে রাম-রহিম সর্বত্র সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মের প্রকাশ, ভেদাভেদগুলি মায়ামাত্র।
রুশদি এই বৈদান্তিক দর্শন নিয়েও মজা করেছেন। সন্ন্যাসী বিদ্যাসাগর ভক্তদের বলে, “পৃথিবীতে কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। সবই মায়া।” তা হলে, সামনের গাছটা? এই বিষনাগ সাম্রাজ্য? “সবই অবিনশ্বর ব্রহ্ম। সেটাই চূড়ান্ত। আর সব কিছুর মধ্যে আছে আত্মন। সে-ও এক, পুরোদস্তুর ব্রহ্ম। বাকিটা মায়া। ব্রহ্মণ, আত্মন দুটো জিনিস। কিন্তু দুই আসলে এক,” ভক্তদের বোঝায় বৈদান্তিক।
উপন্যাসে আছে এক মহাভারতীয় অরণ্য। সেখানে ঢুকলে ছেলেরা মেয়ে হয়ে যায়। গাছের উপরে নৃত্য করেন সেই অরণ্যের দেবী। তাঁর নাম অরণ্যানী। এই যে বাঙালির সাহিত্য থেকে সিনেমা, সঙ্গীত, রাজনীতি, খেলাধুলো সর্বত্র ফেলে-আসা স্বর্ণযুগের জন্য হাহুতাশ, উপন্যাসে পম্পা কাম্পানা বলে, “লোকে যখন স্বর্ণযুগের কথা বলে, ভাবে সেটা অনন্তকাল টিকবে। আসলে স্বর্ণযুগ মেরেকেটে কয়েক বছর থাকে। তার পরই ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।” দুই রানি একই সঙ্গে গর্ভবতী, এক জন অন্যকে পাঠায় বাংলার সন্দেশ।
এ ভাবেই কি তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাসে নাম না করেও বাংলাকে মজার ছলে ছুঁয়ে গেলেন রুশদি? বিদ্যাসাগর, সন্দেশ বা শৃঙ্গেরী মঠের সাযুজ্যে তৈরি উপন্যাসের মণ্ডনমঠে? বাস্তবের শৃঙ্গেরীতেও কি নেই বাংলার সাহিত্যস্মৃতি? জায়গাটার নাম আসলে শৃঙ্গগিরি। ওখানকার লোকেরা বলেন, ঋষ্যশৃঙ্গগিরি। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ওখানে তপস্যা করতেন। জীবনে কখনও তিনি নারী দেখেননি। এক সময় অঙ্গদেশে অনাবৃষ্টি, সুন্দরী গণিকারা ভুলিয়েভালিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসে, বৃষ্টি নামে। মিথ, শৃঙ্গেরীর কাছে কিগ্গা পাহাড়ে ঋষ্যশৃঙ্গ তপস্যা করতেন, সেখানকার মন্দিরে সত্তর-আশি বছর আগেও মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই ঋষ্যশৃঙ্গ-কাহিনিও একদা ছায়া ফেলেছিল বাংলা সাহিত্যে, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিণী নাটকে।
একটি ইংরেজি উপন্যাস যে বাংলা ভাষার কত পূর্বসূরিকে মনে পড়িয়ে দিল!
এখানেই ভারতীয় সাহিত্যের, এখানেই সলমন রুশদির নতুন উপন্যাসেরও জিত!