প্রীতিলতা মনে করান, প্রতিবাদী মেয়ের উপর রাষ্ট্রের আক্রোশ
Pritilata Waddedar

মুছে যাওয়া মুখগুলি

প্রীতিলতার আত্মাহূতির দশ বছর পরে আর এক সেপ্টেম্বরে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় বুকে গুলি লেগে মেদিনীপুরের ‘গান্ধীবুড়ি’ মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যু হয়।

Advertisement

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪৩
Share:

বিস্মরণতলে: পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নামে তৈরি সৌধ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আবার একটা ২৪ সেপ্টেম্বর এসে গেল। ৯০ বছর আগে এই দিনটাতেই চট্টগ্রামের পাহাড়তলি অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার পর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-৩২) তাঁর সাত জন পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে, সহযোদ্ধাদের শেষ বিদায় জানিয়ে নিজে বেছে নেন মৃত্যু। দেশের মেয়েদের বিপ্লবের পথে অনুপ্রাণিত করতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ কথা প্রীতিলতার শেষ জবানবন্দিতে আমরা পাই এবং অগ্নিযুগের প্রথম নারী শহিদ হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

Advertisement

প্রীতিলতার আত্মাহূতির দশ বছর পরে আর এক সেপ্টেম্বরে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় বুকে গুলি লেগে মেদিনীপুরের ‘গান্ধীবুড়ি’ মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যু হয়। অবশ্য তার আগে ১৯৩০-এ ওই জেলাতেই চৌকিদারি ট্যাক্স-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করাকালীন পুলিশের নির্মম প্রহারে মারা গিয়েছিলেন ঊর্মিলাবালা পারিয়া। প্রথম নারী শহিদ হিসেবে মেদিনীপুরে ঊর্মিলাবালার নাম স্বীকৃত। অন্য দিকে, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ ‘হাজং মাতা’ রূপে মনে রেখেছে ১৯৪৬-এর টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহিদ রাসিমণি হাজংকে। উদাহরণের কমতি নেই। তবে প্রীতিলতা ও মাতঙ্গিনী— দু’জনকেই আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার দুই নারী শহিদ বলে স্বীকার করি, তাঁদের নিয়ে কিছু আলোচনা হয়, তাঁদের ছবি/মূর্তি দেখতে পাই কিছু জায়গায় (নীচের ছবিটি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা থেকে প্রকাশিত পুস্তিকার প্রচ্ছদ)।

এখন প্রশ্ন হল, যাঁরা পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন/ ফাঁসি স্বীকার করেছেন/ নিজে বেছে নিয়েছেন দেশের জন্য মৃত্যু— শহিদ হিসেবে তাঁদের স্মরণ করার পাশাপাশি আমরা কেন সেই সব মেয়ের কথা ভুলে যাব যাঁদের দৈহিক মৃত্যু আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সময়েই ঘটেছে, কিন্তু অন্য রকম ভাবে। বর্ধমানের সরসীবালা দাস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগদানের সময় পুলিশের হাতে বেদম মার খান। এর ফলে সন্তানসম্ভবা ওই নারীর গর্ভপাত ও মৃত্যু হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে পুলিশের অত্যাচারে গর্ভপাত-মৃত্যু, অথবা পুলিশি আক্রমণের মুখে গর্ভবতী মেয়ের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু, এ নজির আরও আছে। মেদিনীপুরে আইন অমান্যের সময় যেমন, সিলেটে নানকার বিদ্রোহের সময়ে তেমনই। পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটলে বা দুষ্প্রাপ্য অডিয়ো রেকর্ডিং শুনলে এটাও দেখা যায় যে, শারীরিক ভাবে কোনও বল প্রয়োগ না করে, এক দল মেয়েকে মিছিল/অবরোধ থেকে গ্রেফতারের পর স্রেফ উলঙ্গ করে লক-আপে রাখা অথবা কয়েক দিন পর উলঙ্গ অবস্থায় ভ্যানে করে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ভাবে মেয়েদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য যে কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তার অভিঘাত সীমাহীন। গ্রামে ফিরে আসার পর পরিবারে ও সমাজে এই মেয়েরা কতটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন? এই দেশপ্রেমিকদের মধ্যে কাউকে জীবন্মৃত অবস্থায় বাকি দিনগুলো কাটাতে হয়েছিল কি? আট দশক আগে তাঁরা সেই চরম অপমানের ক্ষত প্রতি দিন কী ভাবে বহন করেছেন, তার কোনও হদিস রাখার কথা আমরা কখনও ভাবিনি।

Advertisement

আর এক ধরনের মৃত্যুর কথা বলি। মেদিনীপুরের অসহায় বিধবা সত্যবতীর কথা, যিনি যৌন কাজ করে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটাতেন এবং ১৯৩০-৩২ সালে প্রথমে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্যে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় হন। যত বার পুলিশ তাঁকে চিনতে পারত পিকেটিং অথবা মিছিলের সময়, তত বার চলত অকথ্য ভাষায় অপমান ও মারধর। সশ্রম কারাদণ্ড ছাড়াও সত্যবতীর জুটেছিল এই বাড়তি নিগ্রহ। হিতেশরঞ্জন সান্যালের লেখায় পাচ্ছি বহু বছর আগে মেদিনীপুরের মানুষের মুখে তিনি শুনেছিলেন, যে কোনও জনসমাবেশে সত্যবতীকে দেখলেই পুলিশ বলত, ‘এ শালী তো আবার এখানে এসেছে!’ ১৯৩২-এ নন্দীগ্রামে একটা মিটিং-এ যোগ দিতে গিয়ে রাস্তায় পুলিশের হাতে শেষ বারের মতো ধরা পড়েন সত্যবতী। তাঁর দেশপ্রেমী ভূমিকা সহ্য করতে না পেরে, পুলিশ সত্যবতীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় আড়ালে, ধর্ষণ ও প্রহারে ক্ষতবিক্ষত করা হয় তাঁকে। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনে সত্যবতীকে হাসপাতালে চালান দেওয়া হয় এর পর। আমাদের পরাধীন দেশের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছেন এ রকম কত সত্যবতী বা সরসীবালা, আমরা জানি না।

ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা থেকে প্রকাশিত পুস্তিকার প্রচ্ছদ।

১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে প্রথম কয়েক দশকে যে ইতিহাস রচিত ও আমাদের কাছে পৌঁছনো হয়েছে, তাতে স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোয় মেয়েদের বহুমাত্রিক লড়াই এমনিতেই অনুপস্থিত। এই লিঙ্গ-অসচেতন ইতিহাসে আন্দোলনকারী মেয়েদের উপর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-সংঘটিত যৌন লাঞ্ছনা ও অত্যাচার এবং কখনও দৈহিক কখনও সামাজিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার দৃষ্টান্তগুলোর কোনও স্থান থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গত কুড়ি-তিরিশ বছরে ইতিহাস চর্চার শৈলী অনেক দিক থেকে পাল্টানোর ফলে আমরা পুরনো ঘটনাকে নতুন করে পড়তে শিখছি, বিশেষ করে লিঙ্গ ও বর্ণের নিরিখে অনেক নতুন প্রশ্ন রাখা হয়েছে। যেমন, গত পঁচিশ বছরে মৌখিক ইতিহাসে মেয়েদের কথা মন দিয়ে শোনা ও তাঁদের লেখালিখি পড়ার ফলে দেশভাগের ইতিহাস অনেক পাল্টেছে।

১৯৭১ সালে আমাদের যে প্রতিবেশী দেশের উদ্ভব, সেই বাংলাদেশে যে অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যৌন হিংসার ক্ষত আজীবন বহন করেছেন/করছেন তাঁদের আজ ‘মুক্তিযোদ্ধা’-র স্বীকৃতি মিলেছে। শুধু সরকারি স্বীকৃতির কথা বলছি না, এ বিষয় সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে নৈঃশব্দ্য ভেঙেছে এবং ইতিহাসবিদদের সংবেদনশীল গবেষণায় চর্চা আছে কী ভাবে যুদ্ধ-পরবর্তী গত ৪০-৫০ বছরে এঁদের জীবনে আঘাতের চিহ্ন আর দৃশ্যমান না হলেও, অস্বস্তি-অসম্মানের চোরাস্রোত বয়ে চলেছে।

আমাদের স্বাধীনতা পঁচাত্তর বছর পার হয়ে গেল। আমরা কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোর ইতিহাসের পরিস্রুত উপস্থাপনা থেকে এখনও সে ভাবে বেরোতে পারিনি। শরীর, যৌনতা, গর্ভ, গর্ভপাতের মতো বিষয় নিয়ে আমাদের অস্বস্তি ও ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা থেকেই কি আমরা আন্দোলনরত মেয়েদের এ রকম মৃত্যুগুলোকে প্রায় অদৃশ্য করে রেখে দিয়েছি? আর যাঁদের মৃত্যু নিয়ে গর্বিত হয়েছি, যেমন ৭২ বছরের বালবিধবা মাতঙ্গিনী হাজরা, তাঁদের দীর্ঘ যন্ত্রণাময় বৈধব্যজীবন মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছি কতটুকু?

আর একটা ভাবার কথা আছে। ১৯৩০-৪০’এ যাঁদের মৃত্যুর কথা বলছি, তাঁরা কেউই ‘বড়’ ঘরের মেয়ে ছিলেন না। জাতপাতের নিরিখেও এঁরা বেশির ভাগ এসেছিলেন পিছিয়ে-রাখা পরিবার থেকে। রাশিয়ার চিঠি-তে রবীন্দ্রনাথ যাঁদের বলেছেন ‘দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে পালিত’, ‘সকলের চেয়ে বেশি যাদের অসম্মান’। এই কারণেও নিশ্চয় তাঁরা এতটা অদৃশ্য রয়ে গিয়েছেন আমাদের ইতিহাসে। না হলে কেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা মহিষাদলের তিনটি গ্রামে ১৯৪৩ সালে ৬০-৭০ বা তারও বেশি মেয়ের উপর পুলিশি বলাৎকারের ঘটনা নিয়ে এত কম কথা হয়েছে?

১৯২১ থেকে ভদ্রমহিলাদের পুলিশ গ্রেফতার করলে আমরা যত কথা বলেছি, তাঁদের রাজনীতির ধরন এবং সামাজিক অনুমোদনের শর্ত নিয়ে যত আলোচনা করেছি এখনও পর্যন্ত, তার ছিটেফোঁটাও সেই মেয়েদের নিয়ে হয়নি যাঁরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দ্বারা সংঘটিত যৌন হিংসার শিকার। যদিও এই মেয়েরা আজও ‘সভ্যতার পিলসুজ মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে’ আছেন বলে সকলে আলো পাচ্ছে।

গত কয়েক দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনগুলোর ফলে আজ নয়া-উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মেয়েদের—বিশেষ করে প্রান্তিক ও উপদ্রুত অঞ্চলের মেয়েদের— উপর রাষ্ট্রীয় হিংসার ঘটনাগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি, তদন্তের দাবি রাখি। অতীতের নৈঃশব্দ্য আর একটু ভাঙা গেলে দৃশ্যমান হতেন সত্যবতীরা, আর তখনকার ঘটনার নিরিখে এখনকার রাষ্ট্র-সংঘটিত যৌন হিংসার ঘটনাগুলো দেখার একটা চেষ্টা করা যেত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement