জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকই অনুক্ত থেকে গেল
G20 Summit 2023

বাজারের উপরেই ভরসা?

প্রায় সব সিদ্ধান্তই পড়ছে ‘মিটিগেশন’-এর চৌহদ্দিতে। মিটিগেশন মানে হল মূলত নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি ও তাদের পাথেয় করে উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:২২
Share:

উদ্বেগজনক? জি২০ বৈঠকের আলোচনা চলাকালীন, দিল্লি, ১০ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

দিল্লিতে জি২০ শীর্ষ বৈঠকের সাফল্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচারের টি২০-তে নেমে পড়েছে, বিরোধীরা বলছেন ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে পাখির চোখ করে। ঐতিহাসিক ভাবে বহু রাজনীতিকই আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক সাফল্যকে পুঁজি করে নিজের নিজের দেশের রাজনীতিতে নম্বর বাড়াতে চেয়েছেন। সুতরাং, নরেন্দ্র মোদী সে পথে হাঁটলে অন্যায় বা অপ্রত্যাশিত বলা যাবে না। আসল প্রশ্নটা অন্য। সত্যিই কতটা সফল জি২০ দিল্লি শীর্ষ বৈঠক?

Advertisement

দেড় বছরের উপর চলতে থাকা রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাকে পাশাপাশি বসিয়ে সর্বসম্মত দিল্লি ঘোষণাপত্রকে জি২০-র বর্তমান প্রধান ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য বলে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সিদ্ধান্তগুলিকে ঘিরে।

যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সঙ্কট। এবং বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগুলির কাছে দিল্লি বৈঠকে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোখার ক্ষেত্রে দিল্লি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে রিনিউয়াল, অর্থাৎ পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ তৈরির পরিকাঠামো এখনকার তুলনায় তিন গুণ বাড়ানো, গ্রিন হাইড্রোজেন ইনোভেশন সেন্টার ও গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স তৈরি করা যাতে আরও সবুজ জ্বালানির সন্ধান পাওয়া যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ২০৩০-এর মধ্যে ৫.৮ থেকে ৫.৯ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলারের প্রয়োজনও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মানা হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শূন্য করে দেওয়ার জন্য চাই প্রতি বছর ৪ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। বলা আর আগামী দিনে করার মধ্যে কতটা সাযুজ্য থাকবে, সে প্রশ্নকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখলেও ভুলে গেলে চলবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ১৪ বছর আগে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের অঙ্গীকার আমেরিকা-সহ উন্নত দেশগুলি করেছিল, তা আজ অবধি হয়ে ওঠেনি। দিল্লি সিদ্ধান্তপত্রের ‘পিছে কেয়া হ্যায়’, সে প্রশ্ন উঠছে।

Advertisement

স্পষ্টতই প্রায় সব সিদ্ধান্তই পড়ছে ‘মিটিগেশন’-এর চৌহদ্দিতে। মিটিগেশন মানে হল মূলত নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি ও তাদের পাথেয় করে উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো। আর নতুন ব্যবস্থা মানেই নতুন বাজারের হাতছানি। সোজা কথায় জি২০-র জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অ্যাকশন প্ল্যান প্রায় অপহরণ করে নিয়েছে ‘মিটিগেশন’ বা প্রশমন প্রয়াস, এবং ‘মার্কেট’ অর্থাৎ বাজার। নেই, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় যাদের দায়িত্ব, সেই জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, তেল ও গ্যাস কমানোর কথা। নেই, জলবায়ু সঙ্কট রোখার জন্য ‘অ্যাডাপ্টেশন’ অর্থাৎ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকে স্পষ্ট করে আর্থিক সাহায্য বাড়ানোর কথা, যা স্বল্পোন্নত ও ভারত-সহ উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য বলছে ‘মিটিগেশন’ খাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সাহায্য ইতিমধ্যেই ‘অ্যাডাপ্টেশন’-এর তুলনায় অনেক বেশি, এবং সে প্রবণতা বাড়তে চলেছে। ঘোষণাপত্রে সে ভাবে কোনও উল্লেখই নেই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বা ক্ষয়ক্ষতির। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিমধ্যেই জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলির মানুষদের জন্য আর্থিক সাহায্যের কথা, যা নিয়ে গত বছরের শর্ম এল শেখ আন্তর্জাতিক জলবায়ু বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল একটি আলাদা তহবিল তৈরি করার, এ বার কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে বাজারের ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু বাজার দিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনকে সামলে ফেলা যাবে, এমন ভাবনাটা ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কিছুই নয়। মনে পড়ে, ২০১১ সালে বাম রাজত্বের শেষে এক মন্ত্রী আফসোস করেছিলেন, আমরা বুঝতে পারিনি যে, সব কিছু বাজারের উপর ছাড়লে হয় না; সরকারকেও থাকতে হয়। আসলে বাজার অর্থনীতি কাজ করে লাভের উপর, রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট অর্থাৎ লগ্নির মূলধন কী ভাবে ফেরত আসবে তার উপর। এই অঙ্কে সুন্দরবনের সেই সব লক্ষ লক্ষ মানুষ নেই, যাঁরা ইতিমধ্যেই বারংবার ঘর, চাষের জমি হারিয়েছেন; নেই বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদীর চরে কোনও রকমে বেঁচে থাকা হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা বছরের অনেকটা সময় ন’দিনের নবজাতক থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে ঘরের আধপাকা ছাদে কাটাতে বাধ্য হন। কেননা পুরো দ্বীপাঞ্চলই জলের তলায় চলে যায়। শুধু বাজারি ফর্মুলা দিয়ে এই মানুষগুলিকে বাঁচানো যাবে না, সরকারি সাহায্য দরকার। উন্নত দেশগুলি বহু দিন ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পাবলিক ফাইনান্স, অর্থাৎ সরকারি সাহায্য কমিয়ে বাজারকে সামনে আনতে সওয়াল করছিল, দিল্লি ঘোষণাপত্রে ভারতের নেতৃত্বে সেই ভাবনাটিতে খানিকটা যে সিলমোহর পড়ল, তাতে সন্দেহ নেই। সেটাই আশঙ্কার।

মনে রাখতে হবে, নেতারা জি২০-তে যখন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তার ঠিক আগেই প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের গ্লোবাল স্টক টেক রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২০১৯-এর তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমাতে না পারলে কোনও রকমেই প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি বাড়তেই কী পরিস্থিতি, সেটা স্পষ্ট। দাবদাহে পুড়ছে সে সব দেশ ও অঞ্চল, যেখানে আগে এমন পরিস্থিতি চিন্তা করা যায়নি, বাড়ছে তীব্র ঘূর্ণিঝড়, হঠাৎ আকাশভাঙা বৃষ্টি এবং অনেক ক্ষেত্রেই এক সঙ্গে সেগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ছে পৃথিবীর উপর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন পৃথিবী জুড়ে গরিব মানুষ, যাঁদের এমন পরিস্থিতি সামলানোর শক্তি ও সঙ্গতি নেই। তাই গ্লোবাল স্টক টেক রিপোর্টে নির্দিষ্ট করে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাকে ছোঁয়া তো দূর স্থান, তার কাছাকাছিও পৌঁছনো সম্ভব হবে না যদি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার উন্নত দেশগুলি দ্রুত বন্ধ না করে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি কমিয়ে আনতে না পারে। এবং যদি অ্যাডাপ্টেশনকে যথোচিত গুরুত্ব না দেওয়া হয়।

মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে দুবাই জলবায়ু সম্মেলন। প্রায় দেড় দশক ধরে জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-কে কাছ থেকে দেখার সূত্রে এটা অভিজ্ঞতা যে, প্রায় প্রতি বছরই সম্মেলন শুরু হওয়ার পর উন্নত দেশগুলি এমন একটি অ্যাজেন্ডা নিয়ে হঠাৎ মাঠে নামে, যা আগে তেমন ভাবে ভাবনাতেও ছিল না। ২০১৯ সালে মাদ্রিদে নতুন বনাম পুরনো কার্বন বাজার, ২০২১ সালে গ্লাসগো সম্মেলনে নেট জ়িরো; উদাহরণের শেষ নেই। দেখা যায়, দু’-সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের একটা বড় অংশই চলে যায় নতুন আনা বিষয়টি বুঝতে ও বোঝার পর রাজনৈতিক চাপানউতোরে; পিছনে পড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু ঘণ্টা পর কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে এক তথাকথিত সর্বসম্মত রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র তৈরি হয়, যা থেকে সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনও লাভ হয় না। একই ভাবে যদি দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে জি২০ সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে ‘বাজার লাও, জলবায়ু বাঁচাও’— এই স্লোগান তোলেন উন্নত দেশগুলির প্রতিনিধিরা, তা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

আর এমনটা হলে— রাজনৈতিক আধিপত্যের টি২০ খেলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী যে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচার টেস্ট ম্যাচটা হারিয়ে দিতে অন্যতম বড় ভূমিকা নিয়েছেন, সেটাই ইতিহাসে লেখা থাকবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement