Women

মেয়েদের নিজের ঘর হয় কি

প্রান্তিক মানুষদের কোনও সিকিয়োরিটি ছাড়া ধার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থা আছে। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে কিস্তির টাকা শোধ করতে হয়।

Advertisement

ঋতুপর্ণা রুদ্র

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৯
Share:

অনেকটাই অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে সমাজে মেয়েদের অবস্থান।

ভার্জিনিয়া উলফ, তাঁর আ রুম অব ওয়ান’স ওন বইতে লিখেছিলেন, যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজের জন্য মেয়েদের একটি নিজস্ব ঘরের বড় প্রয়োজন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। প্রায় একশো বছর কেটে গিয়েছে তার পরে। অথচ, অনেকটাই অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে সমাজে মেয়েদের অবস্থান। আগে ভাবা হত অর্থনৈতিক অবস্থান পাল্টালেই বুঝি বাড়ি বা পরিবারে মেয়েদের জোর বাড়বে। ভাবনার মধ্যে অনেকটা সত্য থাকলেও, বাস্তব অবস্থা অনেক সময়ে আলাদা হয়। সারা মাস লোকের বাড়ি কাজ করে উপার্জন করা কল্যাণীই হোক, বা ব্যাঙ্কে চাকরি করা উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত সুচন্দ্রাই হোক, মিল রয়ে যায় কোথায় যেন।

Advertisement

আমার এক বান্ধবীর মা এক বার বলেছিলেন, ইনক্রিমেন্ট-এর খবর তিনি বাড়িতে জানাননি— “নিজের টাকা থেকে নিজেই চুরি করি, বুঝলি?” সেই সময়ে মাইনে হত নগদ টাকায়। তাই হয়তো সেটা সম্ভব ছিল। আজকের ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার-এর যুগে ভদ্রমহিলা অসহায় হয়ে পড়তেন বলেই মনে হয়। নিজের টাকার উপরেই যখন পুরো অধিকার পাওয়া যায় না, তখন নিজস্ব ঘর থাকা তো আরও দূরের ব্যাপার। সত্যি যে, জমি, বাড়ি, অনেক সময় কেনা হয় স্ত্রী বা মায়ের নামে। কিন্তু তাঁদের মতামতের দাম কতটুকু? পিতৃসম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার তো অনেক আগেই আইনত স্বীকৃত, কিন্তু আজও বহু মেয়ে বাপের বাড়ির সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দিয়েই খুশি থাকেন। তাঁদের বোঝানো হয়, বাবা-মা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি তো তোমারই। এমনকি যে মেয়েরা, ভাই বা দাদা থাকা সত্ত্বেও পৈতৃক সম্পত্তি দাবি করেন, সমাজে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থপর বলে চিহ্নিত হন।

শ্বশুরবাড়িতেও একেবারে নিজস্ব ঘর কোনও মেয়ের কি জোটে? একটি ঘর হয়তো ভাগে বরাদ্দ, সেখানে স্বামীর কথাই শেষ কথা। মেয়েটি যদি কোনও সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হন, তা হলে সেই কাজ তাঁকে করতে হবে অন্যের অসুবিধা না ঘটিয়ে। নাচ-গানে পারদর্শী হলে করতে হবে দুপুরবেলা, কারণ সেই সময়ে স্বামী অফিসে এবং ছেলেমেয়ে স্কুলে। স্বনামধন্য এক লেখিকা আমাকে বলেছিলেন, যদিও তাঁর রান্না, ঘরের কাজের লোক আছে, তবুও সন্ধেবেলা অফিস থেকে এসে তাঁর স্বামী যদি দেখেন স্ত্রী রান্নাঘরে ব্যস্ত বা সংসারের কোনও কাজ করছেন, তা হলে খুশি হন। তার বদলে স্ত্রী বইপত্র ছড়িয়ে, মগ্ন হয়ে লেখাপড়া করছেন, এ দৃশ্য তেমন সুখকর নয়।

Advertisement

ফিরি কল্যাণীর কথায়। কল্যাণী ছ’বাড়ি কাজ করে মাসে আট হাজার টাকা রোজগার করেন বটে, কিন্তু বেশির ভাগ টাকাই চলে যায় ধার শোধ করতে। প্রান্তিক মানুষদের কোনও সিকিয়োরিটি ছাড়া ধার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থা আছে। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে কিস্তির টাকা শোধ করতে হয়। লোনবাবু এসে পাড়ার মন্দিরের চাতালে বসে থাকেন। কিস্তির টাকা দিলে লোনের বইতে সই করে দেন। যাঁরা নিয়মিত টাকা ফেরত দেন, অর্থাৎ যাঁদের রেকর্ড ভাল, তাঁদের একাধিক লোনও মেলে। সুদের হার অত্যন্ত বেশি, ২০ থেকে ২২ শতাংশ। তবে ব্যাঙ্কে গিয়ে লোন নেওয়ার চেয়ে এই ব্যবস্থাই ওঁদের পছন্দ।

ছোট থেকে ভাড়ার একচিলতে পরিসরে, ছয় ভাইবোন আর মাকে নিয়ে থাকা কল্যাণীর নিজস্ব একটা ঘরের স্বপ্ন ছিল। ১৭-য় বিয়ে হয়, পাত্র সুন্দরবনের গ্রামের ছেলে, জমিজমাও আছে। স্বপ্নের কাজল মেখে স্বামীর ঘর করতে গিয়ে প্রতিপদে অপমানিতই হতে হত। শাশুড়ির অত্যাচার মাত্রা ছাড়ালে, এক দিন শহরে এসে ঠাঁই নিতে হল স্বামী-স্ত্রীকে। আবার সেই ভাড়া ঘর। কল্যাণীর নিঃসন্তান কাকা, মৃত্যুর সময়ে এক টুকরো জমি দিয়ে গেলেন ভাইপো-ভাইঝিকে। তারই একধারে দরমার বেড়া আর টালির চালে সাকার হল ওঁর স্বপ্নের ঘর। সেই একখানি ঘরে আপাতত ঠাঁই নিয়েছেন কল্যাণী, তাঁর স্বামী, পঁচিশ আর একুশ বছরের দুই ছেলে, বড় ছেলের বৌ আর নাতনি। একটিই খাটে কল্যাণীকে তাঁর বড় ছেলে, বৌমা, আর নাতনির সঙ্গে শুতে হয়। মেঝেতেও বিছানা হয় বাকিদের জন্য। আহার নিদ্রা মৈথুন সবই এক সঙ্গে। আড়াল বা আব্রুর উপায় কোথায়? বর্ষাকালে ঘরে জল ঢুকে গেলে, ছ’টি প্রাণী একটি খাটের উপরে বসেই রাত কাটিয়ে দেন।

ঋণ শোধের শেষ ভাগে প্রতি বারই কল্যাণী ভাবেন, পরের বার ঋণ নিয়ে পাশে আর একটা ছোট ঘর তুলবেন। তাঁর নিজস্ব ঘর। এক পাশে ঠাকুরের আসন পাতা, অন্য পাশে সেলাই মেশিন। সব বাড়ির কাজ সেরে, ফিরে এসে বানাবেন সায়া, জামা, নাতনির জন্য টেপফ্রক, আরও অনেক কিছু, এমব্রয়ডারি করে ফুটিয়ে তুলবেন নকশা। নিশ্চিন্তে সেখানে কাপড় ছাড়া যাবে, একটু আড়াল জুটবে। অথচ প্রতি বারই সামনে এসে দাঁড়ায় অন্য কিছু। ঋণের টাকায় স্বামীর যাতায়াতের জন্য দামি বাইক কেনা হয়, কখনও ছেলের জন্য লাগে মোবাইল। এমনকি নাতনির অন্নপ্রাশনে আত্মীয়, প্রতিবেশীদের ভূরিভোজ করিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় টাকা।

কল্যাণী জানেন না, তিন কামরার মস্ত ফ্ল্যাটেও, নিজস্ব কাজের ঘর পাওয়া হয় না অনেকে মেয়েরই। ভাবনাটুকুই সম্বল হয় কেবল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement