একযোগে: ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম-এর সম্মেলন, পোর্তো আলেগ্রে, ব্রাজ়িল, ২৭ জানুয়ারি ২০০৩। গেটি ইমেজেস।
লাতিন আমেরিকা মানেই নিরন্তর রাজনৈতিক পালাবদল। সেই ভূখণ্ডের নানা দেশে শ্রমজীবী মানুষকে দমন করে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি বারংবার তাদের আধিপত্য জারি করে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি থাকে, বিক্ষোভ বেড়ে চলে, আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন তাকে কব্জা করতে পারে না, এবং এক সময় রাজা বদলে যায়। শুধু পোশাকের রং আর মুখোশের ঢং নয়, বদলায় রাষ্ট্রের নীতি এবং আচরণও। ব্রাজ়িলের রাষ্ট্রনায়কের আসনে জাইর বোলসোনারো থেকে লুইস ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা— আর যা-ই হোক, টুইড্লডাম থেকে টুইড্লডি বলা যাবে না। ব্রাজ়িল একটি নজিরমাত্র। মহাদেশ জুড়ে কী ভাবে সম্ভব হয় এই বার বার ফিরে আসা?
প্রশ্নটা পেশ করেছিলাম এডগার ইশ লোপেস-এর কাছে। লাতিন আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলবর্তী দেশ ইকোয়েডর-এর মানুষ তিনি। প্রবীণ অধ্যাপক, বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ও তাত্ত্বিক, এই শতকের গোড়ার দিকে কিছু দিন দেশের পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন। মার্চের শেষে এ-শহরে ‘অরুণ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’ দিলেন, সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। সেই সূত্রেই এপ্রিলের গোড়ায় এক সকালে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল। দুর্লভ সুযোগ, কারণ দক্ষিণ আমেরিকা অনেক দূর, তদুপরি কলকাতা এখন আর দুনিয়ার শহর নয়।
কলকাতায় এডগারের এ-বারই প্রথম আসা। ভারতে দ্বিতীয় বার। ২০০৪ সালে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম-এর মুম্বই সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন। প্রায় দু’দশক আগেকার কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল: “ভারতের নানা অঞ্চল থেকে সেখানে লোকজন এসেছিলেন, তাঁদের কত রকমের পোশাক, কত রকমের সাজসজ্জা, কত রং...!” শুনে মনে হল, তে হি নো দিবসা গতাঃ। অথচ খুব সুদূর অতীত তো নয়! ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের সূচনা হয়েছিল ব্রাজ়িলের পোর্তো আলেগ্রে শহরে। জনসমাজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে, বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবী এবং সুযোগবঞ্চিত মানুষের বহুবিধ না-পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা নানা ধরনের আন্দোলন সেই মঞ্চে পারস্পরিক সংহতি খুঁজেছিল। বহুত্বকে বিসর্জন না দিয়ে, বরং তাকে জোরের সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েই সেই সংহতির অনুশীলন করেছিলেন আন্দোলনের কর্মীরা। নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে ডব্লিউএসএফ অচিরেই তার জৌলুস হারায়, তবে দুনিয়া জুড়ে সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব ক্রমশই বেড়েছে। বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকায়। ব্রাজ়িল থেকে ভেনেজ়ুয়েলা, মেক্সিকো থেকে বলিভিয়া, চিলি থেকে কলম্বিয়া— নানা দেশের ঘটনাপ্রবাহ দেখেশুনে লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা আমাদের মনে তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে একুশ শতকের গোড়া থেকে। সেই ধারণা থেকেই উঠে আসে ওই প্রশ্ন: নিরন্তর সংগ্রাম আর ক্রমাগত প্রত্যাবর্তনের রহস্যটা ঠিক কী?
ভাল শিক্ষক মন দিয়ে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন শোনেন, তার পরে উত্তরটা নির্মাণ করেন। এডগার শুরুতেই সতর্ক করে দিলেন: লাতিন আমেরিকার এক-একটা দেশের বাস্তব এক-এক রকম; এবং কোনও একটা কারণ নয়, অনেক কারণ মিলেমিশে দক্ষিণপন্থা তথা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা সম্ভব হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এটাও মনে রাখতে হবে যে, আজ বিশ্ব অর্থনীতির পরতে পরতে যে নিয়োলিবারাল পুঁজির বিপুল বিস্তার, তার অশ্বমেধের ঘোড়া প্রথম ছুটেছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতেই। “তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে সেখানকার জনসাধারণ সেই প্রক্রিয়া দেখেছেন, তার শিকার হয়েছেন।” এবং, বাঁচবার তাগিদেই তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন, পরস্পর হাত মিলিয়েছেন। এই মানবজমিন আবাদ করেই সংগৃহীত হয়েছে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিস্পর্ধী সামর্থ্য।
কিন্তু সংগঠন? পার্টি? “অনেক ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক সংগঠনগুলি প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিতে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে, তবে জনসাধারণের সংগ্রামের ভূমিকা সচরাচর আরও বড়।” বস্তুত, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি যেখানে জনসমাজের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা দাবিদাওয়া বা ক্ষোভবিক্ষোভকে নিজেদের সংগ্রামের চালিকা শক্তি করে তুলতে পেরেছে, সেখানে তারা পালাবদলের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সে জন্য অনেক সময়েই তাদের নানা আপস করতে হয়েছে, যেমন প্রথম পর্বের তুলনায় এখনকার লুলা অনেক বেশি ‘উদার’। কিন্তু এটাও ঠিক যে, অতিকায় পুঁজির কাছে দাসখত-লিখে-দেওয়া প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর শাসন ব্রাজ়িলের বহু মানুষকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, লুলার বামপন্থী ঝোঁক পছন্দ না হলেও কেন তাঁর পাশেই থাকা দরকার। আবার জনসাধারণের এই বোধই নানা সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে জোট বাঁধতে, অন্তত কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছে, হয়তো বাধ্যও করেছে।
এডগার ইশ লোপেস।
তবে কি দক্ষিণপন্থা এবং স্বৈরতন্ত্রের সর্বনাশা আগ্রাসনের মোকাবিলায় সামাজিক আন্দোলনই যথেষ্ট? শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা-লব্ধ বোধ এবং চেতনাই সমাজ পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ? সংগঠন তথা পার্টির স্বতন্ত্র কোনও দায়িত্ব বা ভূমিকা নেই? না, এমন নির্বোধ প্রশ্ন করে অমায়িক মানুষটিকে বিব্রত করিনি। তবে অন্য এক প্রশ্নের সূত্রে বামপন্থীদের দায়িত্বের প্রসঙ্গটা ফিরে এল। জানতে চেয়েছিলাম, বহু দেশেই বৃহৎ পুঁজির অনুগামী কিংবা সহযোগী জনবাদী (পপুলিস্ট) শাসকরা তাঁদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য জোরদার করতে তৎপর এবং বহু ক্ষেত্রেই রীতিমতো সফল, এই পরিস্থিতিতে বামপন্থী দলের কাজ কি অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েনি? অকপটে কবুল করছি যে, এ-প্রশ্ন করবার সময় মাথায় নিজের দেশের কথা, বিশেষত নিজের রাজ্যের কথাই প্রবল আকার ধারণ করেছিল। তবে, সমস্যাটাকে একটু বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে চাইছিলাম।
এডগার, আবারও, সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন: জনবাদ কোনও আদর্শ নয়, ফ্যাসিস্টরাও জনবাদকে ব্যবহার করতে পারে এবং করছে। বস্তুত, তারা জনবাদী নীতি এবং কার্যক্রমকে ব্যবহার করে কৌশল হিসাবে। জনসাধারণের নিজস্ব চেতনাকে প্রভাবিত করার, আচ্ছন্ন করার, ধ্বংস করার কৌশল। বামপন্থীদের দায়িত্ব এর উল্টো। তাঁদের কাজ হল মানুষের চেতনাকে নিরন্তর জাগ্রত করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া— শ্রমজীবী মানুষের বোধ এবং জ্ঞানকে জোরদার করা, তাঁদের বাস্তবকে অনুধাবনের সামর্থ্য বাড়িয়ে চলা, যাতে তাঁরা স্বাধীন চিন্তা ও বিবেচনার ভিত্তিতে নিজের সিদ্ধান্ত স্থির করতে পারেন। একটু থেমে, প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে, এডগার বললেন, “তাই, জনবাদ নিয়ে আমার ভয় নেই। আমার চিন্তা হয়, যখন বামপন্থীরা মানুষের চেতনা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রাজনীতি করেন। এটা উদ্বেগের কারণ। (শ্রমজীবী) মানুষ যদি সচেতন হন, তাঁরা সব কিছু করতে পারেন। সব কিছু।”
এই কথোপকথনের পরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে মাস পাল্টাল। মে দিবসের গানে গানে পুবালি আকাশ আবারও রঙিন হল। মিছিল করে ম্যারাপ বেঁধে আবারও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বাণী উচ্চারিত হবে। ইতিমধ্যে শ্রমিক-কর্মীদের কাজের সময় বাড়ছে, পাওনাগন্ডা কমছে, যেটুকু নিরাপত্তা ছিল তা-ও দ্রুত বিলীয়মান। মে দিনের মঞ্চ থেকে এই সব অন্যায়ের প্রতিবাদে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বন্দনায় পরিচিত স্লোগানাদি নিশ্চয়ই ধ্বনিত হবে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের স্বাধীন চিন্তা? সেই চিন্তার শরিক হয়ে বামপন্থী রাজনীতির অনুশীলন? সেই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ সাধন? লাতিন আমেরিকার কথা বলতে গিয়ে এডগার বলছিলেন, টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে, ‘আমি আশাবাদী’। অনেক দূরের এই রাজত্বে বসে যত বারই সেই কথায় মনোবীণার তার বাঁধতে যাই, তত বারই কানে আসে অনেক দিনের পুরনো সেই আকুতি: একটু পা চালিয়ে ভাই।