দত্তপুকুরে বাজি কারখানার বিস্ফোরণের দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।
দত্তপুকুরে বাজি কারখানার বিস্ফোরণে ন’জনের মৃত্যুর পরেও রাজ্য-রাজনীতিতে বিশেষ হেলদোল নেই। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক তরজা চলছে ঠিকই, কিন্তু সেটা একে অন্যকে প্যাঁচে ফেলার জন্য যতটা, ততটা ভবিষ্যতে এই বিপর্যয় আটকানোর জন্য নয় । উঠে আসছে নানা প্রশ্ন, কিন্তু স্পষ্ট উত্তর মিলছে না।
প্রথম প্রশ্ন— রাজ্য জুড়ে বেআইনি বাজি কারখানা সর্বসমক্ষে রমরমিয়ে চললেও কেন সেগুলি বন্ধ করতে রাজ্য প্রশাসন চোখে ঠুলি পরে আছে? ২০১৫ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন বরিষ্ঠ আইনি আধিকারিকের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিয়েছিল যে, রাজ্য প্রশাসনকে অবিলম্বে যাবতীয় বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করতে হবে। পরবর্তী কালে আদালত অন্য একটি রায়ে মন্তব্য করে যে, এই কারখানাগুলি বন্ধ করার বিষয়ে প্রশাসন সম্পূর্ণ উদাসীন। আদালতের পর্যবেক্ষণ যে সঠিক ছিল, তার প্রমাণ মাসখানেক আগে স্বয়ং মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে হওয়া একটি মিটিংয়ের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি হিসাব অনুযায়ীই রাজ্যে ১৫৯৪টি বাজি তৈরির কারখানা চলছে, যে সংখ্যা কর্তাব্যক্তিদের মতে আরও বাড়তে পারে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, রাজ্যে সবুজ বাজি তৈরির ৭টি কারখানা রয়েছে। অর্থাৎ, অন্তত ১৫৮৭টি অবৈধ বাজি তৈরির কারখানা রাজ্যে চলছে বলে সরকার নিজেই মেনে নিচ্ছে। প্রশ্ন হল, গত ৫ অগস্টের মিটিংয়ে এই তথ্য স্বীকৃতি পেলেও আজ অবধি প্রশাসন এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই তেমন কোনও ব্যবস্থা করেনি। যদি করত, তবে গত ২৬ তারিখের বিস্ফোরণে হয়তো ন’জন মানুষকে মারা যেতে হত না। দত্তপুকুর ব্যতিক্রম নয়। শুধুমাত্র এই বছরেই এখনও পর্যন্ত পাঁচটি বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ২৫ জন মারা গেছেন। বাজি কারখানায় একের পর এক বিস্ফোরণে এই মৃত্যুমিছিলের দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না।
এ ক্ষেত্রেই উঠছে দ্বিতীয় প্রশ্ন। বলা হচ্ছে যে, বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করে দিলে নাকি কয়েক লক্ষ মানুষ জীবিকা হারাবেন। এই কথা কতটা যুক্তিযুক্ত? অনেকে বলছেন যে, রেলেও তো দুর্ঘটনা ঘটে। তবে কি রেল বন্ধ করে দিতে হবে? মনে রাখতে হবে, দেশের আইনে, রাজ্যের এবং আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বিস্ফোরণ সংক্রান্ত দফতর (পেসো), বা তার দ্বারা দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক, রাজ্য অগ্নিনির্বাপণ দফতর এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অনুমতি বিনা কোনও বাজি কারখানা চলতে পারে না। এবং এটা সরকারি ভাবেই স্বীকৃত যে, ৯৯.৯ শতাংশ বাজি কারখানারই কোনও আইনানুগ অনুমতি নেই।
পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সারা বছরের মধ্যে সব মিলিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সবুজ বাজি ফাটানোর অনুমতি আছে। তা হলে যাঁরা জীবিকার নামে এই বেআইনি বাজির কারখানাগুলিকে সমর্থন করছেন, তাঁরা কি দেশের আইন ভাঙার কথা বলছেন? আর যদি জীবিকার কথা তুলে সমর্থন করতে হয়, তা হলে তো বেআইনি বালি খনন থেকে জলা বুজিয়ে বহুতল তোলা, কারখানার চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোনো থেকে পনেরো বছরের পুরনো লরি, ট্যাক্সি চলা— সব কিছুকেই মেনে নিতে হবে! জীবিকা বাঁচাতে গিয়ে জীবন চলে যাবে, এটাই কি ভবিতব্য?
বাজির জীবিকার উপর কত জন নির্ভরশীল, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাজি ব্যবসায়ীদের একাংশ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার কথা বলেছেন। কিন্তু মূলত তিনটি জেলাভিত্তিক বাজিব্যবসায় আগামী দিনে ক্লাস্টারভিত্তিক বাজি কারখানা তৈরির পরিকল্পনায় ছ’হাজারের মতো মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে সরকারি হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। তা হলে এত মানুষের জীবিকার প্রশ্ন আসছে কী করে! অনেকে সঙ্গত ভাবেই বলছেন, হিসাব না দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার কথা বলে আসলে হাতেগোনা বাজি ব্যবসায়ীর জীবিকা রক্ষার চেষ্টা হচ্ছে। গোটা বিষয়টি আরও বেশি অনৈতিক যদি মনে রাখা যায় যে এই সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরাই কিন্তু সাধারণ মানুষকে আর্থসামাজিক দুর্বলতার সুযোগে তাঁদের এই বিপজ্জনক ব্যবসায় নিয়ে আসেন।
আর এখানেই উঠছে পরের প্রশ্ন— বাজি-কাণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা কী? অভিযোগ, এই বেআইনি বাজি ব্যবসায়ীদের মাথায় ছাতা ধরেন কিছু রাজনৈতিক নেতানেত্রী স্রেফ ভোটের অঙ্ক মেলানোর জন্য। মনে রাখতে হবে, এই দলে আছেন সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই। তাই ন’জন অসহায় মানুষের মৃত্যুর পরেও সংবাদমাধ্যমের সামনে স্রেফ কিছু বিবৃতি ও প্রতিবাদ করেই তাঁরা ক্ষান্ত হন। ভুলে গেলে চলবে না, সরকারে থাকাকালীন সিপিএমের বেশ কিছু নেতা এই বাজি ব্যবসাকে সমর্থন করেছিলেন, যেমন এখন করছেন তৃণমূলের কয়েক জন নেতা। সুযোগ পেলে বিজেপি যে এর অন্যথা করবে না, সেই নিশ্চয়তা তাদের নেতারাও দিতে পারবেন না। সেই কারণেই রাজ্যে ২০০৯ সাল থেকে গত ১৪ বছরে প্রায় ১২৫ জন মানুষ বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মারা গেলেও, তা ক্ষমতার এঁদো পুকুরে বিশেষ ঢেউ তোলেনি।
কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে বেশি দিন চলতে পারে না। বাজি নিয়ে রাজ্যে এই মৃত্যুলীলা আর কত দিন চলবে, রাজ্যবাসী সেই জবাব চান।