ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, আর সব ক’টি হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ হয় কলেজিয়াম ব্যবস্থার মাধ্যমে। প্রতীকী ছবি।
উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য ভারতে প্রচলিত ‘কলেজিয়াম’ ব্যবস্থা এ বছর তিরিশে পড়ল। এই দীর্ঘ সময়ে ব্যবস্থাটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠেছে। সম্প্রতি জাতীয় স্তরের একটি আলোচনা সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সুপরিচিত আইনজীবীদের বক্তব্যে এই ব্যবস্থার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন যেন আরও তীব্র হল। ইউপিএ আমলে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ হয়েছিলেন ছাপ্পান্ন জন বিচারপতি, আর এনডিএ আমলে পঞ্চান্ন জন। তাঁদের বিভিন্ন রায় বিশ্লেষণ করে ওই সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ মোহন গোপাল দেখালেন যে, এনডিএ আমলে ন’জন এমন বিচারপতিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, যাঁরা সনাতন হিন্দু ধর্মের মধ্যে তাঁদের দেওয়া রায়ের ভিত্তি ও যুক্তি খুঁজেছেন। ইউপিএ আমলে সেই সংখ্যা ছিল শূন্য। হিজাব-সংক্রান্ত রায়ে এক বিচারপতি সংবিধানকেই ব্যাখ্যা করেছেন সনাতন ধর্মের (রিলিজিয়ন অর্থে নয়) কাঠামোয়। অর্থাৎ, কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের পথ প্রশস্ত হচ্ছে, এমন আশঙ্কার কারণ রয়েছে। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাও পড়ছে প্রশ্নের মুখে। কলেজিয়াম দ্বারা নিয়োগের প্রক্রিয়া বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে কতটা মুক্ত রাখতে পারছে?
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, আর সব ক’টি হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ হয় কলেজিয়াম ব্যবস্থার মাধ্যমে। জেলা আদালত থেকে হাই কোর্টে, হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে কোন বিচারক অথবা বিচারপতির পদোন্নতি হবে, কর্মরত আইনজীবীদের থেকে বিচারপতি কে হবেন, কারা হবেন প্রধান বিচারপতি, এ সব নির্ধারণ করা কলেজিয়ামের কাজ। পঁচিশটি হাই কোর্টের এগারোশোর বেশি বিচারপতি, পঁচিশ জন প্রধান বিচারপতি, এবং সুপ্রিম কোর্টের তেত্রিশ জন বিচারপতি নিয়োগ করা সহজ ব্যাপার নয়। যে সমস্যাগুলি আলোচনায় উঠে এসেছে, তার অন্যতম অবশ্য কলেজিয়ামের নির্দেশ মানতে সরকারের গড়িমসি।
এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ সরাসরি অমান্য করা। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে এস মুরলীধরের যোগ দেওয়ার কথা ছিল, এখনও কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে নিযুক্ত করেনি। আইনজীবী আদিত্য সন্ধির নাম সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাঠানো সত্ত্বেও সরকার এক বছর ফাইল আটকে বসেছিল, শেষে অপমানে তিনি নিজেই সরে যান। বিচারপতি জয়ন্ত পটেল যাতে প্রধান বিচারপতি না হতে পারেন, সেই জন্যই তাঁকে বার বার বিভিন্ন হাই কোর্টে বদলি করা হচ্ছিল, এমন অভিযোগও উঠেছে। শেষে তিনি পদত্যাগ করেন। উদাহরণের অভাব নেই।
কলেজিয়াম ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি আলোচনায় উঠে আসে। প্রথম কথা, কলেজিয়াম সম্পূর্ণ গোপন এক প্রক্রিয়া। ফলে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে বার বার। রাজ্য সরকারগুলি এবং কেন্দ্রীয় সরকার যাঁদের নাম সুপারিশ করে কলেজিয়ামে পাঠায়, তাঁরা প্রায়ই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ, এবং দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী। প্রসঙ্গত, এই গোপনীয়তার কোনও নৈতিক বা আইনি ভিত্তি নেই।
দ্বিতীয়ত, প্রার্থীদের কোন মানদণ্ডে মাপা হবে, তার কোনও লিখিত নির্দেশিকা নেই। হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের উপরে বিচার হয়। সেখানে বিচারপতি হতে গেলে কী কী গুণ থাকতে হবে, সে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কি সংবিধানের মূল কাঠামোয় বিশ্বাস করেন? যদি ইতিমধ্যেই বিচারপতি হন, তা হলে তাঁর রায় কি সর্বদা সাংবিধানিক নৈতিকতা মেনে চলেছে? তিনি যদি উকিল হন, তা হলে তাঁর করা মামলাগুলিতে তিনি সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা কতটা পালন করেছেন? নারী-পুরুষ সাম্য, জনজাতিদের অধিকার, সমলিঙ্গে বিবাহ, নাগরিক স্বাধীনতা, ইত্যাদি সমসাময়িক প্রশ্নে তাঁর ভাবনা কী ধরনের? এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্দেশিকার অভাবে, এবং গোপনীয়তার কারণে, কলেজিয়ামের বিবেচনায় আসে কি না, তা জানার উপায় নেই। কলেজিয়াম প্রার্থীদের সম্পর্কে কী তথ্য জোগাড় করেছে, কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করেছে, তার কোনও নথিও নেই।
পুরো প্রক্রিয়াটির যে কোনও আনুষ্ঠানিক রূপ নেই, সেটিকেই একটি পৃথক সমস্যা বলে চিহ্নিত করা চলে। কলেজিয়ামের বৈঠকের আলোচনার কোনও লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। সারা বছর ধরে নিয়োগের কাজ চলে, কিন্তু কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও সচিবালয় নেই। যে-হেতু পুরো প্রক্রিয়াটি গোপন, তাই বিধিনিয়ম পালনের বিষয়ে দায়বদ্ধতা কতটা বজায় থাকছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটাও ওঠে। বিচারপতিদের মধ্যে মহিলা, সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, জনজাতির প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। জাতীয় আলোচনা সভায় জানা গেল, বিচারপতিকুলে দু’টি কি তিনটি উচ্চ জাতি সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। প্রস্তাব এল, কলেজিয়ামে কমপক্ষে এক জন মহিলা বিচারপতির উপস্থিতি আবশ্যক হওয়া উচিত। নিয়োগ পদ্ধতিতে স্বজনপোষণ বা স্বার্থসিদ্ধি আটকানোর প্রক্রিয়া না থাকাও একটা সমস্যা।
কলেজিয়াম ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি ব্যবস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে— প্রায় সকলেই একমত হলেন। বিচারপতি নিয়োগে সরকারের হস্তক্ষেপ ঠেকাতেই কলেজিয়াম ব্যবস্থার সূচনা। কিন্তু সেই ব্যবস্থা সংবিধানে বিধৃত আদর্শ ও রীতিনীতি থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না।