অনুপ্রেরণা শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দটি এক বার জুড়ে দিলে লেখায় টোকাটুকির কলঙ্ক থেকে কিঞ্চিৎ রক্ষা পাওয়া যায়। আবার বঙ্গে অনুপ্রেরণায় মনীষীদের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করা যায়, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে আলোর খুঁটি পর্যন্ত পোঁতা যায়। অতএব রবিকরপাতে একটি সামান্য লেখচিত্র করা যেতেই পারে। তাই প্রথমেই স্বীকারোক্তি— লেখার অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কোনও চরিত্রই কাল্পনিক নয়।
আমরা অতি সাধারণ মানুষ
নাম নিধিরাম। অতএব সর্দার।
আর পাঁচ জনের মতো তিনি চায়ের দোকানে থুতনির নীচে মাস্ক ঝুলিয়ে রাজা-উজির মারেন। রাস্তায় ফেলেন পরাগমিশ্রিত থুতু এবং প্যাকেট। মুসলিম এবং বাঙালি তাঁর কাছে আলাদা। অধুনা মুসলিম এবং ভারতীয়ও তাঁর কাছে বিপরীতার্থক শব্দ। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান থেকে শুরু করে, ঘটি-বাঙাল থেকে শুরু করে, সিপিএম-কংগ্রেস থেকে শুরু করে অধুনা সিপিএম-তৃণমূল পর্যন্ত তিনি আমরা-ওরায় বিশ্বাসী। নোটবন্দির সময়ে সিয়াচেনে ভারতের সৈনিকের দুর্দশার কথা বলে তিনি ঘোষণা করতেন, ‘‘দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ করা উচিত।’’ যদিও ডিসেম্বরের শুরু থেকেই টুপি, কানচাপা, কম্বল ও মোজায় আবৃত। বালক অবস্থায় সরস্বতী পুজোর জন্য চাঁদা তুলতে যেতেন এবং সরস্বতী বানান না লিখতে পেরে দিতেন দৌড়। পরে সরস্বতী বানানটি শিখে নেন এবং স্নেহমিশ্রিত ৫০ পয়সা, এমনকি ১ টাকা চাঁদাও আদায় করেন। বড় হয়ে দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোয় সফল চাঁদা আদায়কারী। ইদানীং গণেশপুজোয়। শরীর-স্বাস্থ্য-চরিত্র ভাল রাখতে নিধিরাম মাংস ছেড়েছেন, তবে বিরিয়ানি তাঁকে ছাড়েনি। পাড়ার দোকানে তাঁর স্পেশাল ভেজ বিরিয়ানিতে জাফরানি ভাতের তলায় সাদা সুগোল ডিমের অংশ দেখা গিয়েছিল বলে দুর্জনে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।
অতএব তিনি ধর্মে ভাল ভাবেই আছেন, চিড়িয়াখানায় জিরাফ বেশ কয়েক বার দেখেছেন।
নাম নিধিরাম। অতএব তিনি ঢালতরোয়ালহীন বা নিজেকে ঢালতরোয়ালহীন ভাবতে ভালবাসেন।
দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই
দামোদরবাবু শেঠ নন, তবে ভোজনবিলাসী। এবং ভ্রমণবিলাসীও। একদা থালাবাটিতে গুছিয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জন খেতে ভালবাসতেন, বাড়িতে তার প্রশ্রয়ও ছিল। সময় বদলেছে। নামী রেস্তরাঁয় বাঙালি থালিতেই তিনি সন্তুষ্ট। ইদানীং তাঁর শখ হয়েছে, তিনি গরিব হবেন। না, সব বিলিয়ে হর্ষবর্ধনের মতো কটিতে পরিধেয়টি গুঁজে থাকবেন না। এক কোকিল-ডাকা দুপুরে পুকুরপাড়ে এয়ার-কন্ডিশনড খড়ের চাল, কমোড-বসানো মাটির ঘরে থেকে মাটির থালাবাসনে লাউশাকের তরকারি, চিংড়ির মালাইকারি খেতে তাঁর প্রাণ আঁকুপাকু করে উঠল। অনলাইনে বুক করে তিনি চলে গেলেন রবিবাবুর দেশে। লালমাটির পথ ধরে টোটোটি যেই না থামল রিসর্টে, প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে গেল। সামনে গাছপালা, মাটিতে বাউল গান, দরমার বেড়া ও বারান্দাওয়ালা দোতলা সব ঘর। কিন্তু ট্রলিব্যাগ টেনে ঘরে ঢুকেই মনটা গেল নিবে। ঘরে জানালাই নেই। ছোট বাথরুম। ঢুকতে গেলে পা ঠেকে যায়। প্লাস্টিকের ফ্রেমের আয়না।
দামোদরবাবু মিনমিন করে বলতে গেলেন, এত টাকার প্যাকেজ, শেষে কিনা এই ঘর। ম্যানেজারবাবু নির্বিকার। বললেন, ‘‘গরিবের ঘর, এটুকু তো মানিয়ে নিতেই হবে। সেখানে কি আর হাজারদুয়ারি হবে, দাদা। আর ঘরে বসে থাকবেন কেন, বারান্দায় হাত-পা মেলে বসুন, হাওয়া, চাঁদের আলো, সবই পাবেন। এখন আসুন তো, খেয়ে নিন, খাঁটি বাঙালি খাবার।’’ তা খাওয়াটি হল জব্বর। মাটির বড় থালা, থরে থরে বাটি সাজানো, মিনারেল বটল থেকে জল ঢালা হল কাঁসার গেলাসে। মনে খুঁতখুঁত, মাথায় টাকার চিন্তা, পয়সা উসুল হবে তো? তবু দামোদরবাবু খেলেন চেটেপুটে।
কিন্তু ঘরে ফিরলেই যে দম বন্ধ হয়ে আসে। বারান্দাটি এক চিলতে দাওয়ার মতো। সেখানে নিশ্চিন্তে খুব বসে থাকতে পারছেন না, পড়ে যাই পড়ে যাই ভাব।
দামোদরবাবু ঘর থেকে মাটিতে নামলেন, দেখলেন গাছের সবুজ পাতার মধ্যে প্লাস্টিকের ফুল আটকানো। তার সামনে দাঁড়িয়ে বাউলদের হাত জড়িয়ে ছবি তুললেন। তার পর টোটো ডেকে ট্রলিব্যাগটি তুলে বেরিয়ে গেলেন। বেশ কিছু দূরে মনের মতো হোটেলের ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে তবে না প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি।
দামোদরবাবু সে দিন বুঝলেন, রাজা সাজতে অনেকেই পারে, কিন্তু সকলে গরিব সাজতে পারে না, সাজার চেষ্টা করতে পারে মাত্র।
তাই গাছের সামনে গরিব বাউলের হাত ধরা তাঁর ছবি ফেসবুকে শোভা পেয়েচে।
রঘুপতি কহিলেন, দেবী নাই
রঘুপতি আর সহ্য করতে পারলেন না। নিত্য দিন বাজারে গিয়ে আনাজপাতির সঙ্গে পুজোর কুঁচো ফুল কেনা তাঁর অভ্যেস। এ দিন আধফোটা পদ্ম দেখে বলেছিলেন, চারটি নেবেন। কিন্তু এ তো একেবারে কমলবনে মত্ত... মাঙ্কিক্যাপ ও মাস্কের ভিতর থেকে যথাসম্ভব চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘ওরে ফুলি, পেয়েছিসটা কী? এই ভাবে কেউ পদ্মের পাপড়ি খোলে? এ কি দেওয়ালে ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে পদ্ম এঁকে দিলেই হল। জানিস না, বলা হয় করকমলে, কমলকলির মতো আঙুল। টান মেরে ফুটিয়ে দিলেই হল?’’ কোন কালে পদ্মের অভাবে রঘুপতি চোখ নিবেদন করতে গিয়েছিলেন দেবীর পায়ে।
সেই কমলে আজ ছানি পড়েছে।
দূর মশাই, ছানি তো কলমে পড়েছে। মাঙ্কিক্যাপের মরসুমে পদ্ম?
এই তো মুশকিল, ম্যাজিক রিয়্যালিজ়ম সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। হ য ব র ল পড়েননি বোঝাই যাচ্ছে, হ্যারি পটারও পড়েননি, এমনকি মাসের শেষ রবিবার রেডিয়ো পর্যন্ত শোনেন না। শুনলে বুঝতে পারতেন— পুকুরে কুমির ধরে, চোঁ করে কৈলাস গিয়ে ধ্যান করে, ভোর পাঁচটায় আকাশবাণীতে যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়, তা হলে মাঙ্কিক্যাপ পরে পদ্মফুলও কেনা যায়। ক্রোনোলজি তো সমঝিয়ে!
আর ক্রোনোলজি বা ঘটনাক্রমের কথা যদি বলেন, সেখানে দিনকাল, সময়, দূরত্ব সব কিছুরই হিসেব করা প্রয়োজন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন, একটি মহৎ গুণ নিয়ে রাক্ষস-রাক্ষসীদের রাখঢাক নেই। দূরে যাচ্ছি বললে তারা কাছে কাছে থাকে, কিন্তু কাছে কাছে থাকব বললে তারা হাঁউমাঁউখাঁউ বলে দূরেই চলে যায়। এবং মানুষ সে কথা জানে। মানুষেরও সে গুণ রয়েছে, তবে সেই গুণ প্রকাশে রাক্ষসদের মতো তাদের স্বচ্ছতা নেই। অতএব দূরে দূরে আছি বলে কে আদতে কাছে কাছে, আর কাছে কাছে ভাব দেখিয়ে কে আদতে দূরেই ছিল, তা বোঝা মাঝেমধ্যেই মুশকিল হয়ে পড়ে।
বঙ্গ সমাজ এবং রাজনীতিতে সেই রাক্ষসগণ বা রাক্ষসগুণ, লাল-কমল এবং নীল-কমল ব্যাপ্ত।
এক লাল-কমল অভিনেত্রী রাজনীতিতে পূর্ণ প্রবেশের সময়ে বলেছিলেন, গোধরায় কী হয়েছিল, তাঁর মনে নেই। কারণ, অনেক, অনেক বছর আগে তা ঘটেছিল। অর্থাৎ চাঁদে নামেননি বলে চাঁদ নেই, হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োও অসত্য। কারণ তা অনেক, অনেক, অনেক বছর আগে ঘটেছিল।
অতএব রঘুপতি নিজের অক্ষিকমলের কথা ভুলে যেতে থাকেন।
ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘‘নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’’
কথাগুলো যিনি যেমন ভাবে নেবেন, আর কী! অযোধ্যা নিতে পারেন আবার কবির মনোভূমিও নিতে পারেন। দ্বিতীয়টি নিলে মন্দিরের খরচ নেই।
পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই
পলাশপ্রিয়া প্যান্ডেলে একা হাঁটু মুড়ে বসে সবই দেখেন। তাঁর অন্তর সিক্ত। রবি লিখেছিল, ‘‘তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল, বীণাবাদিনীর শতদলদলে করিছে সে টলোমল।’’ দেবী ভাবলেন, বাঙালির অশ্রু কি আর টলোমল করে না? আটা জ্বাল দিয়ে তৈরি আঠা আর রঙিন কাগজের শিকল থেকে বাঙালি মুক্ত। তার কি আর কিছু হারানোর নেই! কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা রাজহাঁসটি চক্ষু মুদেই বুঝতে পারলে, দেবী ভারাক্রান্ত। মনে মনে বললে, ‘‘ঘরের কথা কি আর বাইরে বলতে আছে মা? ছোট্ট ভাইটা কবে যে ‘মোটা ভাই’ (বিশেষ দ্রষ্টব্য: গুজরাতে বড় ভাইকে মোটা ভাই বলা হয়) হয়ে উঠল?’’ দেবীর মনে পড়ল, তাঁর সুরের সন্ধানে বেরিয়ে দস্যুপতি ফিরিয়েছিল লক্ষ্মীকে, বলেছিল, ‘‘যে বীণা শুনেছি কানে, মনপ্রাণ আছে ভর, আর কিছু চাহি না, চাহি না।’’
তবে লক্ষ্মী মানেই কি নির্লজ্জ ঝনঝনানি? তাঁর এবং বোনের মিলও তো কোথাও আছে। অসংখ্য আলপনায় পা রেখে যিনি আসেন ‘সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’র ঘরে, যাঁর আগমনিতে ফুটে উঠতে চায় অমল-কুঁড়ি।
একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল বুঝি।
সে মন নাই। সে কুসুমও নাই।