Women

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দুনিয়ায় মেয়েরা

ভারতেও ছবিটি উজ্জ্বল। আইআইটি চেন্নাই জ়ানজ়িবার-এ তাদের নতুন বিদেশি ক্যাম্পাসের অধিকর্তা হিসাবে বেছে নিয়েছে মহিলা বিজ্ঞানী প্রীতি অঘালয়মকে।

Advertisement

শুভঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

গত বছরের শুরুতে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা এক প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন— মঙ্গলগ্রহের বুকে রোবটযান কত উন্নত হতে পারে। আমেরিকার ইউটা মরুভূমির দুর্গমতা জয় করে প্রদর্শনীতে নজর কেড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার গোলাপি রোবট। রংটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তারুণ্যে ভরপুর বিজ্ঞানীদের দলে ছিল মেয়েদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে গত বছরটি নতুন আশা সঞ্চার করেছে। এগারো জন নোবেল প্রাপকের মধ্যে চার জন নারী— দীর্ঘ দিনের খরা কাটিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পঞ্চম মহিলা হিসাবে নোবেল পেলেন অ্যানে এলহুইলার; অর্থশাস্ত্রে প্রথম মহিলা একক নোবলপ্রাপক হলেন ক্লডিয়া গোল্ডিন, চিকিৎসাশাস্ত্রে পুরস্কৃত কাতালিন কারিকো। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন ইরানের নার্গিস মহম্মদি।

Advertisement

ভারতেও ছবিটি উজ্জ্বল। আইআইটি চেন্নাই জ়ানজ়িবার-এ তাদের নতুন বিদেশি ক্যাম্পাসের অধিকর্তা হিসাবে বেছে নিয়েছে মহিলা বিজ্ঞানী প্রীতি অঘালয়মকে। সিএসআইআর-এর মহানির্দেশক পদেও প্রথম মহিলা হিসাবে নিযুক্ত হলেন তড়িৎরসায়নবিদ নল্লাথাম্বি কলাইসেলভি। ফোর্বস পত্রিকার বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী একশো নারীর তালিকায় স্থান পেলেন আইআইটি রৌরকেলার প্রাক্তনী বাঙালি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সোমা মণ্ডল— রুগ্‌ণ হতে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেল’-এর পুনরুজ্জীবনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মেলবন্ধনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। চন্দ্রযান-৩’র সাফল্যের পিছনে কল্পনা কলাহাস্তি ও তাঁর সহকর্মীদের ভূমিকাও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে।

উপরের ঘটনাগুলি আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু, সামগ্রিক চিত্রটি ঠিক কেমন? সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরদের মধ্যে মেয়েদের অনুপাত ৪৩ শতাংশ। আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেনে এই হার যথাক্রমে ৩৪, ৩১ ও ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতীয় মেয়েরা বিজ্ঞান শিক্ষায় এগিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি পেশায় মেয়েদের উপস্থিতি মাত্র ২৮ শতাংশ। গবেষণা ক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদান ৩৩ শতাংশ হলেও ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্যতালিকায় তাঁদের উপস্থিতি মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ, আমাদের দেশের চিত্র কিছুটা হলেও উদ্বেগের। ‘লীলাবতীর কন্যা’দের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দুনিয়ায় শীর্ষ নেতৃত্বের স্তরে যথেষ্ট সংখ্যায় দেখার জন্য সম্ভবত আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতেই হবে।

Advertisement

বিদ্যাসাগর মহাশয় এক সময় বেথুন সাহেবের বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তে আসা মেয়েদের পাল্কির দেওয়ালে মহানির্বাণ তন্ত্রপুরাণ থেকে শ্লোক লিখে দিয়েছিলেন: ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ’। অর্থাৎ, (পুত্রের মতো) কন্যাকেও সযত্নে পালন ও শিক্ষা দান করতে হবে। ১৩৪৩ সালে প্রকাশিত ‘নারী’ নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সভ্যতা সৃষ্টির নতুন কল্প আশা করা যাক। এ আশা যদি রূপ ধারণ করে তবে এই সৃষ্টিতে মেয়েদের কাজ পূর্ণ পরিমাণে নিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই।” কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় নয় বছর আগে ঘোষিত হয়েছিল ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য কতটা দূর করা সম্ভব হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে ফলাফল যে খুব আশাব্যঞ্জক নয়, তা সকলেই মানবেন। প্রতি বছর ভারতে পালিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান দিবস— পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি রমনের বিখ্যাত আবিষ্কারের দিনটিকে স্মরণ করে। এ বছর আরও একটি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস মহা সমারোহে পালিত হয়েছে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে অমৃত মহোৎসবের মধ্যে। মূল বিষয়গুলির মধ্যে একটি ছিল লিঙ্গবৈষম্যের দূরীকরণ। মেধার জগতে এই প্রাসঙ্গিকতার ইতিহাস অনেক পুরনো। ষাটের দশকে শুরু হওয়া নানা পুরস্কার প্রাপকের তালিকা দেখলেই বোঝা যায় যে, বৈষম্যের দীর্ঘলালিত ত্রিভুজের মাথায় গুটিকয়েক নাম। সমস্যা শুধুমাত্র আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতি বছরই অক্টোবর মাসে প্রসঙ্গটি ফিরে ফিরে আসে। নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হলেই প্রাপকদের সংখ্যায় মেয়েদের উপস্থিতি এত কম কেন, তা নিয়ে বিশ্লেষণ হতে থাকে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার মেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উৎসাহিত করতে ইনস্পায়ার, প্রগতি, ডব্লিউআইএসই-কিরণ এ সব প্রকল্প নিয়ে আসায় কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ব জুড়ে কোভিড-লকডাউনের সময় একটি ঘটনা হইচই ফেলে দিয়েছিল। অনলাইনে ক্লাস করতে করতে বন্ধ ঘরের দরজায় প্রচণ্ড শব্দ— ক্লাস থামিয়ে শিক্ষিকা দেখলেন, তাঁর ছোট্ট খুদে সন্তান ক্লিপ বাঁকিয়ে দরজা খুলে সামনে এসে গেছে। করোনার অতিমারিতে বাচ্চাকে সামলে অনলাইনে পাঠদানের চ্যালেঞ্জ সত্যি কঠিন হয়ে পড়েছিল অনেক মেয়ের কাছে।

ভারতে সম্পূর্ণ দু’টি বিপরীত চিত্র এখন প্রকট বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের জগতে। এক দিকে ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সার্বিক উপস্থিতি চোখে পড়়ার মতো। আবার, অতিমারি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে বা তার প্রভাব সীমাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থতা তো আছেই, পাশাপাশি আছে জনমানসে বিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন। বিজ্ঞানের নামে কখনও চলে অবৈজ্ঞানিক কর্মসূচি, কখনও সঙ্কট আসে বিজ্ঞানসম্মত বলে কোনও সত্যের গ্রহণযোগ্যতায়, কখনও বিজ্ঞানের পরিচালনা বা গভর্ন্যান্স নিয়ে। সে লড়াই বিজ্ঞানের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত, সৎ ভাবে বিজ্ঞানচর্চা করতে চাওয়া প্রতিটি মানুষেরই। কিন্তু, আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো এখানেও মেয়েদের লড়াই আরও এক দফা কঠিন। পরিবারের কারণে, সমাজের কারণে, প্রতিষ্ঠানের কারণেও। অতএব, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিভিন্ন পরিসরে ভারতীয় নারীদের সাফল্য দেখে আমাদের নিশ্চয়ই খুশি হওয়া উচিত, তাঁদের নিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করা উচিত— কিন্তু, পাশাপাশি মনে রাখা জরুরি যে, আরও অনেক মেয়ের যুদ্ধজয় এখনও বাকি থেকে গিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement